কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ (কাকাবাবু)
জন্মঃ,আগস্ট ৫, ১৮৮৯, মুসাপুর, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম জেলা, ব্রিটিশ ভারত।
মৃত্যুঃ ডিসেম্বর ১৮, ১৯৭৩ (৮৪ বছর), কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
আন্দোলনঃ কমিউনিস্ট আন্দোলন, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন।
প্রধান সংগঠনঃ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি।
উপমহাদেশের যে কোন রাজনীতি সচেতন মানুষ তাকে কাকাবাবু নামেই চেনেন। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত, পথিকৃৎ, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী কমরেড মুজফফর আহমদ। শুদ্ধাচারী রাজনীতিক হিসেবে তিনি উপমহাদেশে একটি স্বতন্ত্র ও সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করেছিলেন।
মুজফফর আহমদ ১৮৮৯ সালের আগস্ট মাসের ৫ তারিখ সোমবারে অবিভক্ত বাংলার বর্তমান চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভুক্ত বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপের মুসাপুর গ্রামে এক দরিদ্র কিন্তু অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
নিজের জন্ম তারিখ সম্পর্কে মুজফফর আহমদ লিখেছেন, ‘বাংলা ১২৯৬ সালের শ্রাবণ মাসের কোন এক সোমবারে আমি এই দ্বীপের মুছাপুর গ্রামে জন্মেছি। আমাদের দরিদ্র পরিবারের কারুরই জন্মবার্ষিকী পালিত হত না। আমার জন্ম তারিখও কোন দিন পালিত হয়নি। তাই জন্মের তারিখ আমার মনে নেই, মায়ের মুখে শুনে শুধু সাল, মাস ও বারের কথাই আমার মনে আটকে রয়েছে। ১২৯৬ সালের শ্রাবণ মাসের ৭ই, ১৪ই, ২১শে ও ২৮শে তারিখ সোমবার ছিল। খ্রিস্টীয় সনের হিসাবে এই তারিখগুলি ১৮৮৯ সালের ২২শে জুলাই, ২৯শে জুলাই, ৫ই আগস্ট ও ১২ই আগস্ট। এই চারটি তারিখের মধ্যে কোনটি ছিল আমার প্রকৃত জন্ম দিন তা জানার আর কোন সম্ভাবনা নেই। সাধারণত আগস্ট মাসকেই আমি আমার জন্মের মাস বলে থাকি।’ পরে মুজফফর আহমদ ৫ আগস্টকে নিজের জন্মদিন বলে মনস্থির করেন।
তার বাবার নাম মনসুর আলি এবং মা’র নাম চুনাবিবি। চুনাবিবি তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন। মনসুর আলি সন্দ্বীপের এক স্বল্প আয়ের মোক্তার ছিলেন। তার দাদা নাম ছিল মুহম্মদ কায়েম আর নানার নাম ছিল ইরশাদ আলী ঠাকুর। পারিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় কৈশোরে মুজাফফর আহমদকে চাষাবাদের কাজেও সাহায্য করতে হয়েছিল। তার অগ্রজ তিন সহোদর ভাই মহব্বত আলী উকিলের মোহরার, মকবুল আহমদ স্কুল শিক্ষক ও খুরশিদ আলম জমিদারি এস্টেটের কেরানি ছিলেন। কমরেড মুজফফর আহমদ এর জীবদ্দশায়ই তাদের মৃত্যু হয়। বহির্মুখী মুজাফরর আহমদকে গৃহমুখী করার উদ্দেশ্যে পারিবারিক চাপ প্রয়োগে ১৯০৭ সালে তাকে বিয়ে দেওয়া হয় ১৮৭০ সালে সন্দ্বীপে সংঘটিত কৃষক জনতার অসহযোগ আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ নেয়ামস্তির চানমিয়া মুন্সীর মেয়ে হাফেজা খাতুনের সাথে । নিয়মিত সাংসারিক জীবন তিনি পালন করেননি। ১৯৩৫ সালে নজরবন্দি থাকার সময় ১৪ বছর পর পরিবারের সাথে দেখা হয়। এ সময় তিনি তার একমাত্র কন্যা আফিফা সুলতানার সাথে কবি, সাহিত্য-সমালোচক ও ছান্দসিক আবদুল কাদিরের সঙ্গে সন্দ্বীপে বিয়ে দেন। মুজফফর আহমদের দুই নাতি ও এক নাতনি। নাতনির নাম সুলতানা কাদির ঢাকা কলেজে ইংরেজি বিভাগের প্রধান ছিলেন, এখন অবসরে। প্রয়াত এক নাতির নাম দারা শিকোহ। যিনি তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষক ছিলেন। আরেক নাতির নাম মুরাদ।
মুজফ্ফর আহমদ তার লেখা ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ বইতে নিজেকে অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান বলেছেন। তিনি বলছেন, বাবা মোক্তারি করতেন বটে, তবে ভূসম্পত্তি তেমন কিছু করতে পারেননি। অর্থাভাবে তাঁর পড়াশোনা চালানো কঠিন ছিল। এই দারিদ্র্য তার মধ্যে সাম্যবাদী চিন্তার জন্ম দিয়েছিল। তাই তিনি ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির আঁতুড়ঘরে লাল ঝাণ্ডা নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন। রাজনীতির ধারাক্রম বিবেচনায় এই বিপ্লবীর জন্ম ও বেড়ে ওঠার সঙ্গে তার শ্রেণী চরিত্র গঠিত হয়েছে, এতে বিভ্রান্তির কোন অবকাশ নেই।
মুজাফফর আহমদ তার শিক্ষা জীবন শুরু করেন বাংলা ভাষা শিক্ষার দ্বারা। ১৮৯৭ সালে তিনি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৮৯৯ সালে তিনি হরিশপুর মিডল ইংলিশ স্কুলে (পরে কাগিল হাইস্কুল) ভর্তি হন। পিতার মোক্তারি ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর স্কুল থেকে তার নাম কেটে দেওয়া হয়। সে সময় মাদ্রাসা শিক্ষা অবৈতনিক হওয়ায় তিনি মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯০৫ সালে পিতার মৃত্যুর সময় তিনি নোয়াখালীর বামনী মাদ্রাসায় পড়ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর মুজাফফর আহমদ কিছুকাল বরিশালে গৃহশিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি আবার নিজ গ্রামে ফিরে কার্গিল হাই স্কুলে ভর্তি হন। সন্দীপের কার্গিল হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। ১৯১০ সালে তিনি কাগিল হাইস্কুল ছেড়ে নোয়াখালী জেলা স্কুলে চলে যান। ১৯১৩ সালে সেখান থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় (ম্যাট্রিকুলেশন) পাশ করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার পরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯১৩ সালে কলকাতা আসেন। হুগলি মহসিন কলেজে তিনি দু-তিন মাস আই এ ক্লাসে পড়াশোনা করেন, পরে বঙ্গবাসী কলেজেও কিছুকাল পড়াশোনা করেন, এ কলেজ থেকে আই এ পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন এবং সেখানেই তার লেখাপড়ার ইতি ঘটে। কলেজ ছাড়ার পর বাংলা সরকারের অনুবাদ দপ্তরে কিছুদিন উর্দু থেকে ইংরেজি অনুবাদক এর কাজ করেন। জীবিকার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চাকরি নিতে বাধ্য হন।
১৯১৩ থেকেই তিনি কলকাতার অধিবাসী।সন্দ্বীপের কাগিল হাইস্কুলে পড়ার সময়ই মুজাফফর আহমদের সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি হয়। মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক সুলতান’ পত্রিকায় সন্দ্বীপের স্থানীয় খবর পাঠাতেন।
প্রবেশিকা পরীক্ষার পরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সর্বভারতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠাকালে ভারতের এই প্রথম রাজনৈতিক সংগঠনকে অসাম্প্রদায়িকই ভাবা হয়েছিল। হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ই ছিল কংগ্রেসের নেতৃত্বে। বঙ্গভঙ্গ ইস্যু প্রথমবারের মতো হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে। যেহেতু অনুন্নত পূর্ব বাংলা বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলে উন্নতির ছোঁয়া পাবে—এই আশা করেছিলেন পূর্ব বাংলার নেতারা, সেহেতু বঙ্গভঙ্গের সমর্থক হন তারা। পূর্ব বাংলার বেশির ভাগ মানুষ মুসলমান। তাই অনেকটা চিহ্নিত হয়ে গেল যে বঙ্গভঙ্গের সমর্থকগোষ্ঠী মুসলমান সম্প্রদায়। কিন্তু কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষিত হিন্দু গোষ্ঠী একে দেখল ভারতীয়দের বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র হিসেবে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলার হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায় তাকিয়ে ছিল কংগ্রেসের দিকে। এই অসাম্প্রদায়িক সংগঠন নিশ্চয় বঙ্গভঙ্গ ইস্যুতে উভয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করবে। কিন্তু মুসলমান নেতারা বিস্মিত হয়ে দেখলেন, কোনো রকম পূর্বালোচনা ছাড়াই কংগ্রেস বঙ্গভঙ্গবিরোধীদের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছে। বাংলা তথা ভারতীয় রাজনীতিতে এ অবস্থায় তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
তরুণ মুজফ্ফর আহমদ কাছে থেকে এই উত্তেজনা লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ হিসেবে তাকে এসব আলোড়নে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। পূর্ববঙ্গের মুসলিম নেতৃত্বের পুরোভাগে তখন ঢাকার নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ। কংগ্রেসের আচরণে মুসলমান নেতারা অসহায় বোধ করলেন। কংগ্রেসকে আর অসাম্প্রদায়িক সংগঠন ভাবতে পারলেন না। তাই মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে কথা বলার জন্য স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গড়ার কথা ভাবতে হলো। এভাবেই বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার পরের বছরই, অর্থাৎ ১৯০৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হলো মুসলিম লীগ। কিন্তু এসব সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন রাজনীতি কোনো আলোড়ন তুলতে পারেনি মুজফ্ফর আহমদের মনে। বরং বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গভঙ্গবিরোধী গোষ্ঠী যখন বয়কট, স্বদেশি ও গুপ্ত সংগঠন গড়ে সশস্ত্র সংগ্রাম করে, তা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল মুজফ্ফর আহমদের। তার বিপ্লবী মানস গড়ায় এই পরিবেশের প্রভাব ছিল বলেই মনে হয়। ১৯১১ সালে বিপ্লবীদের চাপে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করলে আরেকবার আলোড়িত হয়েছিলেন মুজফ্ফর আহমদ। কারণ তার লেখা থেকেই জানা যায়, স্বদেশি যুগের নেতা সাপ্তাহিক ‘হিতবাদী’ পত্রিকার সম্পাদক কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ তাকে কিছুটা প্রভাবিত করেছিলেন। মুজফ্ফর আহমদ তার দারিদ্র্যের কথা বারবার উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, এ সময় তিনি যথাসাধ্য স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহার করতেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাবে তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে আকৃষ্ট হন। প্রগতিশীল সাহিত্যের দিকে সবসময়ই তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। ১৯১১ সালে কলকাতায় অবস্থানরত বিভিন্ন মুসলিম ছাত্রের উদ্যোগে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি গঠিত হয়। কলকাতার ৩২ কলেজ স্ট্রিটে এ সাহিত্য সমিতির অফিস ছিল। ১৯১৮ সালে সমিতির উদ্যোগে বের হয় “বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা”। তিনি ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা সমিতি’তে যোগদান করেন। ১৯১৮ সালে সমিতির সব সময়ের কর্মী হিসেবে তিনি এর অফিসেই থাকা শুরু করেন। তিনি ছিলেন সমিতির সহকারী সম্পাদক। পত্রিকার কাজ পরিচালনার সময় চিঠিপত্রের মাধ্যমে তার কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে পরিচয় হয়। করাচির সেনানিবাস থেকে নজরুলের পাঠানো কবিতা ও গল্প এই পত্রিকায় প্রকাশিত হত। ১৯২০ সালের শুরুর দিকে ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হলে নজরুলের সৈনিক জীবনের অবসান ঘটে এবং তিনি কলকাতায় মুজাফফর আহমদের সাথে সাহিত্য সমিতির অফিসে থাকতে শুরু করলেন। এখান থেকেই দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। আমৃত্যু তা বজায় ছিল।
সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদানের পূর্বে মুজাফফর আহমদ কিছুদিন চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন। বাংলা সরকারের ছাপাখানায় মাসিক ত্রিশ টাকা বেতনে তিনি চাকরি করেছিলেন। বাংলা সরকারের অনুবাদ বিভাগেও তিনি মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনে একমাস উর্দু থেকে বাংলায় অনুবাদ করার কাজে চাকরি করেন। একমাস তিনি প্রেসিডেন্সি বিভাগের স্কুলসমূহের ইনস্পেক্টর হিসেবেও কাজ করেন। কলেজে পড়ার সময় খিদিরপুর জুনিয়র মাদ্রাসায় তিনি শিক্ষকতা করেন আর একমাস ছুটিতে তিনি কলকাতা সিটি কর্পোরেশনে কাজ করেন। ১৯০৬ সাল থেকে ১৯০৮ সালের অধিকাংশ সময় তিনি কোন না কোন লোকের বাড়িতে গৃহশিক্ষকতা করে থাকা খাওয়া অথবা অর্থ রোজগার করতেন।
কৈশোরে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলেও ১৯১৬ সাল থেকে মুজাফফর আহমদ বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক আলোচনা, সভা-সেমিনার-মিছিল যোগদান প্রভৃতি শুরু করেন। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কলকাতার অনুষ্ঠিত আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯২০ সালে বঙ্গীয় খেলাফত কমিটির সদস্য মনোনিত হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
মুজাফফর আহমদের ছাত্রাবস্থায় বাংলায় সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের শুরু হয়। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন শুধু হিন্দু আন্দোলন ছিল না, আসলে তা ছিল বর্ণ হিন্দুদের আন্দোলন। তার মতে, একধরনের রোমাঞ্চের জন্য শিক্ষিত যুবকেরা এতে অংশ নিলেও এর পিছনে ছিল একটা গভীর নৈরাশ্য। যদিও তিনি এই আন্দোলনের জন্য জীবন উৎসর্গকারীদের শ্রদ্ধা করতেন। অন্যদিকে মুসলীম লীগ ও কংগ্রেসকে তিনি ধনীক শ্রেণীর স্বার্থে ধনীক শ্রেণীর রাজনৈতিক দল বলে মনে করতেন। কংগ্রেসের ঘোষণাপত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা থাকলেও এ দল ধীরে ধীরে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিশ্বাসী নেতাদের কর্তৃত্বাধীন হয়ে পড়ে। মুসলিম লীগের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে অসাম্প্রদায়িক হলেও ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতেন। মূলতঃ ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে হিন্দু সুবিধাভোগী শ্রেণীর একাধিপত্যকে রোধ করার জন্যই মুসলিম সুবিধাভোগী ও ভোগেচ্ছুদের রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের জন্ম হয়।
তার পিতার পেশা মোক্তারি হলেও তার পরিবার ছিল মূলতঃ কৃষক পরিবার। তাছাড়া তাদের গ্রামের অর্থনীতিও ছিল কৃষিভিত্তিক। কলকাতা জীবনের শুরু থেকেই নাবিকদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণে শ্রমিক শ্রেণীর দুঃখ-দুর্দশার সাথে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। সে সময় সন্দ্বীপের অনেক লোক কলকাতা বন্দরে কাজ করতেন। আধুনিক শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার আকর্ষণ এবং বুদ্ধিজীবীদের সাহচর্য লাভ তাকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও কৃষক-শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির রাজনীতিতে আগ্রহী করে তুলেছিল। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের সাফল্য তাকে উদ্দীপ্ত করে। ১৯২১ সাল থেকে তিনি মার্কসবাদ চর্চা ও মার্কসবাদী রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লব এর প্রভাব পড়ে সারা বিশ্বে। ১৯২০ সালে তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় অধিবেশনে লেনিনের নেতৃত্বে ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে বিপ্লবের কর্মসূচি গৃহীত হয়। এরপর চিনে ও ভারতবর্ষে বৈপ্লবিক আন্দোলন, স্বাধীনতার সংগ্রাম তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯২১ সালে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন এবং শ্রমিক-কৃষকের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আন্দোলন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে তুলেছিল। ১৯২০ সালে ব্রিটিশ ভারতে খেলাফত আন্দোলনের সমর্থনে বিশেষ করে তুরস্কের খিলাফত এবং উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রতি সমর্থন জানানোর জন্য বঙ্গীয় খেলাফত কমিটির সদস্য মনোনিত হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯২০সালে ভারতের শ্রমিক সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ করে গঠিত হয় অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস।এই সময় থেকে মুজফফর আহমদের জীবনেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। ১৯২০ সালের শুরুতে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে রাজনীতিই হবে তার জীবনের মূল পেশা। ১৯২১ সালের শুরুতে দেশত্যাগী ভারতীয় মোহাজীর বিপ্লবীদের নিয়ে মধ্য এশিয়ার তাসখন্দে এবং পরে মস্কো শহরে ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। অবিভক্ত বাংলায় তিনিই প্রথম পার্টির সদস্য। কমরেড মুজাফফর আহমদের সঙ্গে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের যোগসূত্র স্থাপিত হয়। ১৯২০ সালেই তিনি সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী হবার সিদ্ধান্ত নেন। মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা ত্যাগ করে নজরুল ও অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং রুশ বিপ্লবের আদর্শে শ্রমিক-কৃষকের বৈপ্লবিক আন্দোলন গঠনে আত্মনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে মুজফফর আহমদ ও নজরুল ইসলামের উদ্যোগে এ কে ফজলুল হকের অর্থানুকূল্যে ‘নবযুগ’ নামে একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা বের করেন।’নবযুগে’র যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন মুজফফর আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলাম। মার্কুইস লেনের একটি বাড়ির ঘরে দুজনেই থাকতেন। পরে মুজফফর আহমদ ৩/৪ সি তালতলা লেনের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন।এখানেই তাঁর সঙ্গে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। খিদিরপুরে জাহাজের খালাসিদের সঙ্গেও তিনি যোগাযোগ রাখতেন, বিভিন্ন শ্রমিক সভায় যোগ দিতেন। গোড়া থেকেই তিনি শ্রমিকদের সংগঠিত করা এবং কমিউনিস্ট মতবাদ প্রচারের সচেষ্ট হন। ভারতে কমিউনিস্ট আদর্শ প্রকাশ ও প্রচার তখন নিষিদ্ধ ছিল। গোপনে তিনি কমিউনিস্ট পুস্তকাদি ও পত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে গোপনে কমিউনিজমের প্রচার আরম্ভ করেন।
