গাজায় ৫৭ হাজারের বেশি পরিবার চালাচ্ছে নারীরা: জাতিসংঘ

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার ৫৭ হাজারের বেশি পরিবার এখন পরিচালনা করছেন নারীরা। এসব পরিবারের বেশিরভাগই জনাকীর্ণ আশ্রয়স্থল, ক্ষুধা এবং রোগের মধ্যে চরম দুর্দশার মুখোমুখি।

ইসরায়েলি গণহত্যার মুখে গাজা উপত্যকায় অনেক পরিবার সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হাজার হাজার পুরুষ হত্যার শিকার হয়েছেন, কিংবা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।

শুক্রবার জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)-এর প্রতিনিধি নেস্টর ওওমুহাঙ্গি এক সংবাদ সম্মেলনে গাজাজুড়ে হাসপাতাল, নারী ও মেয়েদের থাকার, যুব কেন্দ্র এবং বাস্তুচ্যুতি শিবির পরিদর্শনের বর্ণনা দেন।

তিনি বলেন, ‘গাজার ৫৭ হাজারেরও বেশি পরিবার এখন নারীদের দ্বারা পরিচালিত হয়। তাদের অনেকেই গভীরভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, তাদের সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য কোনো আয় নেই।’

তিনি আবহাওয়ার প্রভাব তুলে ধরে বলেন, ‘দুর্ভোগের ওপর একটি নতুন স্তর যুক্ত করছে শীতের বৃষ্টিপাত এবং বন্যা।’

খাবার ও পানির জন্য পরিবারগুলোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। নেস্টর ওওমুহাঙ্গি এই পরিস্থিতিতে বলেন, ‘মানুষ আর ঘরবাড়ি, শিক্ষা কিংবা উপযুক্ত খাবার চায় না। তারা একটি তাঁবু, একটি ছোট হিটার বা আলো চায়। তাদের প্রত্যাশা ভেঙে পড়েছে – যে কোনো ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের মতোই ধ্বংসাত্মকভাবে।’

গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘মাত্র এক-তৃতীয়াংশ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান আংশিকভাবে কাজ করছে। সবগুলোতেই কর্মীর অভাব, চাপ এবং মৌলিক জিনিসগুলোর অভাব রয়েছে।’

রাফা ক্রসিং একমুখী খুলে দেওয়ার ইসরায়েলি পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান ৮ দেশের

আরও পড়ুন:  অবিলম্বে গাজায় হামলা বন্ধ করতে বললেন ট্রাম্প

গাজা উপত্যকার রাফা সীমান্ত শুধু বহির্গমনপথ হিসেবে খোলার ইসরায়েলি ঘোষণাকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আট দেশ। তারা বলেছে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ফিলিস্তিনিদের নিজেদের ভূখণ্ডে ফেরার অধিকার বাধাগ্রস্ত হবে এবং মানবিক সহায়তা প্রবেশ বন্ধ হয়ে যাবে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এ খবর জানিয়েছে।

গাজা যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারী মিসর ও কাতারসহ ইন্দোনেশিয়া, জর্ডান, পাকিস্তান, সৌদি আরব, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাত শুক্রবার যৌথ বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ জানায়। ইসরায়েলি সামরিক ইউনিট কগাট বুধবার জানিয়েছিল, রাফাহ সীমান্ত কেবল গাজার বাসিন্দাদের মিসরে প্রবেশের জন্য কয়েক দিনের মধ্যে খুলে দেওয়া হবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

দেশগুলো ইসরায়েলের এই উদ্যোগকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের চেষ্টা বলে আখ্যা দেয় এবং ট্রাম্পের ঘোষিত ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার পূর্ণ বাস্তবায়ন দাবি করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাফাহ সীমান্ত দুই দিকেই খোলা থাকা বাধ্যতামূলক।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাফা সীমান্ত প্রায় বন্ধ। ১০ অক্টোবর থেকে কার্যকর যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও ইসরায়েল ত্রাণ প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। তাদের দাবি, হামাস সব জিম্মির মৃতদেহ ফেরত দেয়নি। তবে কেবল একটি মৃতদেহ এখনও উদ্ধার হয়নি, যা ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে বিধ্বস্ত অবকাঠামোর কারণে আটকে আছে।

যৌথ বিবৃতিতে আট দেশ ট্রাম্পের শান্তি প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েছে। ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি টেকনোক্র্যাটিক ফিলিস্তিনি সরকার গঠনের প্রস্তাব রয়েছে, যেটি আন্তর্জাতিক ‘বোর্ড অব পিস’-এর তত্ত্বাবধানে বহুজাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনীর সহায়তা পাবে। তারা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে গাজায় দায়িত্ব পালনে ফিরে আসার সুযোগ তৈরি করার আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে ১৯৬৭ সালের ৪ জুনের সীমানায় পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে।

আরও পড়ুন:  দেশে ফিরেছেন প্রধান উপদেষ্টা

দোহা ফোরামে শনিবার গাজা পরিস্থিতি ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুর রহমান আল থানি বলেন, দুই মাসের যুদ্ধবিরতি এখন সংকটাপন্ন পর্যায়ে। এটাকে পুরোপুরি যুদ্ধবিরতি বলা যায় না, যতক্ষণ না ইসরায়েলি বাহিনী পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হচ্ছে এবং গাজায় স্থিতিশীলতা ফিরছে।

তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিরদান বলেন, গাজায় আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী নিয়ে আলোচনা চলছে। এর ম্যান্ডেট, ভূমিকা ও নিয়ম চূড়ান্ত হয়নি। তিনি বলেন, বাহিনীর প্রধান উদ্দেশ্য হবে সীমান্তে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের বিচ্ছিন্ন রাখা।

এদিকে শুক্রবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ভোটের আগে আরব ও মুসলিম দেশগুলো স্বশাসনের বিষয়ে আরও স্পষ্ট ভাষা অন্তর্ভুক্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ তৈরি করে। ইসরায়েলের আপত্তি সত্ত্বেও প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয়।

গাজায় শনিবার ভোরে ইসরায়েলি হামলায় তিনজন নিহত হয়েছেন বেইত লাহিয়ায়। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি পরিবার নিজেদের খামার দেখতে উত্তর গাজায় গেলে তাদের ওপর ড্রোন হামলা হয়।

ইসরায়েলের কারাগার ও গাজায় শান্তির আশা

আরও পড়ুন:  বাংলাদেশসহ চার দেশে মার্কিন ভ্রমণ সতর্কতা

রোবেন আইল্যান্ডের প্রবেশদ্বারে একটি ফলকে তার সবচেয়ে বিখ্যাত বন্দী ৪৬৬৬৪ নম্বর কয়েদির একটি উক্তি খোদাই করা আছে; ‘কারাগারের ভেতর না গেলে কোনো জাতিকে সত্যিকার অর্থে চেনা যায় না। জাতি নিজের সেরা নাগরিকদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে, তা দিয়ে নয়; বরং সবচেয়ে নিচের অবস্থানে থাকা মানুষদের প্রতি তার আচরণ দিয়ে বিচার করা উচিত।’ নেলসন ম্যান্ডেলার এই কথাগুলো আজ যেন ইসরায়েল রাষ্ট্রের ওপর মৃত্যুঘণ্টার মতো বাজছে।

দুই বছর আগে গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের সময় ‘নিখোঁজ’ হওয়া ৩৪৫ জন ফিলিস্তিনির মরদেহ এখন খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মরদেহগুলো এমনভাবে বিকৃত যে মাত্র ৯৯ জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

মিডল ইস্ট আইয়ের সাংবাদিক মাহা হুসাইনি যুদ্ধের পুরো সময়জুড়ে গাজা থেকে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন; তিনি বর্ণনা করেছেন কীভাবে পরিবার ও ফরেনসিক চিকিৎসকেরা শোকাবহ পরিস্থিতিতে দেহ শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন, যদিও মৃত ব্যক্তিরা কীভাবে মারা গেছেন তা জানার মতো তাদের কাছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *