আইএমএফের শর্ত পূরণের মুদ্রানীতি

মোহাম্মদ ফয়সাল আলম:

বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে, যা আগামী রবিবার বিকাল ৩টায় গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার তুলে ধরবেন। নতুন মুদ্রানীতি আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণের লক্ষ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে।

নতুন মুদ্রানীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলো হলো:

  • ব্যাংক ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া: সুদহার করিডর প্রথার আওতায় বাজারভিত্তিক করা হবে।
  • মুদ্রানীতির অপারেটিং টার্গেট হিসেবে সুদকে বিবেচনায় নেওয়া: অর্থের জোগান নিয়ন্ত্রণে সুদহার প্রধান টার্গেট হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
  • টাকা ও ডলারের একক বিনিময় হার চালু: বাজারে একক বিনিময় হার প্রতিষ্ঠিত করা হবে।
  • রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়নের ঘোষণা: রিজার্ভের প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করা হবে।
  • রিজার্ভ সাশ্রয়ে পদক্ষেপ অব্যাহত রাখা: রিজার্ভ সংরক্ষণে চলমান পদক্ষেপগুলো অব্যাহত থাকবে।

গতকাল গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন মুদ্রানীতি নিয়ে চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে এই পরিবর্তনগুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মুদ্রানীতি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার, যা বাজারে অর্থের জোগান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতা এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এছাড়া বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও এর অন্যতম লক্ষ্য। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হার উভয় সূচকেই অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের ঘাটতি এবং রিজার্ভের অব্যাহত পতনও অর্থনীতিতে অস্বস্তি তৈরি করছে। আইএমএফের ৪৭০ কোটি টাকা ঋণের শর্ত হিসেবে এসব সূচকে সংস্কার ও উন্নয়নের শর্ত রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলির কারণে, নতুন অর্থবছরের মুদ্রানীতি প্রণয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠিন পরিস্থিতির মুখে রয়েছে। মুদ্রানীতির মাধ্যমে এই সমস্যাগুলির সমাধানে সহায়তা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।

আরও পড়ুন:  এই কষ্ট সাময়িক, দুর্দিন চলে যাবে: কাদের

https://www.facebook.com/DakdiyeJai.news

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি প্রণয়ন নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি রয়েছে, যার সভাপতি গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। গতকাল অনুষ্ঠিত কমিটির ৫৯তম সভা ছিল নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার আগে শেষ বৈঠক। সভায় মূল্যস্ফীতি, বিনিময় হার, ব্যাংক ব্যবস্থার তারল্য ও সুদহার পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয় এবং মুদ্রানীতি কাঠামো আধুনিকীকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে ব্যাংকের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার এবং সুদহারের করিডোর প্রথা চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। এই প্রথা অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস থেকে মুদ্রানীতিতে সুদহারের করিডর প্রথা চালু হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক দুই ধরনের করিডর ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছে:

  • বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গ্রাহকদের বিতরণ করা ঋণের সুদহার: এটি রেফারেন্স রেটসহ করিডর হিসেবে পরিচিত হবে।
  • বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অর্থ ধার দেওয়া-নেওয়ার সুদহার: এটি পলিসি রেটসহ করিডর হিসেবে ব্যবহৃত হবে এবং মুদ্রানীতি পরিচালনার টুলস হিসেবে কাজ করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, এতদিন রিজার্ভ মানিকে অপারেটিং টার্গেট বিবেচনায় নিয়ে বাজারে অর্থের জোগান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে মুদ্রানীতির কার্যক্রম পরিচালিত হতো। তবে আগামী অর্থবছর থেকে এ ব্যবস্থা পরিবর্তন করে মুদ্রানীতির অপারেটিং টার্গেট হিসেবে সুদহারকে বিবেচনায় নেওয়া হবে। এর মাধ্যমে বাজারে অর্থের জোগান নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এছাড়া আগামী জুলাই থেকে এর সুদহার করিডর ব্যবস্থা চালু করা হবে। এ ব্যবস্থায় ব্যাংক ঋণের সুদহার নির্ধারণ হবে ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে।

আরও পড়ুন:  পবিত্র মাহে রমজানে বাংলাদেশসহ মুসলিম জাহানের কল্যাণ কামনায় প্রধানমন্ত্রী

মুদ্রানীতি কাঠামোয় সুদহারের করিডর : পাশের দেশ ভারতের মুদ্রানীতির আদলে মুদ্রানীতি কাঠামোয় করিডর প্রথা চালু করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ব্যবস্থায় পলিসি রেটকে একটা পর্যায়ে রেখে সুদহারের একটি করিডর দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে কলমানি বা পলিসি রেটের মতো শর্টটার্ম সুদহারকে টার্গেট করা হবে। এ রেটেই বাজারে অর্থের সরবরাহ বাড়নো-কমানো হবে, যাতে বাজারে অতিরিক্ত টাকা না থাকে, আবার ঘাটতিও না হয়। অর্থাৎ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে ওই করিডরের আওতায় পৃথক রেট থাকবে। এর একটি হলো লেন্ডিং রেট, অপরটি হলো ডিপোজিট রেট। বাজারে যখন অতিরিক্ত তারল্য থাকবে, সেটা তুলে নেওয়ার জন্য ডিপোজিট রেট প্রয়োগ করা হবে। আর যখন ব্যাংকগুলোতে অর্থের সংকট থাকবে, তখন তাদের অর্থ ধার দেওয়ার জন্য লেন্ডিং রেট প্রয়োগ করা হবে।

ব্যাংক ঋণের সুদহারের করিডর : আগামী জুলাই থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে একটি সুদহার করিডর ব্যবস্থা চালু করা হবে। এ ব্যবস্থায় ব্যাংক ঋণের সুদহার নির্ধারণ হবে ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে। ট্রেজারি বিলের সুদহারের সঙ্গে অতিরিক্ত ৩ শতাংশ পর্যন্ত যোগ করা যাবে। নতুন এ ব্যবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ‘শর্টটার্ম মান্থলি এভারেজ রেট’ বা স্মার্ট।

আরও পড়ুন:  চলচ্চিত্র বদলে যাওয়া বাংলাদেশকে তুলে ধরবে : তথ্যমন্ত্রী

চালু হবে একক বিনিময় হার : আগামী মুদ্রানীতিতে বিনিময় হার নির্ধারণের পদ্ধতি এবং তা বাস্তবায়নের বিষয়ে ঘোষণা থাকবে। মুদ্রা বিনিময়ের হার ক্রমান্বয়ে বাজারভিত্তিক করার লক্ষ্যে বিদ্যমান একাধিক মুদ্রার বিনিময় হারের মধ্যে ব্যবধান ন্যূনতম পর্যায়ে আনার ওপর জোর দেওয়া হবে। অর্থাৎ আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও নগদ কেনাবেচায় ডলারের বিনিময় একটির সঙ্গে আরেকটির পার্থক্য সর্বোচ্চ ২ শতাংশের মধ্যে রাখার ঘোষণা আসতে পারে।

থাকবে রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়ন : আগামী জুলাই থেকে আইএমএফের মানদণ্ড মেনে রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়ন দেখাতে শুরু করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ঋণ বাবদ অর্থ রিজার্ভ থেকে বাদ দিয়ে দেখানো হবে। গত বুধবার দিনশেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের নিয়মে হিসাব করলে নিট রিজার্ভের পরিমাণ নেমে আসবে ২৪ বিলিয়নেরও নিচে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *