সৎ ও সাহসী শ্রমিক নেতা কাজী মোহাম্মদ সাঈদ

কাজী ইফতেখারুল আলম তারেক

কাজী মোহাম্মদ সাঈদ। বাংলাদেশে মেহনতি ও শ্রমজীবি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য যে’জন শ্রমিক নেতা অবদান রেখেছেন তার মধ্যে অন্যতম তিনি। বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবি মানুষের অধিকার ও দাবি আদায়ের মহানায়ক হিসেবে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন। আজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি উপমহাদেশের বিশিষ্ট শ্রমিকনেতা প্রয়াত কাজী মোহাম্মদ সাঈদকে। আজ এই মহান মানুষটির মৃত্যুবার্ষিকী।

পাকিস্থান শাসনামলে বাঙালি শ্রমিকদের জীবন দুর্বিষহ আর সীমাহীন বঞ্চনার মধ্যে অতিবাহিত হয়। মালিক পক্ষ ন্যায্য মুজুরি আর সীমাহীন শাসন-শোষণ করতো। অসহনীয় পরিবেশে বিরতিহীন কাজ আর প্রাপ্য মজুরী হতে বঞ্চিত করা হতো। কল-কারখানা শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের বেতন বকেয়া পরে থাকতো। নিদারুণ অভাব আর অমানবিক পরিশ্রমের ফলে শ্রমজীবী মানুষদের স্বাস্থ্যহানী ঘটতো । তাদের সুখ-দুঃখের গল্প বলার তেমন কোন জায়গা ছিল না। ষাটের দশকে ঠিক সে সময় খুলনা শীপ ইয়ার্ডে শ্রমিকদের প্রাপ্য অধিকার আদায়ে কাজী মোহাম্মদ সাঈদ শ্রমিকদের অবর্ণনীয় দুঃখ দেখে দাবি তুলেছিলেন। কল-কারখানায় শ্রমিকের উপর নিপীড়ন বন্ধ করার জন্য মালিক পক্ষের কাছে আহবান জানান।

পাকিস্থানি মালিক পক্ষ তাদের দাবি-দাওয়া পূরণে অসমর্থ হলে দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের ডাক দেন তিনি। শ্রমিক ধর্মঘটে স্থবিরতা নেমে আসে পুরো শীপ ইয়ার্ডে। এতে শ্রমিক মালিক রুদ্ধদ্বার বৈঠক বসে। মালিকের একপেশে আচরণে আলোচনা ভেস্তে গেল সব। পরে আন্দোলনের ফলে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক আসে। রাতের আঁধারে কাজী সাঈদকে গ্রেফতার করে বন্দি করলো মালিক পক্ষ। শ্রমিক নেতার মুক্তির দাবীতে শিল্পনগরী খুলনা অচল। লোহার রড হাতে শ্রমজীবী মানুষের ঢল নামে। স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত শহর। একা দফা একা দাবী কাজী সাবের মুক্তি দিবি। কল কারখানার চাকা ঘুরবে না হরতাল হরতাল।

আরও পড়ুন:  একুশে বইমেলা আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিকাশে একটি অন্যতম অনুষঙ্গ : রাষ্ট্রপতি

আন্দোলনরত শ্রমিকদের রুখতে গিয়ে পুলিশ লাঠি চার্জ করে। সে সময় পুলিশের নির্মম প্রহারে বেশ ক`জন শ্রমিক নিহত হন। আহত হন শতাধিক। গণহারে শ্রমিক গ্রেফতার করে পুলিশ। জেলের প্রকোষ্ঠে শ্রমিক নেতা কাজী সাঈদকে ফাঁসির হুমকি দেয় তৎকালীন প্রশাসন। শ্রমিকদের উসকানি দেওয়ার অভিযোগে একাধিক মামলায় জর্জরিত হতে হয় । এই সময় তিনি বলেন, ‘কারাগারে ফাঁসি দিতে চাইলে আমাকে দাও কিন্তু আমার হাজার হাজার শ্রমিক ভাইয়ের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দাও।’ তাঁর অনঢ় অবস্থান ও দৃঢ়তাব্যঞ্জক উচ্চারণের ফলে শর্তসাপেক্ষে পিছুটান নেয় মালিক পক্ষ। শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার কারণে তাকে চাকুরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। কাজী সাঈদ হাজারো শ্রমিকের সুবিধার্থে হাসিমুখে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আসলেন। মানতে চাইলো না শীপ ইয়ার্ড শ্রমিকসংঘ। এরপরে দেশের শ্রমিকরা এর মাধ্যমে তাদের অধিকারের প্রতি আরও মনোযোগী হয়ে উঠে। নিজেদের অধিকার আদায়ে তারা এগিয়ে যায় সামনে। মেহনতি মানুষ মুক্তি পেতে শুরু করে তাদের শৃঙ্খলিত জীবন থেকে। কর্ম ক্ষেত্রে পরিবর্তনের পথে সূচিত হয় নতুন দিগন্ত।

স্বাধীনতা লাভের পর কাজী মোহাম্মদ সাঈদ সাহেব যোগদান করলেন জুট মিলে। দেশভাগ হলেও শিল্প কলকারখানায় শ্রমিক- মালিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈরী পরিবেশ কাটেনি। শ্রমিক সংঘের পরিবর্তে ট্রেড ইউনিয়ন চালু করার ব্যাপারে যুগান্তকারী ভুমিকা রাখেন। নব্য পতাকায় কলংঙ্ক যেন না লাগে সে জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে একাধিক বৈঠক করেন। বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে এসে দেশ সেবার সুযোগ পান।

আরও পড়ুন:  ৪৪তম বিসিএস মৌখিক পরীক্ষার সময়সূচি প্রকাশিত

জুটমিলের চাকা`র সাথে সদ্যপ্রসূত দেশের ঘূর্ণায়মান অর্থনীতির চাকা জড়িত ছিল। ঢাকায় শ্রমিক দের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিলে বঙ্গবন্ধু ডেকে পাঠাতেন তাকে। শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ-সংরক্ষণে শ্রমিক বান্ধব বঙ্গবন্ধু দেশের উল্লেখযোগ্য শ্রমিক নেতাদের সাথে আলোচনায় বসেন। ট্রেড ইউনিয়ন চালুর ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু সঠিক সুরাহা দেন। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং শ্রমজীবী মানুষের দাবি দাওয়া নিয়ে সরকারের কাছে ট্রেড ইউনিয়ন চালুর ব্যাপারে অনুরোধ করেন।

এরপরে, কাজী মোহাম্মদ সাঈদ ১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে বিআইডব্লিউটিসিতে যোগদান করেন। বিআইডব্লিউটিসি সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজমান। শ্রমিক সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা হতে বঞ্চিত। ডাক দিলেন শ্রমিক ধর্মঘট। নারায়নগঞ্জ,আরিচা,খুলনা,মাওয়া,বরিশাল, চট্টগ্রাম সকল নৌচলাচল বন্ধ। ট্রেড ইউনিয়ন চালু করতে হবে নইলে সাগর জলে জাহাজ ডুববে। কর্তৃপক্ষ ধর্মঘট প্রত্যাহার করে জাহাজ চালুর নির্দেশ দিলেন। কাজী সাঈদ সাহেবের নেতৃত্বে হাজার হাজার শ্রমিক রাস্তায় নামলো। ঢাকা-নারায়নগঞ্জ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। গ্রেফতার করা হলো। পুলিশ শ্রমিক মুখোমুখি সংঘর্ষ। হতাহতের ঘটনা ঘটলো। উত্তপ্ত নারায়নগঞ্জ, আরিচা,বরিশাল, খুলনা,চট্টগ্রাম। সন্ধ্যা নাগাদ অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে কাজী সাহেবকে গ্রেফতার করে। শ্রমিকের ধমনীতে আগুনের ফুলকি জ্বলে উঠলো। একঘন্টার মাথায় মুক্তি দিতে বাধ্য হলেন প্রশাসন। নারায়নগঞ্জ ৫ নং ঘাটে হাজার হাজার শ্রমিক অপেক্ষমাণ। প্রিয় নেতাকে কাছে পেয়ে গর্জে উঠলো। কাজী সাহেব ঘোষণা দিলেন অনতিবিলম্বে ট্রেড ইউনিয়ন চালু না করলে এমভি রামু,রকেট সার্ভিস, ফেরি সার্ভিস সাগর তলে ডুববে।

আরও পড়ুন:  স্মার্ট ডাক সেবার যুগে ভাসানচর : পলক

লাগাতার ধর্মঘটের কারণে জনদুর্ভোগ বাড়ছে। তৎকালীন সরকার রুদ্ধতা`র বৈঠক করে ট্রেড ইউনিয়ন চালু করে। কাজী মোহাম্মদ সাঈদ সাহেব বিআইডব্লিউটিসি`র নাবিক এন্ড কর্মচারী ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

কাজী মোহাম্মদ সাঈদ ছিলেন অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে অগ্রগামী সৈনিক। সাহসী পদক্ষেপ ও ন্যায্যতা ছিল সামনে এগিয়ে যাওয়ার মূলমন্ত্র। শ্রমিক বান্ধব কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন পাশাপাশি কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণ করেছেন। বিভিন্ন মেয়াদে সরকার পরিবর্তনে জাহাজ ও স্থায়ী সম্পত্তি বিক্রি করে লুটেপুটে খাওয়ার পায়তারা সূচিত হলে শক্ত হাতে দমন করে শ্রমিক অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ করেছেন।

বিআইডব্লিউটিসি`র মেহনতি মানুষের দাবী আদায়ের পক্ষে সোচ্চার কণ্ঠে সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন বিধায় উপমহাদেশের খ্যাতিমান শ্রমিক নেতা হিসেবে সম্মান অর্জন করেছেন। আইএলও থেকে বিরল সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। সততা ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য অবসর গ্রহণকালে বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ কাজী মোহাম্মদ সাঈদ সাবকে গোল্ড মেডেল প্রদান করেন।

জয় হোক সাম্যের, জয় হোক মেহনতি মানুষের।

লেখক-কাজী ইফতেখারুল আলম তারেক। সাংবাদিক ও সংগঠক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *