মাস্টার মাঈন উদ্দীন
সময় যেমন প্রবাহমান, ঠিক তেমনি বলতে না বলতে হয়ে যায় মানব জীবনের অবসান। তারই ধারাবাহিকতায় আজ ৩১শে অক্টোবর আমার জন্মদিন।এই শুভ দিনে আমি জানাই আমার সকল শুভাকাঙ্ক্ষী, আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী ও বন্ধুদের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও রক্তিম ভালোবাসা।
সময় কত দ্রুত বয়ে যায়! মনে হয় যেন সেদিনই প্রথমবার সন্দ্বীপ পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে পা রেখেছিলাম এক তরুণ শিক্ষক, হৃদয়ে অগাধ স্বপ্ন, চোখে প্রজ্জ্বলিত আগুন, আর মনে ভরা দায়িত্ববোধ নিয়ে। সেই দিন থেকেই শুরু হয়েছিল এক দীর্ঘ, পবিত্র ও প্রেরণাময় যাত্রা ।জ্ঞান বিতরণের, মানুষ গড়ার, আর হৃদয় ছোঁয়ার যাত্রা।
একই বিদ্যালয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে চল্লিশ বছর শিক্ষকতা করা ,এটি আমার জীবনের অন্যতম বড় সৌভাগ্য। এই চার দশকে দেখেছি প্রজন্মের পর প্রজন্ম বদলাতে,দেখেছি ছোট ছোট শিক্ষার্থী বড় হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে, আবার তাদের সন্তানদেরও আমার শ্রেণিকক্ষে আসতে। বিদ্যালয়ের প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি বেঞ্চ, প্রতিটি সকাল আমার জীবনের এক একটি অধ্যায়ের সাক্ষী।
একজন শিক্ষক হিসেবে এত দীর্ঘ সময় একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমি নিজেকে সত্যিই ধন্য মনে করি। সন্দ্বীপ পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় আমার জন্য কেবল একটি কর্মস্থল নয় এটি আমার আত্মার অংশ, আমার জীবনের প্রতিচ্ছবি। এই বিদ্যালয়ই আমাকে দিয়েছে পরিচয়, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও অসীম স্মৃতি।
আজ ২০২৫ সালের এই অক্টোবরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে যখন পেছনে ফিরে তাকাই, দেখি চার দশকের অগণিত স্মৃতি, হাসি-কান্না, সাফল্য ও প্রেরণায় ভরা এক জীবনের প্রতিচ্ছবি। এই বিদ্যালয়ই ছিল আমার দ্বিতীয় ঘর, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়।
প্রতিটি সকাল ছিল এক নতুন সূচনা। চক হাতে কালো বোর্ডে কত শত স্বপ্ন এঁকেছি, কত শিক্ষার্থীকে জ্ঞানের প্রথম আলো দেখিয়েছি তাদের মুখের হাসিই ছিল আমার প্রতিদিনের পুরস্কার। তাদের চোখে যখন আমি নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতাম, মনে হতো এই পৃথিবীতে শিক্ষক হওয়াই সবচেয়ে গৌরবের পেশা।
আমার কাছে শিক্ষকতা কখনো কোনো চাকরি ছিল না-এটি ছিল এক ধ্যান, এক ভালোবাসা, এক জীবনের আহ্বান।আমি পেয়েছি অসংখ্য শিক্ষার্থীর শ্রদ্ধা, সহকর্মীদের সহযোগিতা, অভিভাবকদের আন্তরিকতা আর সমাজের অগাধ ভালোবাসা। এই ভালোবাসাই আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন।
আজ যখন অবসর গ্রহণের এই মুহূর্তে আমার জন্য বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছে, তখন আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ ও আবেগাপ্লুত।সহকর্মী, প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থী, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি এবং স্থানীয় সকল শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিবর্গ — সবার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা আমার জীবনের অমূল্য সম্পদ।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই আমার প্রিয় ছাত্র ও বন্ধুতুল্য ব্যক্তি, বর্তমান বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মোঃ রেজাউল করিম কে।তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা ও পারস্পরিক ভালোবাসার বন্ধনে গড়ে উঠেছে। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টা, নিষ্ঠা ও আন্তরিক তদারকির ফলেই এই বিদায় অনুষ্ঠানটি হয়েছে আরও মর্যাদাপূর্ণ ও স্মরণীয়। তাঁর প্রতি আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা রইল।
এছাড়াও, আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই ২০১৬ সালের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের, যারা ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ আমাকে আর্থিকভাবে পুরস্কৃত করেছেন । তাদের এই আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধাবোধ আমার হৃদয় গভীরভাবে ছুঁয়েছে। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের এই ভালোবাসা আমার জীবনের এক অমূল্য প্রাপ্তি, যা আজীবন স্মৃতিতে অমলিন থাকবে।
আজ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও প্রিয় শিক্ষার্থীরা যে ভালোবাসার পরশে আমাকে বিদায় জানিয়েছেন, তা আমার জীবনের এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। আমি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে ধন্যবাদ জানাই সবাইকে — যাদের সহযোগিতা, স্নেহ ও প্রেরণায় আমি আজকের আমি হতে পেরেছি।
জীবনের এই পরিসমাপ্তি আসলে কোনো শেষ নয় — এটি এক নতুন সূচনা।শিক্ষকতা থেকে অবসর নেওয়া যায়, কিন্তু শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা থেকে কখনোই নয়।
আমি বিশ্বাস করি, আমার শেখানো প্রতিটি পাঠ, প্রতিটি অনুপ্রেরণার বীজ একদিন তাদের জীবনে ফুল হয়ে ফুটবে।
আমার সাফল্য তাদের সাফল্যের মধ্যেই চিরজীবী থাকবে।
“আমি শিক্ষক,আমার হাতের চক ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু আলো ছড়ানোর শপথ আজও শেষ হয়নি”
সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন ,যেন জীবনের এই অবশিষ্ট সময় কাটে শান্তিতে, ভালোবাসায় ও প্রার্থনায়।
আর আমার শিক্ষার্থীরা যেন প্রতিটি সৎকর্মের মাধ্যমে সমাজকে আরও সুন্দর ও আলোকিত করে — এটাই আমার শেষ কামনা।
সিনিয়র শিক্ষক, সন্দ্বীপ পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়
(১৯৮৫ অক্টোবর–২০২৫ অক্টোবর)







