শেখ হাসিনার মামলার বিচার কার্যক্রম

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলার রায় ঘোষণা চলছে। 

সোমবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ রায় ঘোষণা শুরু করেন। এটি জুলাই অভ্যুত্থানে ঘটা অপরাধের প্রথম বিচারের রায় ঘোষণা।

মামলায় শেখ হাসিনাসহ বাকি দুইজন হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।

বিচারের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো

অভিযোগ জমা

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের সময় ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গত বছরের ১৪ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ করেন শহীদ সিয়ামের বাবা বুলবুল ফকির। এতে প্রথম অভিযোগ ছিল শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ কী বলা হয়

অভিযোগে বলা হয়েছে, এক থেকে ৯ নম্বর আসামির নির্দেশে ও পরিকল্পনায় অন্য আসামিরা দেশি এবং আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে আন্দোলনকারী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে। এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাই ও পর্যালোচনা করে মামলা হিসেবে ট্রাইব্যুনালের ‘কমপ্লেইনার’ রেজিস্টারে নথিভুক্ত করা হয়। সে ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

বিচারকাজ শুরু

এরপর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ শুরু হয় গত বছরের ১৭ অক্টোবর। সেদিনই এ মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর তদন্ত সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছর ১৬ মার্চ সাবেক আইজিপি মামুনকে এ মামলায় আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা চলতি বছরের ১২ মে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। আর প্রসিকিউশন শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে গত ১ জুন। প্রসিকিউশনের দাখিল করা অভিযোগপত্রটি ছিল ১৩৫ পৃষ্ঠার। এর সঙ্গে আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার বিভিন্ন নথি ও তথ্যপ্রমাণ জমা দেওয়া হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার জানে আলম খান ও মো. আলমগীর।

আরও পড়ুন:  পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ হয়ে আসছে: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান দমনে এক হাজার ৪০০ জনকে হত্যা ও ২৫ হাজার মানুষকে অঙ্গহানির উস্কানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’সহ মোট পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়ে গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম মামলার বিচার শুরু হয়। উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ২৩ অক্টোবর শেষ হয় মামলার বিচার। চলতি বছর গত ২ জুলাই আদালত অবমাননার দায়ে শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন একই ট্রাইব্যুনাল।

মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ

গত ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী খোকন চন্দ্র বর্মণের সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ মোট ৮১ জনকে সাক্ষী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল-মামুন এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ৫৪ জন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন। পাশাপাশি দেশী-বিদেশি গণমাধ্যমে জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত অডিও, ভিডিও এবং অন্যান্য প্রমাণ আদালতের কাছে উপস্থাপন করা হয়।

আরও পড়ুন:  ভূমিকম্পে হতাহতের ঘটনায় জাপানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে শোক বার্তা পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী

যুক্তিতর্ক শুরু

যুক্তিতর্ক শুরু হয় চলতি বছরের ১২ অক্টোবর। গত ২৩ অক্টোবর উভয় পক্ষের শুনানি, যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মামলাটির বিচারকার্য শেষ হয়।

গত বছর ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত অভিযোগ গঠনের পর থেকে তিন মাস ১৩ দিনের মধ্যে বিচার শেষ হলো।

আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগ

পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়ে চার্জ গঠন করেছেন ট্রাইব্যুনাল। সেগুলো হলো– গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া, রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আবু সাঈদকে হত্যা, হেলিকপ্টারে প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ, চাঁনখারপুলে ৬ জনকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ এবং আশুলিয়ায় ৬ জনকে হত্যা ও লাশ পোড়ানোর নির্দেশ।

প্রসিকিউশনের বক্তব্য

অভিযুক্তরা দণ্ডিত হলে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ভিকটিমদের পরিবারগুলোর মধ্যে বণ্টনের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ আবেদন জানিয়েছেন প্রসিকিউশন। গতকাল রোববার প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনালের আইনের বিধান অনুযায়ীই এই আবেদন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, যেহেতু আইনে রয়েছে, তাই আমরা দোষীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আবেদন করেছি। ন্যায়বিচারের স্বার্থে ট্রাইব্যুনাল যে আদেশ দেবেন, প্রসিকিউশন তা মেনে নেবে।

প্রসিকিউটর আরও জানান, এই মামলায় শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হয়েছে। প্রসিকিউশন বিশ্বাস করেন, এ মামলায় আনা পাঁচটি অভিযোগই তারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছেন।

রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাকে নারী হিসেবে কোনো রকমের সহানুভূতি বা বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে না।

আরও পড়ুন:  আমরা কোনও প্রতিকূল আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া আশা করি না

অন্যদিকে, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল খালাস পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। তিনি বলেন, আমার প্রত্যাশা, আমার মক্কেলরা খালাস পাবেন।

বিচার প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্বচ্ছ এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে– দাবি করেছেন প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম। তিনি বলেন, নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, স্বচ্ছ এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷ এখন দেশে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দৃঢ়তার সঙ্গে এ ধরনের পদক্ষেপকে রুখে দেবে।

এ প্রসঙ্গে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না সমকালকে বলেন, যদি কোনোদিন রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়, আওয়ামী লীগ ফিরে আসে, তাহলে এই রায় টিকবে না। যেমন ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা বাতিল হয়ে গেল।  সেই কারণে কী সাজা হলো বা হলো না– সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। আমি এই বিচারকে গুরুত্ব দিচ্ছি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *