কাজী ইফতেখারুল আলম তারেক।।
‘শিক্ষক সেই, যিনি মোমবাতির মত নিজে জ্বলে অন্য আলো দেন।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। পৃথিবীর ইতিহাসে শিক্ষকই একমাত্র ব্যক্তি যিনি একজন মানব সন্তানকে জন্মের পরে তার চরিত্র জ্ঞানের আলোয় গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন। একজন শিক্ষক শুধু একজন ব্যক্তির নয় একটি জাতির রূপকার হতে পারেন। আজকের পৃথিবীতে যত মহান অর্জন তার মূলে রয়েছে শিক্ষা। শিক্ষার্থীর মননে আলো জ্বালিয়ে দেন একজন শিক্ষক। তাই প্রতিটি মানুষের জীবনে শিক্ষকের অনুপ্রেরণা আর আদর্শ ব্যক্তি জীবনে প্রভাবিত করে। তেমনি একজন শিক্ষকের কথা বলতে পারি, যিনি ঐতিহ্যবাহী সন্দ্বীপ পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক, কর্মবীর মাস্টার মাঈনুদ্দিন। শ্রদ্ধার্ঘ্য এই আলোকিত জীবনের প্রতি।
তিনি ১৯৮৫ সালের ১লা জানুয়ারি “সন্দ্বীপ পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ে” অনুষ্ঠানিকভাবে পাঠদান কর্মসূচি শুরু হয়। সে সময় অত্র বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট ছিল। সে বছরের ১লা অক্টোবর তিনি বিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং ডিসেম্বর অবধি অবৈতনিক পাঠদান করেন।
১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন অত্র স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মাস্টার শামসুল হক (চেয়ারম্যান) ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বাবু গোপাল চন্দ্র দাস, মাস্টার হুমায়ূন কবির কর্তৃক তিনি সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
সে সময় স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল দুই’শ মতো। ১৯৮৬ সালের ১লা অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত অত্র স্কুলে শিক্ষকতা সময়কাল। তাঁর কর্মজীবনের প্রতিটি দিনে তিনি সততা, নিষ্ঠা ও মমতায় শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলেছেন। শুধু শ্রেণিকক্ষেই নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আমাদের পরামর্শদাতা ও অনুপ্রেরণার উৎস। সময়ের পালাক্রমে অন্য অনেকের মতো তিনি বিদায় লগ্নে উপনীত।
বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্যারের শেষ কর্ম দিবস অর্থাৎ আগামী ৩০ অক্টোবর স্কুল প্রাঙ্গনে তাকে “রাজসিক বিদায়” জানানো হবে।
বিদায় শব্দটি বরাবরের মতোই বিয়োগান্তক। ব্যথা-বেদনা, অনুভূতি মিশ্রিত। চিরচেনা বিদ্যাপিঠ থেকে বিদায় নেয়া সত্যি কঠিন বিষয়। বিদায়লগ্নে ব্যাথা অনুভূত হবে আর সেটা আনন্দে গৌরবে পত্রপল্লবে হবে তখনই যখন সকলের সম্পৃক্ততা ও উদার অংশগ্রহণ থাকে। তবেই কর্মজীবনের শেষদিন অত্যন্ত স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থাকবে।
শিক্ষক শুধু পাঠদান করেন না, তিনি গড়ে তোলেন মানুষ। তাঁর নির্দেশনা, আদর্শ ও প্রজ্ঞায় অগণিত শিক্ষার্থীর জীবন আলোকিত হয়। আমরা বিদায় জানাবো এমন এক মহান শিক্ষককে, যিনি আমাদের শিক্ষা-জীবনের পথপ্রদর্শক ছিলেন। কর্মজীবনের শেষ স্মৃতিটুকুন তাঁকে অনন্তকাল বাঁচবার প্রেরণা যোগাবে। বিগত দিনে অত্র বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক কর্মজীবন শেষ করেছেন। অথচ কপালে জোটেনি বিদায় অনুষ্ঠান।
এক্ষেত্রে মাস্টার মাঈনুদ্দিন অত্যন্ত ভাগ্যবান। বিগত দিনে স্কুলের অনিয়ম, ফলাফল বিপর্যয়, বিভিন্ন শিক্ষকের বিদায় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠান না হতে পারার অনুতাপ অনুশোচনা হতে যখন বেরিয়ে আসছে সে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি উপনীত।
তিনি বিদায় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সকলের দোয়া ও শ্রদ্ধা ভালোবাসা নিয়ে ঘরে যাবেন। ঠিক একই সঙ্গে যেসব শিক্ষক দিন শেষে পায়ে হেঁটে ঘরে গেছেন আজ তাদের জন্য অশ্রুসিক্ত হচ্ছি। বিশেষ করে দিদারুল আলম প্রকাশ (গায়ক রফিক) স্যার। তাঁর মতো মহান একজন শিক্ষককে আমরা মূল্যায়ন করতে পারিনি। যদিও এই ব্যাপারে আমি মাস্টার হুমায়ুন কবির স্যারের সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগ করেছি। তিনিও আন্তরিক ছিলেন কিন্তু কোনো অদৃশ্য ইশারার কারণে মহান শিক্ষককে আমরা সম্মান দিতে পারিনি। যা একজন প্রাক্তন হিসেবে আমি খুবই লজ্জিত ও দুঃখিত।
এক নজরে মাস্টার মাঈনুদ্দিনঃ
মাস্টার মইনুদ্দিনের সুদীর্ঘ কর্মজীবনে স্কুলের শিক্ষার মান উন্নয়নে তিনি বেশ কিছু ভূমিকা রেখেছেন।
কর্মজীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্কুলের পুকুরের জন্য জমির প্রয়োজন ছিল। স্কুলের পাশে ছিল হারামিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত লেদু সাহেবের জমি। এক সকালে আমি এবং বাবু গোপাল চন্দ্র দাসকে নিয়ে লেদু চেয়ারম্যানের বাড়িতে যায়। স্কুলের পুকুরের জন্য জমিদানের জন্য উৎসাহিত করি এবং প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তিনি বিনামূল্যে ১২ কড়া জমি দান করেন। এরপরে পুকুরের খনন কাজ শুরু হয় এবং বর্তমানে পুকুরটি স্কুলের শোভা বৃদ্ধি করেছে। এই দিনটি আমার সারাজীবন মনে থাকবে।
এছাড়া তিনি আরো জানান, স্কুলের বর্তমান সভাপতি রেজাউল করিমের কাছ থেকে স্কুলের জন্য ২০টি সিলিং ফ্যান, একটি মোবাইল ও আন্তঃস্কুল ফুটবল ম্যাচের জন্য এক লক্ষ টাকা সমমূল্যের পুরস্কারের ব্যবস্থা করেন।
মাস্টার মাঈনুদ্দিন একজন অনলবর্ষী বক্তা, প্রাণচঞ্চল শিক্ষক। তার রসজ্ঞ এবং আকর্ষণীয় উপস্থাপনের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। এছাড়া ক্রীড়া শিক্ষক ও শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্কুলের শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে রেখেছেন প্রভূত অবদান।
এসএসসি পরীক্ষার্থীদের পড়াশোনার তদারকির জন্য প্রতিদিন দুইজন শিক্ষক দায়িত্ব পালন করে থাকেন। মাস্টার মাঈনুদ্দিন স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে তিনি ছাত্রাবাসে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন সময় সুপারের দায়িত্ব পালন করেছেন।
সুদীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি পেয়েছেন হাজারো শিক্ষার্থীর ভালোবাসা সম্মান ও শ্রদ্ধা। একজন শিক্ষক হিসেবে এটাই তার জীবনের পরম প্রাপ্তি। এখনো শিক্ষার্থীরা তাকে পা ছুঁয়ে সালাম করেন যা একজন শিক্ষক হিসেবে তার জন্য পরম পাওয়া। তিনি ছিলেন দৃঢ় নীতিবান, আবার একইসঙ্গে ছিলেন স্নেহশীল অভিভাবকসুলভ। তাঁর শিক্ষাদান ছিল চিন্তা উদ্রেককারী, হৃদয়গ্রাহী ও জীবনমুখী। তাঁর কাছ থেকে আমরা শিখেছি দায়িত্ব, অধ্যবসায় ও নৈতিকতার পাঠ।
আমরা যখন তাঁকে বিদায় জানাচ্ছি, আমাদের হৃদয় ভরে উঠছে কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধায়। তাঁর অবদান আমাদের স্মৃতিতে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। আমরা প্রার্থনা করি, জীবনের নতুন অধ্যায়ে তিনি যেন সুস্থ, সুখী ও সাফল্যমণ্ডিত থাকেন। অসংখ্য বরেণ্য শিক্ষকদের সাথে মাস্টার মাঈনুদ্দিন কর্মজীবন পার করেছেন। তারা হলেন – বাবু গোপাল চন্দ্র দাস, ওমর ফারুক, সেলিম আক্তার, মাওলানা হোসাইন আহমেদ, মাস্টার ফিরোজ খান, কবি ও শিক্ষক দিদারুল আলম প্রকাশ (গায়ক রফিক), মহসিন খান, ওমর ফারুক, হুমায়ুন কবির, মোঃ মহসিন, আবুল কালাম আজাদ, আব্দুল কাদের, আব্দুল হান্নান, মাস্টার আব্দুল ওহাব, ফজলুল করিম, আমিনুর রসুল খান, রফিকুল ইসলাম, শামসুল আলম, আশরাফ উদ্দিন, ইফতেখারুল আলম, মাহবুবুল আলম, মেহেরুন্নেসা, খাদিজা বেগম, জহিরুল ইসলাম প্রমুখ।
মহান শিক্ষক দিবসে আহ্বানঃ
আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এই দিনে আমার আহ্বান শিক্ষকের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন জানানো আমাদের কর্তব্য। তাই আসুন বিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমি সকলের কাছে অনুরোধ করব অনুষ্ঠানটি যেন সফল ও সার্থক হয়।
বিদায় সংবর্ধনাঃ
আগামী ৩০ অক্টোবর সকাল দশটায় স্কুল প্রাঙ্গণে মাস্টার মাঈনুদ্দিন স্যারের বিদায় সংবর্ধনা। উক্ত অনুষ্ঠানে আপনারা সকলে আমন্ত্রিত।।সকলের মঙ্গল কামনা করছি।।
প্রাক্তন ছাত্র
ব্যাচঃ ২০০৬
সন্দ্বীপ পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়।







