হজ করতে সৌদি আরবে সমাবেত হচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমান। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আ. আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ হজের ঘোষণা দিয়েছিলেন। নবী মুহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মাদীর ওপর হজ ফরজ করা হয়েছিল। সেই থেকে প্রতি বছর হজ মৌসুমে সৌদি আরবের মক্কায় ঢল নামে হজযাত্রীদের।
হজের ফজিলত, হাজীদের মর্যাদা ও হজের মাধ্যমে গুনাহ মাফ সম্পর্কিত ১০টি হাদিস তুলে ধরা হলো—
হজ ইসলামের স্তম্ভ
হজ ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি। হজজরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পাঁচটি স্তম্ভের উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত। ১. এ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোন ইলাহ নেই ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বান্দা ও রাসূল। ২. সালাত কায়েম করা। ৩. যাকাত আদায় করা। ৪. হজ পালন করা। ৫. রমজানন মাসের রোজা পালন করা। (বুখারী, মুসলিম)
জীবনে একবার হজ ফরজ
মানুষের কষ্ট, আর্থিক সক্ষমতার কথা বিবেচনায় জীবনে একবার হজ আদায় করা ফরজ।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদের সামনে প্রদত্ত খুতবায় বলেন, লোকসকল! আল্লাহ তোমাদের ওপর বায়তুল্লাহর হজ ফরজ করেছেন, তাই তোমরা হজ পালন করো।
একজন লোক বলে উঠলো, হে আল্লাহর রাসুল! প্রতি বছরই কি হজ পালন করতে হবে? আল্লাহর রাসুল (সা.) নিরুত্তর থাকলেন এবং লোকটি তিনবার জিজ্ঞাসা করল।
আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, যদি আমি বলতাম, হ্যাঁ, তাহলে প্রতি বছর হজ করা ফরজ হয়ে যেত আর তোমরা তা পালন করতে পারতে না। আমি আপনাদেরকে যতটুকু বলি ততটুকু গ্রহণ করো।
তোমাদের পূর্বে আগত অনেক জাতি অতি মাত্রায় প্রশ্ন ও তাদের নবীদের সামনে মতবিরোধ করার কারণে ধ্বংস হয়েছে। তাই আমি যখন তোমাদেরকে কোনো কিছু করার আদেশ দেবো, তখন তোমরা তা সাধ্যমত পালন করো। আর যা করতে নিষেধ করব, তা থেকে বিরত থাকো। (সহিহ মুসলিম: ৩৩২১)
সর্বোত্তম আমল
সাহাবিরা সবসময় উত্তম আমল জানতে আগ্রহী থাকতেন। একবার তারা সর্বোত্তম আমল সম্পর্কে জানতে চাইলে রাসুল (সা.) হজকে সর্বোত্তম আমল হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
হজ আবু হুরায়রা (রা.) বলেন— রাসূল (সা.) কে কেউ জিজ্ঞেস করল, সর্বোত্তম আমল কোনটি? রাসুল (সা.) বললেন: আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি ঈমান। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলে বললেন: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ। আরও জিজ্ঞেস করলে বললেন: হজ্জে মাবরুর (যা আল্লাহ কবুল করেছেন)। (বুখারি ও মুসলিম)
জিহাদের সমতুল্য
হজের সময় ভ্রমণ, ভিড়, শারীরিক কষ্ট ও অর্থ-সময় —এসবই জিহাদের একটি রূপ। নারী ও দুর্বল পুরুষদের জন্য রাসুল (সা.) একে হজের সমতুল্য বলেছেন।
হজরত আয়েশা (রা.) রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা জিহাদকে সর্বোত্তম আমল মনে করি, আমরা কি জিহাদ করব না? তিনি বলেন: তোমাদের জন্য সর্বোত্তম জিহাদ মাবরুর হজ।
তিনি বলেন : এরপর থেকে আমি নিয়মিত হজ করার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। (বুখারি ও মুসলিম)
দুর্বলদের জিহাদ
হুসাইন ইবনে আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বলল, আমি দুর্বল ও ভীতু। রাসুল (সা.) বললেন: তাহলে এমন এক জিহাদে অংশগ্রহণ করো, যেখানে যুদ্ধ নেই—সেটা হলো হজ। (সহিহ করেছেন আল-আলবানী)
চরিত্রবান হাজির জন্য মহাপুরস্কার
নিম্নোক্ত হাদিসে দুটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে:
ক. হজ চরিত্র উন্নয়নের প্রশিক্ষণ।
খ. এবং হজ পাপ মোচনের কার্যকর উপায়।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোনোরূপ অশ্লীল কথা বা গুনাহর কাজে লিপ্ত না হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে হজ সম্পন্ন করে, সে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে। (বুখারি, হাদিস : ১৫২১)
চূড়ান্ত সাফল্য
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাতে প্রবেশই প্রকৃত সফলতা। হজের মাধ্যমে তা অর্জন হয়।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, হজ মাবরুরের প্রতিদান শুধুই জান্নাত। (বুখারি ও মুসলিম)
জাহান্নাম থেকে মুক্তি
আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, আরাফার দিনে আল্লাহ যত লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন, অন্য কোনো দিনে এত করেন না। তিনি হাজিদের খুব কাছে আসেন এবং ফেরেশতাদের সামনে তাদের নিয়ে গর্ব করে বলেন: ‘এরা কী চায়? (মুসলিম)
আল্লাহর সম্মানিত মেহমান
হাজিরা আল্লাহর মেহমান—হাজির সম্মান কত বেশি হবে, তা কল্পনাও করা যায় না। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহর পথে মুজাহিদ, হাজি ও ওমরাহ পালনকারী—এরা সবাই আল্লাহর প্রতিনিধি। তিনি তাদের ডাকেন, তারা সাড়া দেন। তারা তার কাছে কিছু চান, তিনি তাদের দোয়া কবুল করেন। (ইবনু মাজাহ)
বিশেষ দিন, সবার সুযোগ
হজের দিনগুলো খুবই বরকতময়। শুধু হাজিদের জন্য নয়—সব মুসলমানের জন্যই তা কল্যাণের মৌসুম। জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জিলহজ মাসের দশ দিন থেকে উত্তম আল্লাহর নিকট কোন দিন নেই।
তিনি বলেন: এক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, এ দিনগুলোই উত্তম, না এ দিনগুলো আল্লাহর রাস্তায় জিহাদসহ উত্তম? তিনি বললেন: জিহাদ ছাড়াই এগুলো উত্তম। আল্লাহর নিকট আরাফার দিন থেকে উত্তম কোন দিন নেই, আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন অতঃপর জমিনে বাসকারীদের নিয়ে আসমানে বাসকারীদের সাথে গর্ব করেন। তিনি বলেন: আমার বান্দাদের দেখ, তারা হজের জন্য এলোমেলো চুল ও ধূলিময় অবস্থায় দূর-দিগন্ত থেকে এসেছে। তারা আমার রহমত আশা করে, অথচ তারা আমার আযাব দেখেনি।
সুতরাং এমন কোনো দিন দেখা যায় না যাতে আরাফার দিনের তুলনায় জাহান্নাম থেকে অধিক মুক্তি পায়। (ইবনু হিব্বান)