সহায়-সম্বলহীন কঠোর জীবন তাকে যাপন করতে হচ্ছিল। একদিকে প্রচন্ড অর্ধাহার, অনাহার, দুঃখ-কষ্টের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অন্যদিকে সর্বক্ষণ পুলিশের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে প্রচার কাজ চালানোর কঠিন কাজ তাকে করতে হয়। থাকবারও কোন নির্দিষ্ট বাসস্থান ছিল না। এই সময় তাঁর একমাত্র ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ছিলেন কমরেড আব্দুল হালিম। কমরেড মুজফফর আহমদ বোম্বাইয়ে ডাঙ্গে এবং অন্যান্য প্রদেশের সমমতাবলম্বী বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করেন। ‘নবযুগ’ পত্রিকায় শ্রমিকদের জীবন,সমস্যাবলী এবং সংগ্রাম নিয়ে তিনি অনেক প্রবন্ধ লেখেন। ১৯২২ সালে কাজী নজরুল ইসলাম অর্ধসাপ্তাহিক ‘ধুমকেতু’ বের করেন। ‘দ্বৈপায়ন’ ছদ্মনামে মুজফফর আহমদ ভারতের রাজনৈতিক সমস্যাবলী নিয়ে অনেক প্রবন্ধ লেখেন এতে।
কমিউনিস্ট মতবাদ প্রচারের স্রাোত আটকাতে ব্রিটিশ সরকার আরও তৎপর হয়ে ওঠে। ১৯২২ সালের শেষে গয়া কংগ্রেসের অধিবেশনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচি সংবলিত এক সুদীর্ঘ ইশতেহার প্রচারিত হয়। এর আগে ১৯২১ সালে আমেদাবাদ কংগ্রেসেও এক ইশতেহার প্রচারিত হয়। এতে শঙ্কিত হয়ে ওঠে ব্রিটিশ সরকার। ১৯২৩ সালে মোহাজীর বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে পেশোয়ারের দায়রা আদালতে বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হয়। তাদের বিরুদ্ধে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দায়ের করা হয়। এসবের ফলে গোপনে কাজ করাও মুজফফর আহমদ এর পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। ১৯২৩ সালের মে মাসে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। মার্কসীয় সাহিত্য পত্রিকা এবং বই উদ্ধারের জন্য পুলিশ এসময় বিভিন্ন জায়গায় খানাতল্লাশি চালায়।
১৯২৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ভারত সরকার মুজফফর আহমদ, ডাঙ্গে প্রমুখের নামে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দায়ের করে। এজন্য মুজফফর আহমদ কে নিয়ে যাওয়া হয় কানপুর জেলে। এছাড়া অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন ওসমানী ও নলিনী গুপ্ত। এটি কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা নামে খ্যাত। চৌরিচৌরা মামলায় একদিকে ১৭২ জন কৃষকের ফাঁসির হুকুম হয়। কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় মুজফফর আহমদসহ সকলের চার বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। কয়েকজন অভিযুক্তকে সরকার কোর্টে হাজির করতে পারেনি। কিন্তু এই মামলার বিবরণের মধ্য দিয়ে সংবাদপত্রের মাধ্যমে মানুষ কমিউনিস্ট আন্দোলনের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারেন। সাধারণ কয়েদী হিসেবে মুজফফর আহমদকে পাঠানো হয় উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলি জেলে। এখানে তিনি যক্ষা রোগে আক্রান্ত হন ফলে দন্ডকাল শেষ হবার আগেই তিনি মুক্তি পান।
১৯২৫ সালে কানপুরের জনৈক সত্য ভক্ত প্রথম প্রকাশ্য কমিউনিস্ট সম্মেলনের নামে প্রস্তুতি হিসেবে দুটি ইশতেহার প্রকাশ করেন। এ বছরের ২৬ ডিসেম্বর কানপুরে এই সম্মেলন ডাকা হয়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কলকাতা ফেরার পথে মুজাফফর আহমদ এই সম্মেলনে যোগ দেন। সত্য ভক্ত আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট মতবাদ ও আন্দোলনের বিরুদ্ধেই ছিলেন, জাতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গঠনই ছিল তার মুখ্য উদ্দেশ্য। সত্য ভক্তের চেষ্টা সম্মেলনে ব্যর্থ হয়। বোম্বাইয়ের ঘাটে নবগঠিত কমিউনিস্ট পার্টির যুগ্ম সম্পাদক হন কাকাবাবু। এখানেই ঘাটের সঙ্গে মুজফফর আহমদ এর পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়। কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য অফিস বলতে তখন শুধু দিল্লিতে চাঁদনী চকে একটা তৈরি হয়েছিল। তবে এই অফিসের কোনো ভূমিকা ছিল না। পরে এই অফিস উঠেও যায়।
এসময়ে কমরেড মুজফফর আহমদ এর উদ্যোগে বোম্বাই ও কলকাতায় কমিউনিস্টদের নিয়ে একটি পার্টি কমিটি গঠিত হয়েছিল। পরবর্তী সময় তারাই ‘শ্রমিক কৃষক দলে’র ভেতর দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির নীতি কার্যকর করে তোলেন। কানপুর সম্মেলনে মুজফফর আহমদ যখন বোম্বাইয়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের পরিকল্পনা ব্যস্ত ছিলেন সেই সময় ১৯২৫ সালের পয়লা নভেম্বর কলকাতায় ‘লেবার স্বরাজ পার্টি অফ দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ নামে নতুন একটি পার্টি জন্মলাভ করে।
পার্টির মুখপত্র হিসেবে নজরুল ইসলামের পরিচালনায় প্রকাশিত হয় ‘লাঙল’। মুজফফর আহমদ কানপুর থেকে ফিরে এসে ‘লাঙল’ পত্রিকা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কমরেড আব্দুল হালিমও তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। কমরেড হালিমের সঙ্গে ১৯২২ সাল থেকেই মুজাফফর আহমদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়। কয়েক মাস পর পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর লাঙলের নাম পরিবর্তন করে প্রকাশিত হয় ‘গণবাণী’। সম্পাদক হিসেবে গঙ্গাধর বিশ্বাসের নাম থাকলেও প্রকৃত সম্পাদক ছিলেন মুজফফর আহমদ। মার্কসবাদ ও বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে বহু নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এখানেই ‘ইন্টারন্যাশনাল’ সঙ্গীত এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। মুজফফর আহমদ এর উপরেই ছিল পত্রিকার প্রধান দায়িত্ব। অর্থাভাবে মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে যেত প্রকাশনা। সে যুগের কমিউনিস্ট মতবাদ প্রচারের কেন্দ্র ছিল ‘গণবাণী’। ১৯২৬ সালের মাঝামাঝি কলকাতার বুকে এক বীভৎস হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা সংঘটিত হলো।সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও সম্প্রীতির বাণী বহন করে আবার গণবাণী প্রকাশিত হয়। কমিউনিস্টরাই এই ঐক্যের জন্য ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে বিরাট ভূমিকা নেয়।
১৯২৬ সালের কঠোর পরিশ্রম এবং অর্ধাহারে-অনাহারে মুজফফর আহমদের স্বাস্থ্য আবার ভেঙে পড়ল। ‘গণবাণী’ও বন্ধ হয়ে যায়। স্বাস্থ্যদ্ধারে তিনি যান লাহোরে। সেখানে তিনি মস্কো প্রত্যাগত এবং পেশোয়ার মামলায় দণ্ডিত আব্দুল মজিদের বাড়িতে ছিলেন। কয়েক মাস থেকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের কাজে বোম্বাই চলে আসেন।মুজফফর আহমদের সম্পাদনায় ১৯২৭ সালের গোড়ায় আবার ‘গণবাণী’ প্রকাশ শুরু হয়। ১৯২৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কলকাতায় ভারত সভা হলে শ্রমিক কৃষক দলের দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯২৭ সালের ৩১ মে বোম্বাইয়ে কমিউনিস্টদের এক সম্মেলনে কমিউনিস্ট পার্টির নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। পার্টির কর্মসূচি ও গঠনতন্ত্র গৃহীত হয়। সঙ্গে একটি ইশতেহারও প্রকাশিত হয়। মুজফফর আহমদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। তিনি কার্যকরী কমিটির সদস্য এবং ঘাটে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন।
১৯২৭-২৮ সালে ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলন, বিশেষত শ্রমিক আন্দোলন এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত হয়। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় আন্দোলনও তীব্রতর হয়ে ওঠে। ১৯২৭ সালের মার্চ মাসে কানপুরে এ আই টি ইউ সির অধিবেশনে এবং নভেম্বর মাসে দিল্লি অধিবেশনে কমরেড মুজফফর আহমদ যোগ দেন এবং সংগঠনের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
ক্রমবর্ধমান শ্রমিক সংগ্রাম ও তাতে কমিউনিস্টদের প্রভাব বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ শাসকদের আতঙ্ক বেড়ে যায়। আক্রমণের মাত্রা বাড়তে থাকে।’গণবাণী’ অফিস তল্লাশি করে সমস্ত মার্কসবাদী পত্রপুস্তিকা ও বই বাজেয়াপ্ত করে। ১৯২৭ খড়গপুরে রেলকর্মীদের ধর্মঘট, বৃহৎ শিল্প কারখানায় ধর্মঘট, চটকল শ্রমিকদের ও বন্দর শ্রমিকদের ধর্মঘটে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন মুজফফর আহমদ। ১৯২৭ সালের ডিসেম্বর মাসে মাদ্রাজে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি ও অন্যান্য কমিউনিস্টরা নেতারা যোগ দেন। এখানে শ্রমিক কৃষক দলের পক্ষ থেকে গণপরিষদ বা কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি সম্পর্কে একটি ইশতেহার প্রচারিত হয়। এখানে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন সম্পর্কে কমিউনিস্টদের এক গোপন বৈঠকে তিনি যোগ দেন। উল্লেখ্য যে কমরেড মুজফফর আহমদ ১৯২১-১৯৪৪ সাল পর্যন্ত ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ছিলেন, আবার এআইসিসির সদস্যও ছিলেন তিনি।
১৯২৮ সালে কলকাতা, বাংলা ও দেশব্যাপী অসংখ্য আন্দোলন-ধর্মঘট হয়। সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও সেই সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রত্যেকটি সংগ্রামে তিনি সক্রিয় অংশ নেন। বেতন বৃদ্ধির জন্য কলকাতা কর্পোরেশনের ধাঙ্গড়, মেথর ও ঝাড়ুদারদের ধর্মঘটের নেতৃত্ব দেবার জন্য তিনি গ্রেফতার হন।
১৯২৮ সালের ৩১ মার্চ ২৪ পরগনার ভাটপাড়ায় এই দলের তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এখানে সর্বভারতীয় শ্রমিক কৃষক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। বাংলায় এই দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মুজাফফর আহমদ।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তখন ফ্যাসিজমের উদ্ভব হচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী দেখা দিয়েছে ভয়াবহ আর্থিক মন্দা ও সংকট। ১৯২৮ সালের ১৫ জুলাই থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মস্কোতে চলে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ষষ্ঠ কংগ্রেসের অধিবেশন। এখানে আন্তর্জাতিকের কর্মসূচি, গঠনতন্ত্র ও নিয়মাবলী গৃহীত হয়। ঔপনিবেশীক দেশসমূহে বিপ্লবী মুক্তি আন্দোলন, বিশ্ববিপ্লব ইত্যাদি নিয়ে কর্মসূচি গৃহীত হয়। পরাধীন দেশে বিপ্লবের দিকনির্দেশক পৃথক দলিলও গৃহীত হয়। লেনিন আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে যে মতাদর্শগত সংগ্রাম শুরু করেন এই অধিবেশন তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়।
১৯২৮ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। কলকাতায় ২৭ থেকে ২৯ ডিসেম্বর শ্রমিক কৃষক দলের সর্বভারতীয় সম্মেলনে সর্বভারতীয় শ্রমিক-কৃষক দল গঠিত হয়। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে কমিউনিস্টদের মধ্যে এখানে আলোচনা হয় এবং তা নিষ্ঠার সঙ্গে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়। এখানে ঠিক হয় শ্রমিক-কৃষকের পার্টির বদলে শ্রমিকশ্রেণীর পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করতে হবে।১৯২৯ সালের জানুয়ারীতে কলকাতায় কমিউনিস্টদের আরেক গোপন সভায় নতুন করে গোপন ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ পুনর্গঠিত হয়। এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা নেন কমরেড মুজফফর আহমদ। কিন্তু পুনর্গঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আগেই বিভিন্ন প্রদেশে সরকার দমননীতি শুরু করে। সর্বত্র ট্রেড ইউনিয়ন অফিস, কৃষক সমিতির অফিস, শ্রমিক-কৃষকের অফিসের ওপর আক্রমণ নেমে আসে। ৩২ জন নেতা-কর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তার মধ্যে সবাই কমিউনিস্ট ছিলেন না, কমরেড মুজফফর আহমদ ও অন্যান্য কমরেডরা গ্রেপ্তার হন শ্রমিক-কৃষক দলের অফিস থেকে। ধৃত নেতাদের বিরুদ্ধে ভারত সম্রাটকে ভারত থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়।
তাদের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ১২১ এ ধারায় ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। এটা মিরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা নামে বিশ্ববিখ্যাত। প্রায় চার বছর ধরে এই মামলা চলে। মিরাট আদালতে কমিউনিস্ট বন্দীরা যে দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছিলেন তা এক গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিস্ট দলিল হিসাবে চিরস্মরণীয়। যুক্ত বিবৃতি ছাড়াও প্রত্যেকে পৃথক পৃথক বিবৃতি দিয়েছিলেন। কমরেড মুজফফর আহমদ বলিষ্ঠভাবে কমিউনিস্ট মতবাদ ও ভারতে কমিউনিস্টদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কথা ঘোষণা করেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে কমিউনিজম প্রচারের এই প্রচেষ্টা প্রভূত সফল হয়েছিল। কমিউনিস্টদের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আরো বেড়ে যায়। ব্রিটিশ সরকারের বিচারক মুজাফফর আহমদকেই ভারতে কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্রের মুখ্য আসামি বলে মন্তব্য করে তার যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন। অন্যদের হয়েছিল ৩ থেকে ১২ বছর কঠোর কারাদণ্ড। পরে আপিলে এলাহাবাদ হাইকোর্টের আদেশে তার দণ্ডাদেশ কমিয়ে তিন বছর করা হয়।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার পর প্রচন্ড দমন-পিড়নে শ্রমিক আন্দোলন সাময়িককালের জন্য থমকে যায়। কিন্তু আবার বিরাট বিরাট আন্দোলন ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে নতুন বিপ্লবী শক্তির সমাবেশ হয়। ১৯৩১সালে চিকিৎসার জন্য জামিনে মুক্ত হয়ে মুজফফর আহমদ কিছুদিনের জন্য কলকাতায় আসেন এবং ৪১ নম্বর জাকারিয়া স্ট্রিটে ‘গণশক্তি’ কার্যালয়ে অবস্থান করেন। আব্দুল হালিম, সোমনাথ লাহিড়ী, সরোজ মুখার্জী প্রমুখ ‘গণশক্তি’ অফিস থেকে প্রথমে ‘মার্কসবাদী’ ও পরে ‘গণশক্তি’ পত্রিকা বের করতেন। মুজফফর আহমদ কমিউনিস্ট কর্মীদের পার্টি গঠনের কাজে মূল্যবান পরামর্শ দিতেন। জেল থেকেও নানাভাবে তিনি পরামর্শ পাঠিয়ে সাহায্য করতেন।
তখন বিভিন্ন প্রদেশের পার্টি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৯৩৩ সালের শেষ দিকে আবার নতুন করে সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি পুনর্গঠিত হয়। একটি কেন্দ্রীয় কমিটিও গঠিত হয়। ১৯৩৪ সালের ২৭ জুলাই যাবতীয় কমিটি, শাখা ও গণসংগঠনসহ কমিউনিস্ট পার্টিকে সরকার বেআইনি ঘোষণা করে। অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। কিন্তু কমিউনিস্টরা গোপনে পার্টি গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
কারাদণ্ডের পর কানপুর জেল থেকে তাঁকে ও অন্যান্যদের পাঠানো হয় নৈনি সেন্ট্রাল জেলে। পরে তাকে বাংলার বিভিন্ন জেলে আটকে রাখা হয়। কারাদণ্ড শেষ হলে ফরিদপুর জেল থেকে তিনি মুক্তিলাভ করেন। মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই তাকে আবার বঙ্গীয় ফৌজদারি আইনে গ্রেফতার করে জন্মভূমি সন্দ্বীপে অন্তরীণ রাখা হয়। কয়েক মাস পর মেদিনীপুরের সুতাহাটা থানায় তাঁকে অন্তরীণ রাখা হয়। ১৯৩৭ সালের প্রথম দিকে তিনি মুক্তিলাভ করেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কাজে সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করেন। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী বন্দীদের মুক্তি ও আন্দামানে নির্বাসিত বন্দীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দাবিতে আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশ নেন। ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত বাংলায় পার্টির প্রাদেশিক কমিটিতে তিনি নেতৃত্ব দেন। অন্যান্য প্রদেশে, নেপাল ও বার্মায়ও কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে তিনি প্রত্যক্ষ সহায়তা করেন। এই সময়েও গোয়েন্দা পুলিশ তার গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখতো।
কৃষকদের মধ্যেও নবজাগরণ দেখা যায় এই সময়ে। জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদী সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকরা বিভিন্ন জায়গায় সংগ্রাম করছেন- সারা ভারত কিষান সভা গঠনেও তিনি যথেষ্ট পরিশ্রম করেন। তিনি এর সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষিত হলে ভারতে ব্রিটিশ সরকারও স্বাধীনতা আন্দোলন ও শ্রমিকশ্রেণীর ওপর দমননীতি প্রয়োগ করে। কমিউনিস্ট নেতাদের নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করে। ভারত রক্ষা আইনে পুলিশ ১৯৪০ সালের জানুয়ারী মাসে কলকাতা থেকে মুজফফর আহমদকে বহিষ্কারের আদেশ দেয়। তা অমান্য করলে তিনি গ্রেপ্তার হন। একমাস পর ছাড়া পেলে তাঁর ওপর আবার বহিষ্কারের আদেশ জারি হয়। কিছুদিনের জন্য তিনি আত্মগোপনে যান। যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থার মধ্যে পুলিশের দৃষ্টি এড়িয়ে সমস্ত বিপদের ঝুঁকি নিয়ে তিনি পার্টির কাজ করে যান। গোপনে কাজ করার সময় তিনি “কাকাবাবু” নামে পরিচিত ছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান ভারতের দিকে যখন অগ্রসর হচ্ছিল, তখন হাজার হাজার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দেশপ্রেমিক বন্দী জেলে আটক ছিলেন। যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের যোগদানের ফলে যুদ্ধের প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়। ১৯৪২ সালের জুনে কমিউনিস্ট নেতারা মুক্তি পেতে শুরু করেন, কমিউনিস্ট পার্টির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয়। ১৯৪৩ সালে বোম্বাইয়ে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস হয়। তিনি তাতে যোগ দেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও হন। ১৯৪৫ সালে সারা ভারত কিষান সভার নেত্রকোনা সম্মেলনেও তিনি যোগ দেন এবং সংগঠনের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। চল্লিশের দশকে দমননীতির বিরুদ্ধে, দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষকের বিরাট বিরাট আন্দোলনে, বন্দি মুক্তির আন্দোলনে কাকাবাবু বিরাট ভূমিকা নেন।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশকে দ্বিখন্ডিত করে ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়। কয়েকদিনের মধ্যে কংগ্রেস সরকার সারা ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে, পার্টি বেআইনি ঘোষিত হয়। শত শত নেতা ও কর্মী গ্রেপ্তার হন, পুলিশের গুলিতেও অনেকের মৃত্যু হয়। কাকাবাবুও গ্রেফতার হয়ে ছয়মাস জেলে কাটান। মুক্তির দুইমাস পর আবার গ্রেফতার হন। দমদম জেলে কমিউনিস্ট বন্দিরা সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে দীর্ঘকাল অনশন-ধর্মঘট করেন এই বয়সেও অসুস্থ কাকাবাবু তাতে অংশ নেন। ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি নিবর্তনমূলক আইনে আটক ছিলেন। প্রচণ্ড অত্যাচারে পার্টি খানিকটা দুর্বল হয়। তাছাড়া ভুলভ্রান্তি ও শিথিল আন্তঃপার্টি সংগ্রাম পার্টির দুর্বলতার আরেকটি কারণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিরাট বিরাট বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম হয়েছে, তারমধ্যে তেভাগা আন্দোলন, তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য। দুর্বলতা কাটিয়ে ১৯৫১ সালের সম্মেলনে পার্টি নতুন রাজনৈতিক লাইন গ্রহণ করে।এই সম্মেলনে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিতে ও পলিট ব্যুরোতে নির্বাচিত হন।
১৯৫২ সালে ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তিনি যথেষ্ট পরিশ্রম করেন। জেল থেকে তাঁর মুক্তির কিছু আগে ‘স্বাধীনতা’ পুনঃপ্রকাশিত হয়। ‘স্বাধীনতা’র নিজস্ব মেশিন ও ‘গণশক্তি’ প্রেস গঠনের জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। ১৯৫১- ৫২ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৩ ও ১৯৫৬ সালে পার্টির মাদুরাই ও পালঘাট কংগ্রেস কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি যোগদান করেন। ১৯৫৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির অমৃতসর বিশেষ অধিবেশনে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬০ সালে নব পর্যায়ে আট পৃষ্টার ‘স্বাধীনতা’ প্রকাশের জন্য তিনি প্রাণান্ত পরিশ্রম করেন। ১৯৫৭ ও ১৯৬২ সালের সাধারণ নির্বাচনেও তিনি পার্টির কাজ খুঁটিনাটি দেখতেন। ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন পরিচালনায়ও তিনি নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন।
১৯৬১ সালে বিজওয়াদা কংগ্রেসে, ১৯৬৮ সালে কোচিন কংগ্রেসে তিনি যোগ দেন। ১৯৭২ সালে মাদুরাইতে নবম কংগ্রেসে তিনি যোগদান করতে পারেননি।
১৯৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধের সময় তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৬৩ সালে দমদম জেল থেকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অপারেশনের জন্য তিনি স্থানান্তরিত হন। হাসপাতাল থেকে তাকে মুক্তি দেবার আদেশ আসে।
এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মাঝে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে মতভেদ ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনেও মতভেদের সৃষ্টি করে। ১৯৬৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। মুজফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন অংশের নাম দেওয়া হয় সিপিআই (এম) বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)। মার্কসবাদী কমিউনিস্টরা অন্ধভাবে মস্কোকে অনুসরণ না করার নীতি গ্রহণ করেন।
১৯৬৯ সালে সশস্ত্র কৃষক অভূত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের ঘোষণা দিয়ে চারু মজুমদার, কানু স্যান্যাল, প্রমুখের নেতৃত্বে গঠিত হয় সিপিআই (এম-এল) বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। এরা প্রধানত মাও সে তুং (মাও জে ডং) ও চীনের লাইনের অনুসারী। মুজফফর আহমদ এই সময়েও মস্কো ও পিকিং-এর অন্ধ অনুসরণের বিরোধিতা করেন।
আদর্শগত কারণে পার্টি থেকে যাদের বের করে দেওয়া হত, তারা যেন ভুল শুধরে আবার ফিরে আসেন, এ ব্যাপারে মুজফফর আহমদ খুবই আগ্রহী ছিলেন। তিনি বলতেন, “কমরেডরা ভুলে যান যে একজনকে বহিষ্কার করতে লাগে কয়েক মিনিট, কিন্তু পার্টিতে আনতে লাগে কয়েক বছর। আমাদের চেষ্টা করতে হবে যারা ভুল পথে গেছেন তারা যাতে আবার সঠিক পথে আসেন।”
১৯৬৪ সালের প্রথমে পার্টির জাতীয় পরিষদ থেকে ৩১ জনের সঙ্গে তিনিও বেরিয়ে আসেন এবং সংশোধনবাদীদের বর্জন করার জন্য পার্টি সভ্যদের কাছে আবেদন করেন।
১৯৬৪ সালে পার্টি কংগ্রেসের প্রাক্কালে তিনি আবার গ্রেপ্তার হন। জেলে থাকার সময় অসুস্থতা ও নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে তিনি ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ বইটি রচনা করেন এবং দমদম জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় সেটি প্রকাশিত হয়। ১৯৬৬ সালে তিনি মুক্তি পান।
অসুস্থতার কারণে দৈনন্দিন সাংগঠনিক কাজে নিয়মিত সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা তার পক্ষে আর সম্ভব ছিল না। তিনি লেখার মধ্যেই নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে তার ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রকাশিত হয়। এর ইংরাজি অনুবাদও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯৬৮ সালে সিপিআই (এম) -র বর্ধমান প্লেনাম ও বড়শুলে কৃষক সম্মেলনে অংশ নেন।
১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রতিষ্ঠার সময় ব্রিগেডের জনসমাবেশেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার কাজী নজরুল ইসলামকে রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গনে যে বিরাট সংবর্ধনা দেন, মুজফফর আহমদ সেখানেও উপস্থিত ছিলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সিপিআই (এম) পূর্ণ সমর্থন দেয়। ঐ দিনগুলোতে পার্টি মুখপত্র ‘গণশক্তি’র দৈনন্দিন সংবাদ সমালোচনা ও সম্পাদকীয় মতামতে তার স্বাক্ষর মেলে। মুজাফফর আহমদের লেখেন, “পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচার হতে মুক্ত হবার জন্য বাংলাদেশের মানুষেরা যেভাবে সংগ্রাম চালিয়েছেন, তার তুলনা দুনিয়ার ইতিহাসে কম। আমি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমি একজন অক্ষম অসমর্থ বৃদ্ধ, যদি আমার শরীরে শক্তি থাকত, তাহলে আমিও বাংলাদেশের মুক্তিফৌজে যোগ দিতাম।”
‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’-র দ্বিতীয় খণ্ডের জন্য লেখা তিনি শুরু করেন। কিন্তু স্বাস্থ্যের কারণে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। লেকপ্লেসে থাকার সময় একতলায় তাঁর ঘরের ওপর বোমা ছোঁড়ে কংগ্রেস ও নকশালপন্থীরা। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশে যান। ঢাকায় তাঁর মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। আগেই তাঁর স্ত্রী মারা যান। সেখানে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা জানান।
তাঁর শরীর দ্রুত ভেঙে পড়তে থাকে। ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর কিম্বার নার্সিং হোমে ৮৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
১৯১৯-২০ সালে সাহিত্য ও রাজনীতি মিলিয়ে তিনি সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যে জীবন শুরু করেছিলেন, একটানা ৫৩ বছর রাজনৈতিক জীবনে তা আত্মত্যাগ ও অবদানে ক্রমভাস্বর হয়ে ওঠে। প্রচন্ড আর্থিক অনটন, অর্ধাহার, অনাহারের মধ্যে এবং মতাদর্শগত সংগ্রামে মার্কসবাদ – লেনিনবাদের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা, মানুষ ও কর্মীদের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, দেশের প্রতি ও আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রতি গভীর ভালবাসা, সুলেখক ও সংগঠক হিসেবে তার অবদান তাকে ইতিহাসের পাতায় করে তুলেছে মহান। ৪০ বছর ধরে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ন্যাশনাল বুক এজেন্সির একজন প্রধান সংগঠক ছিলেন। গণশক্তি প্রিন্টার্স প্রেস তিনিই গড়ে তােলেন। ‘কাকাবাবু’ নামে তিনি কর্মী ও নেতাদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন।
তাঁর রচিত গ্রন্থ : ‘নজরুল স্মৃতিকথা’, ‘ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস’ আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির শুদ্ধাচারী এই বিপ্লবী ব্রিটিশ ও কংগ্রেস সরকারের আমলে প্রায় ২০ বছর জেল খেটেছেন। কিন্তু নিজের আদর্শকে সমুন্নত রাখতে কোনো আপস করেননি। বিরুদ্ধ অবস্থায় প্রকাশ্যে রাজনীতি করা যখন কঠিন ছিল, তখন আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির পথ বেছে নিতে হয়েছিলেন। এই দীক্ষা তিনি যথার্থভাবেই তার অনুসারীদের দিতে পেরেছিলেন। কাকাবাবু তার সাংগঠনিক সাফল্য দেখাতে পেরেছিলেন। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে অবিভক্ত বাংলার ২৮টি জেলায়ই কমিউনিস্ট পার্টির শাখা ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) এর সদর দফতর তাঁর নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়াও, কলকাতার রিপন স্ট্রিটের নামকরণ করা হয়েছে “মুজাফফর আহমদ স্ট্রিট”।কমরেড মুজফফর আহমদের মৃত্যু নেই। তার আত্মত্যাগ ও অবদান উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
তথ্য সূত্রঃ
* আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি – কমরেড মুজফফর আহমদ।
* ‘ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস – কমরেড মুজফফর আহমদ।
* কমরেড মুজফ্ফর আহমদ (স্বরণ গ্রন্থ)।
* মুজফ্ফর আহমদ – “আমার স্মৃতিকথা”
* কমরেড মুজফ্ফর আহমদ ও বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলন- হাসান মোহাম্মদ।
* নজরুল স্মৃতিকথা’ – কমরেড মুজফফর আহমদ।
* শাশ্বত সন্দ্বীপ – এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরী।
* উইকিপিডিয়া।
* গণশক্তি পত্রিকা।







