বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সংস্কৃতিকর্মীরা বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন, মিছিল ও বিক্ষোভ করেছেন। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের মাধ্যমে তারা হত্যাকা-, নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানান। সকাল থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দুপুরের পর ছাত্র-জনতার ঢল নামে এবং জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের জুমার নামাজের পর মুসল্লিরা বিক্ষোভে অংশ নেন।

গানে গানে শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি বিকালে শাহবাগে আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেন। যদিও সারাদিনের বিক্ষোভ-মিছিল শান্তিপূর্ণ ছিল, বিকালে রাজধানীর উত্তরায় পুলিশসহ ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল ছোড়ে, ফলে তিনজন গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পাওয়া যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শুক্রবার বিকালে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে মাইলস্টোন কলেজের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গণমিছিলের প্রস্তুতি নিয়েছিল। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সমর্থকরা উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের জমজম টাওয়ারের সামনে অবস্থান নেয়। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে

আওয়ামী লীগের সমর্থকরা মাইলস্টোন কলেজের দিকে থাকা শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেন। শিক্ষার্থীরাও পাল্টাধাওয়া দেন। এ সময় পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করলে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। পরে বিকাল ৫টার পরে আবার শিক্ষার্থীরা একত্র হয়ে প্রধান সড়কে ওঠার চেষ্টা করলে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এ সময় শিক্ষার্থীরা আবার ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। উত্তরায় পুলিশের রাবার বুলেটে তিনজনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তাহমিদ হুজাইফা নামে এক শিক্ষার্থী রাবার বুলেটের আঘাতে আহত হয়ে উত্তরার একটি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। উত্তরা আধুনিক হাসপাতালের এক নার্স জানান, রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়ে আসা দুই শিক্ষার্থীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী দুলাল হাওলাদার জানান, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার সময় তার মাথায় ইটের আঘাত লাগে। পরে তিনি স্থানীয় ক্রিসেন্ট হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেন।

আরও পড়ুন:  অভিনেত্রী পুনম পাণ্ডে মারা গেছেন

পুলিশের উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার তোহিদুল ইসলাম জানান, বিক্ষোভকারীরা পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ট্রেনিং স্কুলে আগুন দিয়েছে। টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হই।

শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ছাত্র শিক্ষকসহ সর্বস্তরের মানুষ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচি শুরু করে। পরে মিছিল নিয়ে হাইকোর্ট মোড়, দোয়েল চত্বর, টিএসসি হয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। এ সময় মিছিলের স্লোগানে সরকারকে ‘স্বৈরাচার’ উল্লেখ করে পদত্যাগ দাবি করা হয়। কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শ্রমিক, সংস্কৃতি কর্মী, চিকিৎসকসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ সমাবেশে অংশ নেন। দাবি মানা না হলে আগামীকাল রবিবার বিকাল ৩টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে গণমিছিল করার ঘোষণা দেন তারা।

দুপুরে প্রেসক্লাবের সামনে থেকে সরকারের পদত্যাগ দাবি করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ছাত্রদের মুক্তি দিতে হবে। কারফিউ উঠিয়ে নিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। সরকার দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাধ্যমে চক্রান্তের চেষ্টা করছে।

এর আগে গতকাল সকালে শুক্রবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে অবস্থান নেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা। সেখানে আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থী বলেন, চোখের সামনে দেখেছি একটা মানুষের মুখ দিয়ে গড়গড় করে রক্ত বেরোচ্ছে। তাকে আমরা ঠিকমতো হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি নাই। আমি আমার হাত দিয়ে বুলেট বের করেছিলাম। এটা আমার স্বাধীন দেশ? আমার স্বাধীনতা কোথায়?

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘প্রার্থনা ও গণমিছিল কর্মসূচির’ অংশ হিসেবে শুক্রবার জুমার নামাজের পর থেকেই সায়েন্স ল্যাব মোড়ে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী অবস্থান নেন। এতে নারীদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল। দুপুর আড়াইটার দিকে সায়েন্স ল্যাব মোড় থেকে মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারীরা শাহবাগে আসেন। শাহবাগে এসে ৯ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহসমন্বয়ক ও ঢাকা কলেজ শাখার অন্যতম সমন্বয়ক রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিব হোসেন। শুক্রবার বিকাল ৫টার দিকে শাহবাগ মোড়ে এ ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে সায়েন্স ল্যাবের দিকে চলে যান।

আরও পড়ুন:  শেখ হাসিনার কোনো বক্তব্য সমর্থন করে না ভারত

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, পুলিশ সরকারের আদেশে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। তারা শিক্ষার্থীদের হত্যা করেছে, শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের ওপর গণগ্রেপ্তার চালিয়েছে। এসব কিছুর বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হব না। এ সময় ঢাকা কলেজ, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, সিটি কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, এশিয়া প্যাসেফিক ইউনিভার্সিটিসহ রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।

গতকাল সকাল থেকেই ঢাকার উত্তরায় রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন অভিভাবকরাও।

বায়তুল মোকাররমের সামনে বিক্ষোভ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচির ডাকে সাড়া দিয়ে বায়তুল মোকররমের দক্ষিণ গেট থেকে কওমি শিক্ষার্থী ও সাধারণ মুসল্লিরা বিক্ষোভ মিছিল করেন। জুমার নামাজ শেষে মিছিলটি হাইকোর্ট এলাকা ঘুরে শাহবাগে যায়। মিছিলটি শাহবাগ এলাকায় যাওয়ার সময় সড়কের দুইপাশে ব্যাপক পুলিশ সদস্যের অবস্থান দেখা যায়। পুলিশের বাধা অতিক্রম করেই শাহবাগ মোড়ে অবস্থান করেন তারা। মিছিল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের দিকে ঢুকতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়।

গানে গানে শিল্পীদের প্রতিবাদ: বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিল্পী ও সাধারণ মানুষ ‘গণহত্যা ও নিপীড়নবিরোধী শিল্পীসমাজ’-এর ব্যানারে গতকাল বেলা ১১টায় ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডে আবাহনী মাঠের সামনে ছাত্র-জনতার হত্যার প্রতিবাদ করেন। নিহত হওয়ার সঠিক সংখ্যা প্রকাশ, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হত্যাকা-ের তদন্ত, বিচার ও হত্যার দায় নিয়ে সরকারের পদত্যাগের দাবি তোলেন তারা। এতে সাধারণ নাগরিকও অংশ নেন। শিল্পীরা হত্যাকা-ের দৃশ্য নিয়ে দীর্ঘ ক্যানভাসে লাল রঙের প্রতিবাদী চিত্র অঙ্কন করেন। অনুষ্ঠানে গুলিতে নিহত আবু সাঈদসহ একেক জন নিহত মানুষের নাম ডাকা হয়। আর অংশগ্রহণকারীরা ‘উপস্থিত’ বলে সাড়া দেন।

আরও পড়ুন:  টানা বর্ষণে চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা, ভোগান্তিতে নগরবাসী

কর্মসূচিতে শিল্পী মোস্তফা জামান বলেন, শিল্পীসমাজ চলমান রাষ্ট্রীয় অনাচার, অবিচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কর্তব্য মনে করে এই সমাবেশ আয়োজন করেছে। গণমানুষ রাজনৈতিক অধিকার হারিয়েছে, ভোটাধিকার বঞ্চিত হয়েছে। শিল্পীসমাজ ছাত্র-জনতার সঙ্গে সংহতি জানাতে পথে নেমেছে। এই আন্দোলন চলবে।

ইসিবি ও মিরপুর-১০ এ বিক্ষোভ : কোটা আন্দোলন ঘিরে ছাত্র হত্যার বিচার এবং গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রাজধানীর ইসিবি ও মিরপুর-১০ এ বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। বিকাল পাঁচটার দিকে ইসিবি চত্বরে দেখা যায়, কয়েক হাজার শিক্ষার্থী সেখানে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করছেন। বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে সেখানে তারা জড়ো হন। এ সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশে সতর্ক অবস্থানে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এদিকে মিরপুর-১০’এর গোলচত্বরে পুলিশ বক্সের পাশে বিকাল পাঁচটার দিকে কয়েকশ শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করে।

সাংবাদিকদের ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম: কোটা সংস্কার আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে নিহত ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক হাসান মেহেদীসহ অন্য সাংবাদিকদের হত্যার বিচার দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন সাংবাদিকরা। গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টায় রাজধানীর কারওয়ান বাজার মোড়ে ‘গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তার দাবিতে’ আয়োজিত মানববন্ধনে বক্তারা এ দাবি জানান।

 

…….ডিডিজে নিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *