লিভার রোগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ: অধ্যাপক ডা.মামুন আল-মাহতাব স্বপ্নিল

অধ্যাপক ডা.মামুন আল-মাহতাব স্বপ্নিল , মানব দেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ  হলো লিভার

এটি শরীরের বিভিন্ন কাজে প্রধান ভূমিকা পালন করা ছাড়াও দেহের বিপাকে কাজ করে। প্যারেনকাইমাল ও নন-প্যারেনকাইমাল নামের দুই ধরনের কোষ দিয়ে লিভার গঠিত হয়।

প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের লিভারের ওজন থাকে ১.৫০ (এক দশমিক পাঁচ শূন্য কেজি) প্রতিবছর সারা বিশ্বে প্রায় এক লাখ মানুষ লিভারের রোগে মারা যায়। লিভারের রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ, মদ্যপান, ধূমপান ইত্যাদি নানা কারণে লিভারের ক্ষতি হয়। সংক্রমণ, ওষুধ, স্থূলুস্থতা ও ক্যান্সারসহ আরও অনেক কারণেই লিভারের রোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সাধারণত লিভারের যে রোগগুলো হয়ে থাকে, এরমধ্যে ভাইরাল হেপাটাইটিস (জন্ডিস), লিভার সিরোসিস, লিভারের ফোঁড়া, পিত্তথলির বা পিত্ত-নালির রোগ, ফ্যাটি লিভার, লিভার ক্যান্সার অন্যতম।

লিভারে সমস্যা শুরু হলেই শরীরে বিভিন্ন লক্ষণ জানান দেয়। তবে অনেকের শরীরে আবার অজান্তেই লক্ষণ ছাড়া বাসা বাঁধতে পারে এইসব রোগ।

অনেকে লক্ষণ সম্পর্কে জানেন না বলে হয়তো অবহেলায় রোগ বাড়িয়ে তোলেন। তাই লিভার রোগের লক্ষণগুলো আমাদের জানা থাকলে এবং  শুরুতেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে এই রোগ জটিল হওয়ার  আগেই আমরা আমাদের লিভার বা লিভার সংক্রান্ত রোগ থেকে প্রতিকার পেতে পারি। লিভার রোগে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা যেসব  লক্ষণের মধ্যে- বারবার বমি হওয়া, ফ্যাকাশে মল, খাওয়ার পর মুখে তেতো ভাব, পিত্তে সমস্যা, চর্বি জাতীয় খাবার খাওয়ার পর পেটে ব্যথা হওয়া, চোখের উপরে ব্যথা করা, ক্লান্তিবোধ ইত্যাদি প্রধান।  ফ্যাটি লিভার রোগের লক্ষণ অনেকে পেটের অতিরিক্ত চর্বি সমস্যায় ভোগেন, একে ফ্যাটি লিভার বলে। এটা ‘হেপাটিক স্টেটোসিস’ নামেও পরিচিত। লিভারে অল্প পরিমাণ চর্বি থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু চর্বি অতিরিক্ত জমে গেলে তা বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি করে। সাধারণত ফ্যাটি লিভার ২ ধরনের হয়ে থাকে। একটি অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার এবং অন্যটি নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার। যাদের নিয়মিত মদ্যপান করার অভ্যাস আছে, তাদের অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার হয়ে থাকে। নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার হয় সাধারণত অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণ, অতিরিক্ত চিনি, কার্বো হাইড্রেট, প্রসেসড ফুড এবং অতিরিক্ত মসলাদার খাবার গ্রহণের কারণে।  এসব কারণ ছাড়াও বিভিন্ন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করলে, ডায়াবেটিক বা রক্তে কোলেস্টরলের মাত্রা বেশি থাকলেও ফ্যাটি লিভার হতে পারে। আবার একটা নির্দিষ্ট বয়সের পরও অনেকের বংশগত কারণে ফ্যাটি লিভার হতে পারে।

আরও পড়ুন:  পদ্মা সেতু প্রকল্পের খরচ কমলো ১৮২৫ কোটি টাকা

বাংলাদেশে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাই বেশি। অধিকাংশ মানুষই জানেন না, লিভারে ফ্যাট জমলে তা গুরুতর আকারে রূপ নিতে পারে। ফ্যাটি লিভার থেকে প্রথমে হেপাটাইটিস বা লিভারের প্রদাহ হয়। এরপর তা লিভার সিরোসিসের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তবে শুরুতেই এর লক্ষণগুলো ধরতে পারলে অনেক গুরুতর সমস্যার সমাধান হতে পারে।   সাধারণত ফ্যাটি লিভারের লক্ষণগুলো-হজমে সমস্যা হওয়া ও খাবারে অরুচি আসা। খাবারের সময় বমি বমি ভাব হওয়া  অনেক সময় পেট ও শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুলে যাওয়া হঠাৎ করেই ওজন কমে যাওয়া  মাথাব্যথা, ডিপ্রেশনে থাকা বা মন খারাপ হওয়া সাধারণত টাইপ টু ডায়াবেটিস রোগীদের, মেনোপজ শুরু হওয়া নারীদের, স্থূল ব্যক্তিদের, কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকা ব্যক্তিদের এবং উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীদের ফ্যাটি লিভারের ঝুঁকি বেশি থাকে। লিভার ক্যান্সারের লক্ষণ পুরো পৃথিবীতে ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ লিভার ক্যান্সার। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ লোক এ রোগে আক্রান্ত হন। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় লিভার ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা পৃথিবীর অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি। লিভার ক্যান্সারের মূল কারণ হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস এবং মদ্যপান।

আরও পড়ুন:  প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাছাই শেষ, কাল আপিল শুরু

আমাদের দেশে প্রায় ৮০ লাখ লোক হেপাটাইটিস বি-ভাইরাসের বাহক, তাই এদেশে লিভার ক্যান্সারের মূল কারণ এটাই। এ ভাইরাসে আক্রান্ত ৫-১০ শতাংশ লোক জীবনের কোনো এক পর্যায়ে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ২/৩ ১. লিভার ক্যান্সারের লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানা থাকলে প্রাথমিক অবস্থাতেই চিকিৎসা নেয়া সম্ভব হবে।  লিভার ক্যান্সারের লক্ষণ  পেটের ডান পাশে উপরের দিকে অথবা বুকের ঠিক নিচে মাঝ বরাবর ব্যথা অনুভব হওয়া, সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়া, পেট ফাঁপা থাকা ৪. ওজন কমে যাওয়া ৫. হালকা জ্বর জ্বর ভাব থাকা  ৬. খাওয়ায় অরুচি হওয়া ৭. অতিরিক্ত গ্যাস হওয়া। লিভার ক্যান্সারে যেকোনো বয়সের লোকই আক্রান্ত হতে পারেন। তবে নারীদের চেয়ে পুরুষদের ৪ থেকে ৬ গুণ বেশি ঝুঁকি থাকে। সাধারণত ক্যান্সার হওয়ার আগে লিভারে সিরোসিস দেখা দেয়, তবে এর ব্যতিক্রম হওয়াটাও অস্বাভাবিক। লিভার দুর্বলতার লক্ষণ  শরীরের সমস্ত ক্ষতিকারক টক্সিন ছেঁকে বের করে দেয় লিভার। এর স্বাভাবিক কর্মক্ষর্ম মতা নষ্ট হলে শরীরে জমে যাওয়া টক্সিন শরীরেই থেকে যায়। এর ফলে একের পর এক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হতে শুরু করে। এ কারণে লিভার সুস্থ রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ১. হরমোনাল ইমব্যালেন্স হওয়া, ২. হঠাৎ করেই ওজন কমা বা বাড়া ৩. অনবরত বমি ভাব দেখা দেয়া ৪. অ্যালার্জি ও হজমের সমস্যা হওয়া ৫. খাওয়া- দাওয়ার পরেই ক্লান্তিবোধ করা ৬. মুখে দুর্গন্ধ হওয়া ৭. মাথাব্যথা করা ৮. ঘুমের সমস্যা দেখা দেওয়া ৯. মুড সুইং হওয়া ১০. উচ্চরক্তচাপ এবং উচ্চ কোলেস্টেরল সমস্যা দেখা দেয়া। এছাড়া লিভার দুর্বল হওয়ার আরও কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো ঘন ঘন শরীর খারাপ হওয়া, গোড়ালি এবং পেট ফুলে যাওয়া, বিভ্রান্তি, তন্দ্রাচ্ছন্নভাব, ডায়রিয়া, চোখ এবং ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:  ১৪ই জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। চেম্বার: ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, মিরপুর রোড, ধানমণ্ডি, ঢাকা। হটলাইন-১০৬০৬। ০১৭০৫-২৪৮৯১২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *