শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘিরে সারা দিন যা যা ঘটল

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিভীষিকাময় দিনগুলোতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে আজ সোমবার (১৭ নভেম্বর) এলো ঐতিহাসিক রায়–সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড।ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আইনের এই বিজয়, যা কেবল একটি আইনি প্রক্রিয়া নয়, এটি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সব শহীদের প্রতি এক গভীরতম অঙ্গীকারের প্রতিফলন।

 সোমবার (১৭ নভেম্বর) বিকেলে বিচারকের হাতুড়ি যখন ন্যায়বিচারের রায় দিলেন, তখন যেন কোটি মানুষের নীরব কান্না আর দীর্ঘশ্বাস একযোগে মুক্তি পেল। রাজসাক্ষী হিসেবে সাবেক আইজিপির ক্ষমা প্রার্থনা থেকে শুরু করে আইন উপদেষ্টার ‘ঐতিহাসিক দিন’ ঘোষণা–রায় ঘিরে সারা দিন কী কী ঘটল, তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হলো–


এদিন রায় ঘোষণার নির্ধারিত সময়ের আগেই ঢাকা শহর ছিল নিরাপত্তার চাদরে মোড়া। সচিবালয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণ এবং শহরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সর্বোচ্চ সতর্কতায় মোতায়েন করা হয়।

ট্রাইব্যুনালের ভেতরে সকাল থেকেই ছিল থমথমে পরিবেশ। বিচারক, আইনজীবীরা নিজ নিজ আসনে বসেন এবং অভিযুক্তদের উপস্থিতির মধ্যদিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। অন্যদিকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের উদ্যোগে ঢাকা শহরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বড় স্ক্রিনে সরাসরি রায় সম্প্রচারের প্রস্তুতি নেয়া হয়। এসব স্থানে সকাল থেকেই সাধারণ জনগণ এবং জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্তদের ভিড় বাড়তে থাকে। সবার চোখে-মুখে ছিল রায়ের প্রত্যাশা ও উৎকণ্ঠা।

ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণা

দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে ছয় অধ্যায়ে ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন বিচারিক প্যানেলের সদস্য বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলের অপর সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ।


২ ঘণ্টা ১০ মিনিটের সংক্ষিপ্ত রায় পড়া শেষে দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। মূল রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার।

রায়ের খবর প্রকাশ হতেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান ফটকের সামনে উল্লাস প্রকাশ করেন জুলাই যোদ্ধারা। এ সময় তারা ‘এই মুহূর্তে খবর এলো, শেখ হাসিনার ফাঁসি হলো’, ‘দড়ি লাগলে দড়ি নে, শেখ হাসিনার ফাঁসি দে’ প্রভৃতি স্লোগান দিতে থাকেন।
ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণিত অভিযোগ

ট্রাইব্যুনাল তার পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেন, জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থানের সময় সরকার পরিকল্পিতভাবে জনগণের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছিল এবং এটি ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধ।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রমাণিত পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে: উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান; নির্মূলের নির্দেশ দেয়া; আবু সাঈদসহ অন্যদের হত্যায় সরাসরি ভূমিকা; এবং প্রতিবাদকারীদের ওপর পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা।
নাটকীয় মোড় ও রাজসাক্ষীর সাজারায় ঘোষণার সময় একটি নাটকীয় মোড় আসে যখন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের রায় ঘোষিত হয়। ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধেও অপরাধ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে মাত্র পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করেন।

আরও পড়ুন:  মিউনিখ সফর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন শুক্রবার
ট্রাইব্যুনাল মন্তব্য করেন, আবদুল্লাহ আল-মামুনের অপরাধ ছিল ফাঁসির যোগ্য। তবে তিনি ঘটনার বিবরণ তুলে ধরে রাজসাক্ষী হওয়ায় তাকে লঘুদণ্ড দেয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার পরপরই আল-মামুন আদালত এবং জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, যা উপস্থিত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ও রাজনৈতিক বার্তা

রায়ের পরপরই শুরু হয় বিভিন্ন মহলের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘আজ বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক দিন। এই রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলো। এটি কেবল একটি আইনি প্রক্রিয়া নয়, এটি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আরেকটি বিজয়ের দিন। এই রায়ের মাধ্যমে আবু সাঈদ, মুগ্ধ এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সব শহীদের আত্মা শান্তি পাবে।’

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আজ বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম একটি রায় হয়েছে। শহীদরা ন্যায়বিচার পেয়েছেন। রাষ্ট্র ন্যায়বিচার পেয়েছে। প্রসিকিউশন ন্যায়বিচার পেয়েছে।

চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এই রায় কোনো প্রতিশোধ নয়, বরং এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতির প্রতিজ্ঞা। অপরাধী যত বড় হোক, যত ক্ষমতাশালী হোক; সে আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’ তবে শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন মৃত্যুদণ্ডের রায়ে কষ্ট অনুভব করেন এবং জানান যে তার মক্কেলরা আত্মসমর্পণ বা গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত তার পক্ষে আপিল করার সুযোগ নেই।

ঐতিহাসিক এ রায়কে ‘মাইলফলক’ আখ্যা দিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘অপরাধ বিবেচনায় এ সাজা যথেষ্ট না হলেও ভবিষ্যতে কোনো সরকার বা কোনো ব্যক্তি যেন ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে না পারে তার জন্য উদাহরণ হবে এ রায়।’

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের গণ-আকাঙ্ক্ষা আংশিক হলেও ট্রাইব্যুনালের রায়ে পূরণ হয়েছে। তার মতে, ‘কোনো একজন সরকারপ্রধানের সর্বোচ্চ সাজার এ ঘটনা ইতিহাসে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে।’

অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম রায়কে স্বাগত জানালেও সম্পূর্ণ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেননি। তিনি বলেন, ‘আমরা এই রায়কে স্বাগত জানাই। তবে আমরা সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট নই। রায় যেদিন কার্যকর হবে সেদিন শহীদের আত্মা শান্তি পাবে, আমরা শান্তি পাব।’ একইসঙ্গে তিনি রাজসাক্ষী হওয়া সত্ত্বেও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের সাজা আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের খবর

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার খবর রয়টার্স, বিবিসি, আল জাজিরা, সিএনএন, টিআরটি ওয়ার্ল্ড, দ্য গার্ডিয়ানসহ বিশ্বের প্রধান প্রধান গণমাধ্যম তাৎক্ষণিক ও গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে, প্রতিবেশী ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমও এই রায়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে, যা জুলাই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাবকে আন্তর্জাতিক মহলে বিশেষভাবে তুলে ধরে।

আরও পড়ুন:  জলবায়ু পরিবর্তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্ব নেতৃত্বের প্রশংসা ইউএই মন্ত্রীর

জনজীবনে প্রভাব

দিনের শুরুতে নিরাপত্তার কড়াকড়ি থাকলেও, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ছিল এক মিশ্র চিত্র–যা একদিকে কঠোর নিরাপত্তা, অন্যদিকে জনগণের স্বস্তি ও উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ।


রায় ঘোষণার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বর, শাহবাগ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জনগণের ভিড় উল্লাসে ফেটে পড়ে। আন্দোলনকারীরা এবং সাধারণ মানুষজন একে ‘ন্যায়বিচারের বিজয়’ হিসেবে অভিহিত করেন। বিভিন্ন স্থানে মিষ্টি বিতরণ করা হয় এবং বিজয় মিছিল বের হতে দেখা যায়। বড় স্ক্রিনের সামনে জড়ো হওয়া জনতা এই রায়ের ফলে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদেরা শান্তি পাবেন বলে মন্তব্য করেন। অন্যদিকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আনন্দ প্রকাশ করেন। তবে কোথাও কোনো উত্তেজনা বা অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন:  নির্বাচন কবে আবারও জানালেন প্রধান উপদেষ্টা

অন্তর্বর্তী সরকারের আহ্বান

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে ঘোষিত মৃত্যুদণ্ডের রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ উল্লেখ করে রায়-পরবর্তী সময়ে সর্বস্তরের জনগণকে শান্ত, সংযত ও দায়িত্বশীল থাকার আহ্বান জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

রায়-পরবর্তী যে কোনো ধরনের অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা বা জনশৃঙ্খলা ভঙ্গের চেষ্টা কঠোরভাবে দমন করা হবে বলে হুঁশিয়ার করে অন্তর্বর্তী সরকার।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় প্রথম মামলাটি (মিসকেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। একই সালের ১৭ অক্টোবর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রথম বিচারকাজ শুরু হয়। সেদিনই এ মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল।

প্রথম দিকে এ মামলায় শেখ হাসিনাই একমাত্র আসামি ছিলেন। চলতি বছরের ১৬ মার্চ এ মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করার আবেদন করে প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) এবং ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *