আয়শা সাথী
মে দিবস সারা বিশ্বে শ্রমিকদের জন্য এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন যেখান প্রতিফলিত হয় শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস এবং একটি ন্যায্য ও অধিকতর ন্যায়সঙ্গত সমাজ বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতি। শ্রমিকদের একত্রিত হওয়া (দুনিয়ার মজদুর এক হও) এবং অবস্থার পরিবর্তনের দাবি করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রদান করা মে দিবসের অন্যতম উদ্দেশ্য। ১৮৮৬ সালের ১মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে হে মার্কেটে ন্যায্য মজুরি এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে অনেক শ্রমিক নিহত হওয়ার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে এই দিনটি পালিত হয়ে আসছে মে দিবস বা শ্রমিক দিবস হিসেবে। ১৮৮৯ সালে রেমন্ড লাভিনে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে কংগ্রেসে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন। ১৮৯১ সালে প্যারিসেই দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। স্বীকৃতি পায় মে দিবস। রাশিয়ায় ১৯১৭ এবং ভারতবর্ষে ১৯২৩ সাল থেকে এই দিবসটি পালন করা হচ্ছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় মে দিবস পালিত হয় না, সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবার ‘লেবার ডে’ পালন করে দেশ দুইটি। তবে মে দিবসে সরকারি ছুটি থাকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্তত ৮০টি দেশে। ঐতিহাসিক পটভূমিপুষ্ট মে দিবস এই সকল দেশে শ্রমিক জাগরণের পাশাপাশি শ্রমিকদের প্রাপ্য মর্যাদা ও যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের পথ সুগম করে।
মে দিবসের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে শ্রমজীবী মানুষের যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচনা হয়, তার ফলে ধীরে ধীরে লোপ পেতে শুরু করে সামাজিক শ্রেণি-বৈষম্য। একবিংশ শতাব্দীতে শ্রমিকদের মৌলিক ভূমিকার স্বীকৃতি এবং তাদের প্রতি ন্যায্য আচরণ ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান মে দিবসের মূল লক্ষ্য। যদিও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শ্রমিকরা, বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা আজও নানামুখী শোষণ, অনিরাপদ কাজের পরিস্থিতি এবং মৌলিক অধিকার ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুবিধা বঞ্চিত থেকেই যাচ্ছে। মে দিবসের মূল মুখপাদ্য বিষয় ‘আট ঘণ্টা হোক শ্রম ঘণ্টা’। নারীরা কি এই সুযোগ পাচ্ছেন আদৌ, বিশেষত অদৃশ্য শ্রমে – প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে আজও! বেশিরভাগ দেশেই এখনো নারীরা আটঘণ্টা শ্রমের বাইরে বিনোদন, বিশ্রাম – এই বিলাসিতা উপভোগ করতে পারে নি। আন্তর্জাতিক কর্পোরেশন নিয়ন্ত্রিত বিশেষায়িত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিদ্যমান লিঙ্গ বৈষম্যের সুযোগ নিচ্ছে একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী –যেখানে সস্তা শ্রমের একটি প্রধান উৎস নারী। যদিও মানব কল্যাণের জন্য অপরিহার্য যত্নশীল শ্রমপ্রদানের উৎস এই নারীশ্রম– অথচ তারাই বেশি উপেক্ষিত। লিঙ্গ সমতা এবং কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসানের দাবিতে ২০১৮ সালে স্পেনের নারীরা ধর্মঘট করেছিলেন– যদিও এরপরেও তাদের ক্ষেত্রে বৈষম্য কমেনি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যায় নারী শ্রমিকের হার সবচেয় বেশি কৃষিখাতে। এরপরে রয়েছে শিল্পখাত ও অদৃশ্য খাত গৃহস্থালি শ্রম। এখানে নারী শ্রমিকেরা যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হয়ে থাকে তা হল লিঙ্গভিত্তিক বেতন বৈষম্য, গৃহস্থালি শ্রম, প্রতিকূল কর্মপরিবেশ, কর্মজীবনে ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি। এছাড়াও দেশীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী কর্মস্থলের পাশাপাশি গৃহস্থালিতে রয়েছে নারীর শারীরিক ও মানসিক শ্রমের পরিপ্রেক্ষিতে বিনা পারিশ্রমিকের অজস্র শ্রম । কৃষি, খনি, মৎস, পর্যটন শিল্প, চা শিল্প কিংবা আবাসন শিল্পের সাথে জড়িত নারী শ্রমিকরা নিয়মিত শোষিত হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী ২০২২ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী তৈরি পোশাক খাতে মোট লোকবল ৪৩ লাখ ১৬ হাজার, যা মোট পোশাক শ্রমিকের ৩৭.৫১% অর্থাৎ ১৬ লাখ ১৯ হাজার জন নারী শ্রমিক। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালে দেশে তৈরি পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিক ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪৫৯ জন। বিকেএমইএর তথ্য অনুযায়ী, নিট সেক্টরে ১৭ লাখ ২৫৫ শ্রমিকের ৬২ শতাংশ অর্থাৎ ১০ লাখ ৫৪ হাজার ১৫৭ জন নারী। সবমিলে দেশে তৈরি পোশাকখাতে মোট ৫০ লাখ ১৭ হাজার ৬৫২ জন শ্রমিকের ৫৫.৫৭% অর্থাৎ ২৭ লাখ ৮৮ হাজার ৬১৬ জন নারী। পোশাক কারখানায় এসব নারী শ্রমিকের শোষণের ওপর মালিকের মুনাফা, কিন্তু কর্মপরিবেশ বা মজুরি – কোনটাই নারী শ্রমিকের অনুকূলে নয়! লিঙ্গ বৈষম্য, যৌন হয়রানি, কণ্ঠ রোধ, অসম মজুরি ও পারিবারিক বাঁধার কারনে শ্রম বাজারে নারী শ্রমিকরা পিছিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব ও চাকুরিচুত্যি এই খাতে নারী শ্রমিকদের পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। ‘বাংলাদেশে আরএমজি শিল্পের প্রযুক্তির আপগ্রেডেশন’ শীর্ষক এক সমীক্ষায় বলা হয় ২০২৩ সালে এ খাতে নারী শ্রমিক ৫৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০১৪ সালে ৫৬ শতাংশ ছিল। পোশাকশিল্প শুরুর দিকে যা ছিল ৮০ শতাংশ।
বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় চাকরির জন্য বিদেশ যান। বিশ্ব শ্রমবাজারে অভিবাসী নারী শ্রমিকের সংখ্যা মোট শ্রমিক সংখ্যার প্রায় অর্ধেক। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগের মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ সুগম হয়েছে- এটা সত্যি, কিন্তু অন্যদিকে নারীদের পড়তে হচ্ছে মানবাধিকার এবং নিরাপত্তা ঝুঁকির মতো সংকটজনক অবস্থায়। অভিবাসী নারী শ্রমিকরা কর্মস্থলে নানারকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশের জন্য বয়ে আনেন বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু প্রবাসে অনেকেই যৌন, শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের শিকারও হন, অনেকে দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশে পাড়ি দিয়ে হন নিঃস্ব। এরপরও তারা শ্রমের মূল্য অনুযায়ী মজুরি পান না। যেসব দেশে অভিবাসী নারী শ্রমিকরা গৃহকর্মী হিসেবে যাচ্ছেন, সেসব দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তারা নানা সমস্যায় পড়ছেন, মৌলিক ও মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে। এছাড়াও শ্রমবাজারে অংশ নেয়া এসব নারী শ্রমিকরা অনেকেই কম দক্ষতাসম্পন্ন হওয়ার কারণে কর্মক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়েই সুরক্ষা সমস্যায় পড়েন। যদিও অভিবাসী নারী শ্রমিকরা পুরুষ অভিবাসী শ্রমিকদের চেয়ে কম উপার্জন করলেও তারা তাদের আয়ের ৯০ শতাংশ টাকা দেশে পাঠিয়ে দেন, যেখানে পুরুষ শ্রমিকরা পাঠান ৫০ শতাংশ।
বাংলাদেশে নারীর শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন দিতে প্রথমত যে সব নারী তাদের শ্রমে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছেন, তাদের জন্য সমতার ভিত্তিতে একটি সুন্দর অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। নারী শ্রমিকদের এসব প্রতিকূলতা ও অসুবিধা দূর করা আবশ্যক। এখানে নারী শ্রমিকদের যথাযথ স্বীকৃতি না পাওয়ার অন্যতম কারণ মেয়েদের শিক্ষার অভাব। এর মধ্যে রয়েছে কর্মমুখী শিক্ষা বিমুখতা, বাল্য বিবাহ, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ও সামাজিক ট্যাবু। এসকল প্রতিকূলতাকে পেছনে রেখে নারী শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার দিতে তাদের কর্মমুখী শিক্ষা অর্জনে উৎসাহিত করা, কর্মক্ষেত্রে সমতা আনয়ন, নারীর অধিকারের প্রতি মর্যাদা, বিয়ে ও সন্তান প্রসবের পরে তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা, নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টি, নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ইত্যাদি পদক্ষেপ নিতে হবে। নারী শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হলে তাদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য নারী শ্রমিকদের উপর হওয়া অসম আচরণ ও নির্যাতন বন্ধের জন্য নতুন ও সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। প্রবাসী কল্যাণ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতি ২০১৬’ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯ (সুযোগের সমতা), ২০ (অধিকার ও কর্তব্যরূপে কর্ম) ও ৪০ (পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা) অনুচ্ছেদগুলোর আলোকে প্রণীত হয়েছে।
সংবিধানের এই বিধানাবলী অনুযায়ী মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ ও পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং যোগ্যতা অনুসারে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা প্রদান রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ২.৪ নারী কর্মীদের শ্রম অভিবাসন এ ২.৪.৮ উল্লেখ রয়েছে- যেসব গন্তব্য দেশে বাংলাদেশি নারী অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা বেশি বিশেষত সেসব দেশের শ্রমকল্যাণ উইংগুলোতে নারী কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়ানো হবে। এসব নারী কর্মকর্তার বিশেষ প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারী অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষা, কাজের পরিবেশ পর্যবেক্ষণসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় আইনি, মনস্তাত্ত্বিক, স্বাস্থ্যগত ও আর্থিক বিষয়ে পরামর্শ প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। ২.৪.৯ উল্লেখ রয়েছে- নারীদের জন্য বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র ও পেশার সম্প্রসারণ, দক্ষতার উন্নয়ন এবং অভিবাসী নারী কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সামাজিক সুরক্ষা প্রদানে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ তহবিলের আওতায় বিভিন্ন লিঙ্গ-সংবেদনশীল উন্নয়নমূলক কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বিদেশে কর্মরত বা প্রত্যাগত নারী কর্মীদের মধ্যে যারা সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি ও অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন তাদের জন্য বিশেষ সহায়তামূলক কর্মসূচিসহ সেবা ও পরামর্শ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। এসকল ধারার অনুকূলে অভিবাসী নারী শ্রমিকরা শুধু গৃহকর্মী হিসেবে নয়, অন্য কাজেও যাবেন। এক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। অভিবাসী নারী শ্রমিকদের ইতিবাচক গল্পগুলোও তুলে ধরতে হবে। অভিবাসী নারী শ্রমিক কোনো সমস্যায় পড়লে টোল ফ্রি হেল্প লাইন ১০৯ নাম্বারে ফোন করতে পারেন।
মে দিবসের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করে আমাদের প্রত্যাশা – দেশ ও জাতির কল্যাণে সব শ্রমিকেরা যেন তাদের শ্রমের যথাযথ মর্যাদা পান। তাদের যেন অধিকার আদায়ের জন্য রাস্তায় নামতে না হয়, মুখোমুখি না হতে হয় শাসক ও শোষক গোষ্ঠীর। নারী শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার আলোকে কাজ করার সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলে তারা দেশকে উন্নতির পথে আরো বেগবান করতে তুলতে পারবেন, উন্নত হবে তাদের জীবনযাত্রার মান। নারী শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় শক্তিশালী অবলম্বন হিসেবে কাজ করতে পারে নারীর মানবাধিকার ও ক্ষমতায়ন বিষয়ক সব কনভেনশন। নারী শ্রমিকরা যাতে নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার না হন এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
বিশ্বের সব শ্রমিকের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা
শিক্ষক ও গবেষক