বিবিসির প্রতিবেদন: কূটনৈতিক পরীক্ষায় ঢাকা-দিল্লি, শেখ হাসিনাকে নিয়ে ৪ বিকল্প

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে লাভজনক। কিন্তু এর জন্য যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মূল্য চুকাতে হবে সেটিও এরইমধ্যে প্রমাণ হয়েছে।

প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে শেখ হাসিনা নয়াদিল্লির স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে সীমান্তে স্থীতিশীলতা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে। অনেক সময় চীনের চেয়েও ভারতকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ভারতেই আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাঁর মৃত্যুদণ্ডের রায় জটিল কূটনৈতিক সংকট তৈরি করেছে। ঢাকা প্রত্যর্পণ চাইছে, কিন্তু দিল্লি তাতে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে সাজা কার্যকর প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

ভারতের সামনে ৪ বিকল্প
দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, ভারতের সামনে এখন চারটি বিকল্প আছে। ভারত তাঁকে বাংলাদেশে হস্তান্তর করতে পারে। কিন্তু এটি এমন একটি পদক্ষেপ, যা দিল্লি মোটেও নিতে চায় না। আরেকটি পথ হলো বর্তমান অবস্থান বজায় রাখা। কিন্তু আগামী বছর নতুন সরকার দায়িত্ব নিলে এটি দিল্লির জন্য আরও অস্বস্তি বয়ে আনবে।

কুগেলম্যানের মতে, তৃতীয় বিকল্প হতে পারে হাসিনাকে চাপ দেওয়া। যেন তিনি নীরব থাকেন, কোনো বিবৃতি বা সাক্ষাৎকার না দেন। কিন্তু শেখ হাসিনা এখনো আওয়ামী লীগের প্রধান। ফলে নীরব থাকার প্রস্তাবে তাঁর রাজি হওয়ার সম্ভাবনা কম। দিল্লিও এমন প্রস্তাব চাপিয়ে দেবে বলে মনে হয় না।

সবশেষ বিকল্পটি হলো, তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানো। কিন্তু এটিও সমস্যামুক্ত নয়। কুগেলম্যান বলেন, আইনি ও নিরাপত্তার জন্য ‘ঝামেলাপূর্ণ’ অতিথিকে গ্রহণ করতে খুব কম দেশই রাজি হবে।

আরও পড়ুন:  ঢাকা ও গাজীপুরে সন্ধ্যার পর ৪ বাসে আগুন

কুগেলম্যানের ভাষায়, ভারত অনেক সময় গর্ব করে বলে, তারা তাদের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যায় না। শেখ হাসিনাও ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল উভয়ের কাছেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফলে প্রত্যর্পণের সম্ভাবনা আপাতত চিন্তার বাইরে।

বাণিজ্য ও নিরাপত্তা
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অন্যতম বড় বাণিজ্য অংশীদার। এ অঞ্চলে ভারতের রপ্তানি বাণিজ্যের কেন্দ্রও দেশটি। গত বছর দুই দেশের মোট বাণিজ্য ছিল প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার। অপরদিকে বাংলাদেশও ভারতের কাঁচামাল, জ্বালানি ও ট্রানজিট রুটের ওপর নির্ভরশীল। গত এক দশকে ভারত ৮-১০ বিলিয়ন ডলারের নমনীয় ঋণ দিয়েছে। কিছু পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধাসহ রেলপথ স্থাপন হয়েছে। ভারতীয় গ্রিড ও বন্দর থেকে বিদ্যুৎ, তেল ও এলএনজি সরবরাহ হয়েছে। তাই এমন সম্পর্ক কেউই সহজে ছিন্ন করতে চাইবে না।

দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সঞ্জয় ভরতদ্বাজ বলেন, নদীর পানি, বিদ্যুৎসহ নানা ক্ষেত্রে দেশ দুটি জটিল পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ। আবার ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের স্বাভাবিকভাবে চলাটা কঠিন।

আরও পড়ুন:  চীনা পণ্যে ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা ট্রাম্পের

অনেকের ধারণা, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার বহির্বিশ্বে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক সমন্বয়ে বেশ তৎপর। তাঁর শাসনের প্রথম কয়েক মাসের কূটনৈতিক উদ্যোগগুলোতে এই ধারা লক্ষ্য করা গেছে। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের রাজনীতি বিশ্লেষক বিয়ান সাইয়ের মতে, এই উদ্যোগগুলোতে ‘ভারতকেন্দ্রিক নীতি’ বর্জনের বিষয়টিও চোখে পড়ার মতো।

যে দেশটি এক সময় প্রতিটি আঞ্চলিক ফোরামে ভারতের সঙ্গে সমানভাবে অবস্থান নিয়েছে, তারা এখন ভারতীয় জ্বালানি চুক্তি পুনর্বিন্যাস করছে। ভারতের নেতৃত্বাধীন সংযোগ প্রকল্পগুলোর গতি কমিয়েছে। পাশাপাশি চীন, পাকিস্তান ও তুরস্কের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্বের বিষয়টিও সামনে এনেছে।

ভারতকে ঘিরে জনমতের অবনতিও ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান। ঢাকাভিত্তিক সেন্টার ফর অল্টারনেটিভস-এর একটি জরিপে দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশের বেশি বাংলাদেশি বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ককে ইতিবাচকভাবে দেখেন। যেখানে দিল্লীর প্রতি সেই হার মাত্র ১১ শতাংশ। অনেকেই ভারতের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। তারা মনে করেন, শেষ কয়েক বছরে ভারতের সমর্থনে শেখ হাসিনা আরও ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। তারা ভারতকেও কর্তৃত্ববাদী প্রতিবেশী হিসেবে দেখেন।

অধ্যাপক ভরতদ্বাজ বলেন, দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বহাল থাকতে দেখা গেছে। যেমন, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে যখন ‘কম ঘনিষ্ঠ’ বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় ছিল তখনও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল শেখ হাসিনার বিষয়টি সামলানোই ভারতের মূখ্য চ্যালেঞ্জ নয়। আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ দমন থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের (সেভেন সিস্টার্স) সঙ্গে যোগাযোগ বহাল রাখার জন্যও তাদেরকে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখতে হবে।

আরও পড়ুন:  পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের কর অব্যাহতি সুবিধা বাতিল

নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে
লন্ডনের এসওএএস বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক অধ্যয়নের শিক্ষক অবিনাশ পলিওয়াল। তিনি বলছেন, ভারতকে তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়। ঢাকার মূল রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে ধৈর্য্য নিয়ে সংলাপ চালিয়ে যাওয়া উচিত।

অবিনাশ পলিওয়াল মনে করেন, আগামী ১২-১৮ মাসে সম্পর্ক অস্থির থাকতে পারে। তবে এর তীব্রতা নির্ভর করবে আগামী বছর নির্বাচনের পর দেশটিতে কী কী ঘটনা ঘটে সেটির ওপর। যদি অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করতে সক্ষম হয় এবং নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে, তাহলে দুই পক্ষের জন্য সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ বাড়বে।

তবে মাইকেল কুগেলম্যান বলছেন, ‘যেকোনো সম্পর্কে সংকট তৈরি হওয়াটা প্রত্যাশিত নয়। তবে আমার অনুমান হলো, এটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়েও নড়বড়ে থাকবে।’

(বিবিসির প্রতিবেদন থেকে সংক্ষেপে অনুবাদ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *