এক.
মুশতারী শফী। যিনি শহীদ জায়া নামে সমধিক পরিচিত। এদেশের একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, উদ্যোক্তা, নারীনেত্রী ও সংগঠক। স্বাধীন বাংলা
বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও শব্দ সৈনিক কবি বেলাল মোহাম্মদের সহযোদ্ধা ও নেপথ্যের কারিগর। ১৯৭১ সালে এপ্রিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মোহাম্মদ শফি ও তার ছোট ভাই এহসান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বেশকিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, ‘চিঠি, জাহানারা ইমামকে’ এবং ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’। এছাড়াও তিনি প্রবন্ধ, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, কিশোর গল্পগ্রন্থ, স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ প্রভৃতি শাখায়ও অবদান রেখেছেন।
অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে লেখা ‘আমি সুদূরের পিয়াসী’, স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ, ‘স্মৃতিতে অমলিন যারা’, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক
ছোটগল্পের সংকলন ‘দুটি নারী ও একটি মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ ও ‘একুশের গল্প’সহ প্রভৃতি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা লগ্নে শফীর পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কবি বেলাল মোহাম্মদের সহযোদ্ধা হিসেবে তিনি দেশ ও দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। তিনি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সাথেও যুক্ত রয়েছেন।
দুই.
২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কবি বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে সন্দ্বীপ সফরে আসেন। সে দিনের সে নৌ ভ্রমণে আমিও ছিলাম। পুরো পথে মুশতারি
শফি’র সঙ্গে আমি অনেক গল্প করেছি। তিনি গভীর সমুদ্র দেখতে চেয়েছিলেন। বারো আউলিয়ার ভিআইপি কেবিনে আমাদের জায়গা হলেও।
তিনি বদ্ধ ঘরে বসে থাকার মানুষ নন। শীতের সকালে আমাদের সমুদ্র ভ্রমণে নতুন নতুন আনন্দ যোগ করেছিলেন বেলাল ভাই।
ধবধবে সাদা পোশাক, পায়ে নাগড়া, সুন্দর সম্মোহনী দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে আছেন দূরান্তে। সূর্যের আলো এসে পরছে তাঁর গায়ে। যেন মেঘ
আড়াল করে সেই আলো। তাঁর চাহনিতে কি এক অপূর্ব পবিত্র আভা। জাহাজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা বেলাল ভাইকে দেখতে মানুষ ভিড়
জমিয়েছিল। অনেকে বলছেন তিনি কি কোন অভিনেতা? নাকি বিজ্ঞানী। তাঁর বাবরি চুলে সাদা শুভ্র মানুষটি যেন পুরো জাহাজে এক
কৌতূহল সৃষ্টি করেছেন।
নবাবের মত দেখতে লাগছে তাঁকে। এমন সুদর্শন সুপুরুষ সব সময় দেখা যায় না। সেই সঙ্গে গল্পে গল্পে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম।
সাগরের বিশালতার দিকে তাকিয়ে বেলাল ভাই বলছেন ‘এই যে দেখ আকাশ যেন মিলে গেছে দূর সমুদ্রের বাহু বন্ধনে’
মুশতারি শফি আপা আমাকে বললেন-‘তারেক তুমি আমাকে গভীর সমুদ্র দেখাবে। আমি দু’চোখ ভরে সমুদ্র দেখব। বহুদিন সমুদ্রের সামনে
যাওয়া হয় না আমার। এই সমুদ্রের মতই গোপন আমার দুঃখগুলো। এমন অনেক কথায় তিনি বললেন। দুরান্তে তিনি তাকিয়ে যেন কাঁদলেন।
মনে হচ্ছিল তাঁর হৃদয়ের দুঃখগুলো কেবল এই সমুদ্রই ধারণ করতে জানেন। তাই হয়তো সমুদ্র দেখার এমন ইচ্ছে তাঁর।’
জাহাজে উঠার পর ওনাকে যেহেতু দিয়েছি, তাই কর্ণফুলী থেকে জাহাজ বের হতেই তাঁকে সমুদ্র দেখানোর জন্যে ডাকলাম। কর্ণফুলীতে তখন
জোয়ার। সাগরের স্ফুটিক জলের স্বচ্ছ জলরাশিগুলো জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আঁচড়ে পরছে দু’পাশে। সাদা বকের একঝাঁক উপস্থিতি আমাদের
আনন্দের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখছিলাম। সকাল গড়িয়ে দুপুর, জাহাজ ভেসে চলছে সন্দ্বীপের দিকে। দীর্ঘ
৫ ঘণ্টা পর জাহাজ পৌঁছে গেল সন্দ্বীপের রহমতপুর ইস্টিমার ঘাটে। জাহাজ থেকে সন্দ্বীপের ভাঙ্গন এলাকা দেখে মুশতারি আপা দুঃখ করলেন।
আর বললেন এভাবেই জনপদগুলো একদিন ভেঙ্গে যায়।
জাহাজ থেকে নেমে মুশতারি আপা মাটিতে খালি পায়ে হাঁটলেন। এরপর হাত দিয়ে নরম মাটি হাতে নিয়ে নিজ কপালে ঘষে দিয়ে বললেন- এই
মাটি অনেক পবিত্র- এই মাটি বেলাল ভাইকে ধারণ করেছে। এই মাটিতে জন্মেছেন কমরেড মুজফফর, বিপ্লবী লাল মোহন, আব্দুল হাকিম।
বেলাল ভাইয়ের এত কাছে থেকেও এখানে এত দেরীতে এলাম। সত্যি আজকে ধন্য হলাম। এখানে এসে আমার ভীষণ ভাল লাগছে। এরপর
তিনি বেলাল ভাইয়ের বাড়িতে গেলেন। এর দু’দিন পর ‘লালমোহন-মুজাফফর’ ওয়ার্কশপের অধীনে বৃত্তি পরীক্ষার আয়োজন করলেন। সন্দ্বীপের
২৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী এতে অংশ নিয়েছিল।
মুশতারি শফি গতকাল ২০ ডিসেম্বর না ফেরার দেশে চলে গেছেন। গতকাল মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সেদিনের সন্দ্বীপ ভ্রমণের মুহূর্ত গুলো
থেকে থেকে মনে পরছিল। এছাড়া সন্দ্বীপে থাকাকালিন সময়ে তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সঙ্গে ছিলাম। কত গল্প স্বল্পে তাঁর নিবিড় সান্নিধ্য
আমাকে শাণিত করেছিল। তাঁর জীবনের গল্প, একাত্তরের গল্প শুনে ছিলাম। এত সিংধ হেসে তিনি আমাকে শুনালেন দুঃখ জাগানিয়া সেসব
দিনের কত কথা। তাঁর পরিবারের অন্য দুজন সদস্যও ছিল। তাঁর ছেলে ও ছেলের বউ।
তিন.
স্বাধীনতা পদক পাওয়ার পর সন্দ্বীপ ফ্রেন্ডস সার্কেল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ওনাকে সংবর্ধনা দেওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি সংকোচ বোধ
করলেন। তাঁর বিনয় দেখে বুঝতে বাকি ছিল না তিনি এতদিন কেন অগোচরে থেকেছিলেন। পরে তিনি আমার আহ্বানে তিনি জীবনের
জয়গানে সামিল হতে জন্মভূমি সন্দ্বীপে এসেছিলেন। তিনি আমাদের ভালবাসার যথার্থ মূল্যায়ন করেছিলেন। ২০১০ সালের ১৮ নভেম্বর তিনি নৌপথে সন্দ্বীপ আসেন। এরপর ২০ নভেম্বর তাকে সন্দ্বীপ পাবলিক হাই স্কুলে তাকে নাগরিক সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। বন্ধুবৎসল এই মানুষটি নিজেকে আমাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সেই অর্থে তিনি আমাদের বন্ধু। তাঁর আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠে তিনি আমাদের শ্রেয়তম বন্ধু হিসেবে ঘোষণা করে গেছেন। তাঁর
সেই বিশুদ্ধ উচ্চারন প্রাণে প্রাণে ঐকতান জাগিয়েছিল। বেলাল ভাইয়ের মত একজন বিদগ্ধ মানুষ আমাদের সংগঠনকে তরুণদের প্রধানতম
প্লাটফর্ম হিসেবে দেখেছিলেন। তাঁর ভালোবাসা আর আন্তরিক অংশগ্রহণ আমাদেরকে নতুন পথ দেখিয়েছিল। যা এখনও স্মরণ করি।
২০১০ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতা পদক পাওয়ার পর থেকে মৃত্যুদিন পর্যন্ত ওনার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে যুক্ত ছিলাম। অল্প বয়সী তরুণদের
মধ্যে আমি এক মাত্র তরুণ যাকে বেলাল ভাই সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন। ওনার অবসর মুহূর্তে, রোগে- শোকে আমার উপস্থিতি দেখে তিনি
আমোদিত হতেন। তিনি আমাকে নিয়ে লিখেছেন। নামের আগে শ্রীমান দিয়েই সম্বোধন করতেন। এমন প্রাপ্তি আমার জুড়িকে শক্ত করেছে। তাঁর
লেখায় আমার প্রতি হৃদয় উজার করা ভালোবাসার কথা উঠে এসেছে। তিনি প্রাণ প্রাচুর্য দিয়ে আমার প্রশংসা করে গেছেন। বড্ড আপন মনে করতেন। আমার অন্তর মানস গড়ে দিয়েছেন তিনি। ওনার মোহনিয় সান্নিধ্যে এসে আমি অনেক কিছুই শিখেছি। আমার উপলব্ধির জায়গাটা আনন্দ উচ্ছ্বাসে ভরিয়ে দিয়েছেন। বিশ্বাসের শূলতে জ্বেলে তিনি মানবিক জীবনের দীক্ষা দিয়ে গেছেন।
লেখক, সংগঠক, সাংবাদিক।







