মত প্রকাশ তো অনেক দূর, বেঁচে থাকার অধিকারের ব্যাপার এসে গেছে: মাহফুজ আনাম

‘মতপ্রকাশ তো অনেক দূর হয়ে গেছে; এখন বেঁচে থাকার অধিকারের ব্যাপার এসে গেছে।’ প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ এবং নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরকে হেনস্তার ঘটনায় এ কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। 

বৃহস্পতিবারের হামলার ঘটনার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর সাংবাদিকদের হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ওইদিন ২৬ থেকে ২৭ জন স্টাফ ভবনের ভেতরে আটকে ছিল, ফায়ার সার্ভিসকে যেতে দেওয়া হয়নি। তাদের উদ্দেশ্য শুধু ভবনে আগুন দেওয়া ছিল না, হত্যা করার উদ্দেশ্য ছিল। মাহফুজ আনাম বলেন, ‘সোশাল মিডিয়াতে দেখা গেছে, তারা বলছে যে, ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর যারা সাংবাদিক, ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের হত্যা করতে হবে।’

তিনি বলেন, প্রথম দিনে আমি অত সচেতন ছিলাম না। আমার প্রায় ২৫ থেকে ২৬ জন সহকর্মী তারা ছাদে আটকে পড়েছিলেন। এমন যদি হতো যে, যারা ডেইলি স্টারকে ঘৃণা করে তারা বলতো—তোমাদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নাই। তোমরা বেরিয়ে যাও। আমরা বিল্ডিংয়ে আগুন লাগাব।

তিনি বলেন, ‘সেই ২৬-২৭ জন ছাদে আটকে ছিল এবং ফায়ার ব্রিগেডকে আসতে দেওয়া হয় নাই। এটার মানে কি? মত প্রকাশ তো অনেক দূর হয়ে গেছে, এখন বেঁচে থাকার ব্যাপার এসে গেছে। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি, আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকবেন।

আরও পড়ুন:  শেখ হাসিনাকে তৃতীয় দেশে পাঠানোর বিষয়ে কূটনীতিক চ্যানেলে কোনো তথ্য নেই: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

শীর্ষস্থানীয় এ দুই গণমাধ্যমে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ এবং নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরকে হেনস্তার প্রতিবাদে সংবাদপত্রের মালিক ও সম্পাদকদের দুটি সংগঠন- নিউজপেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) ও সম্পাদক পরিষদের যৌথ প্রতিবাদ সভায় তিনি এসব কথা বলেন। সোমবার ‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শিরোনামে এই  সভা পরিচালনা করেন দৈনিক বণিক বার্তার সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।

প্রতিবাদ সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, পেশাজীবী সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠন, সাংবাদিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ সংহতি জানাতে আসেন। সভায় দেশের শীর্ষস্থানীয় এই দুই গণমাধ্যম কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন বরেণ্য নাগরিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তাঁরা বলেছেন, এই হামলা কোনো একটি সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে নয়; এটি সরাসরি গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের ওপর আঘাত।

বক্তারা বলেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় দুই সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে যে হামলার ঘটনা ঘটেছে, শুধু গণমাধ্যম নয়, এটি গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত। যারা ‘মবের’ নামে নৈরাজ্য করছে, তাদের ঠেকাতে সরকার কেন তৎপর হয় না, সেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে সমাবেশ থেকে। সভায় বক্তাদের ভাষ্য, এই হামলার ঘটনায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ছিল ‘ভয়ঙ্কর’। প্রতিবাদ সভা থেকে স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষার জন্য ‘ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের’ ডাক দিয়েছেন সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, লেখক, ব্যবসায়ী, নাগরিক ও পেশাজীবী সমাজের প্রতিনিধিরা।

আরও পড়ুন:  রাতে ঘুম না হলে মহানবী (সা.) যে দোয়া পড়তেন

সভা শেষে হোটেলের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। বক্তারা বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা ও গণতন্ত্রের বিকাশে সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং সব পেশাজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ এখন সময়ের দাবি।

সমাপনী বক্তব্যে নোয়াব সভাপতি ও সমকাল প্রকাশক এ কে আজাদ বলেন, সবাই একটা কথা বলেছেন, আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে এটা প্রতিরোধ করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত না ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, ছায়ানট, উদীচীসহ সকল হামলার বিচার না হবে, ততদিন আমাদের আন্দোলন চলবে। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের মতামতের ভিত্তিতে আগামী মাসের মাঝামাঝি বড় আকারের মহাসম্মেলন করাও ঘোষণাও দেন।

প্রতিবাদ সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, সমকাল সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী, আজকের পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কামরুল হাসানসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

আলোচনায় আরও বক্তৃতা করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, মানবাধিকারকর্মী আইরিন খান, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ, ছায়ানট সভাপতি সারোয়ার আলী, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসি) সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান, প্রাণ আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, মেট্টোপলিটান চেম্বা অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান মাশরুর আরেফিন, এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুব উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভুইয়া, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি দৌলত আক্তার মালা। যৌথ সভায় উপস্থিত হয়ে তারা একইসঙ্গে মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করার প্রতিশ্রুতি দেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *