জলবায়ুর ফলে ছোট হচ্ছে সুন্দরবন, হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

মোহাম্মদ ফয়সাল আলম:  সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশের ধ্বংস এবং এর ফলে জীববৈচিত্র্যের ওপর পড়া প্রভাব সম্পর্কে আপনার উদ্বেগ সত্যিই সমসাময়িক এবং গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরবন বিশ্বে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনভূমি হওয়ায় এটি বাংলাদেশের জন্য একটি অপরিহার্য সম্পদ। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানবিক ক্রিয়াকলাপগুলির কারণে এর আয়তন এবং জীববৈচিত্র্য উভয়ই বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন যে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনভূমি মানবিক ক্রিয়াকলাপ, যেমন বন উজাড়, শিল্প বর্জ্য নিষ্কাশন, এবং অপরিকল্পিত পর্যটনের কারণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বেড়ে যাওয়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, ঘন ঘন সাইক্লোন এবং নদীভাঙনও সুন্দরবনের ক্ষতির মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে।

সুন্দরবনের সংরক্ষণে বন উজাড়, অবৈধ মাছ ধরা এবং পশু শিকারের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ। স্থানীয় জনগণকে সচেতন করে এবং তাদের সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় অন্তর্ভুক্ত করে। সুন্দরবনকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে রক্ষা করতে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ। পর্যটনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে এবং পর্যটকদের জন্য সংবেদনশীল ও সচেতনতার প্রচার। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ ব্যবস্থার উপর আরও গবেষণা করে এবং জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি।

সুন্দরবনের আয়তন এবং জীববৈচিত্র্য সম্পর্কিত তথ্যগুলি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত ১০০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। সুন্দরবনের আয়তন ১৯০৪-২৪ সালে ছিল ১১,৯০৪ বর্গকিলোমিটার, যা ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১১,৫০৬ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের আয়তন ১৯০৪-২৪ সালে ছিল ৭,১৪২ বর্গকিলোমিটার, যা ২০১৫-১৬ সালে কমে ৬,৮৭১ বর্গকিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। এটি একটি বিপজ্জনক প্রবণতা, যা ইঙ্গিত দেয় যে প্রতিবছর প্রায় আড়াই বর্গকিলোমিটার বনাঞ্চল হারিয়ে যাচ্ছে, যা ফিফার ৩৫০টি ফুটবল মাঠের সমান।

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, এই বনভূমিতে রয়েছে:

  • ৫২৮ প্রজাতির বৃক্ষ ও লতাগুল্ম।
  • ৩০০ প্রজাতির পাখি।
  • ৫৮ প্রজাতির সরীসৃপ।
  • ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।
  • ৯ প্রজাতির উভচর প্রাণী।
  • ২৫০ প্রজাতির মাছ।
  • বিভিন্ন প্রজাতির কীটপতঙ্গ, কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক, এবং ছত্রাক ও শেওলা।
https://dakdiyejai.news
সুন্দরবন

এই জীববৈচিত্র্য সুন্দরবনের পরিবেশগত ভারসাম্য এবং ইকোসিস্টেমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বনাঞ্চল হারিয়ে যাওয়ার ফলে এই জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়েছে।

সুন্দরবনের এই সংকট থেকে উত্তরণে আমাদের কঠোর আইন প্রয়োগ করে বনাঞ্চল ধ্বংস রোধ করা। শিল্প ও কৃষি কার্যক্রমে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও পদ্ধতি গ্রহণ করা। স্থানীয় জনগণের মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি। সুন্দরবনের সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সহায়তা বৃদ্ধি করা। সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম ও জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে আরও গবেষণা করা এবং নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতি বিকাশ করা।

আরও পড়ুন:  সংগ্রহ করা হলো সচিবালয়ের ভেতরের সিসিটিভি ফুটেজ

সুন্দরবন এবং এর সাথে যুক্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার উদ্বেগ যথেষ্ট যৌক্তিক এবং বাস্তবিক। সুন্দরবনের গুরুত্ব শুধুমাত্র একটি প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে নয়, বরং বাংলাদেশের পরিবেশগত ভারসাম্য এবং নিরাপত্তার জন্যও অপরিহার্য।

সুন্দরবনের গুরুত্ব: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনভূমি ঘূর্ণিঝড় এবং সমুদ্রের উচ্চ তরঙ্গ থেকে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলকে সুরক্ষা দেয়। এটি একটি প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে কাজ করে যা উপকূলীয় এলাকায় বন্যা এবং ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সহায়ক। সুন্দরবনে বহু প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ বাস করে, যা বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করে। এই জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে সুন্দরবনের সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরবন কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করে এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমাতে সহায়তা করে।

সুন্দরবনের সমস্যাগুলো: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সুন্দরবনের উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অবৈধ শিকার এবং বনের সংস্থানগুলির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদকে হুমকির মুখে ফেলছে। দূষণ এবং বিষ দিয়ে মাছ ধরার ফলে সুন্দরবনের জলজ প্রাণী এবং মৎস্যসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অবৈধভাবে গাছ কাটার ফলে বনাঞ্চল ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে এবং এটি পরিবেশের উপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা সুন্দরবনের সুরক্ষা প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করছে।

প্রস্তাবিত পদক্ষেপ: অবৈধ শিকার, গাছ কাটা এবং দূষণ রোধে কঠোর আইন এবং নিয়মাবলী প্রয়োগ করা। স্থানীয় জনগণকে সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি এবং পদ্ধতির প্রচলন করা, যা সুন্দরবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমাবে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সহায়তা বাড়িয়ে সুন্দরবনের সুরক্ষা প্রচেষ্টাকে সমৃদ্ধ করা। সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর গবেষণা বৃদ্ধি করা এবং নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতির উন্নয়ন করা।

https://dakdiyejai.news/
সুন্দরবন

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য অত্যন্ত মূল্যবান এবং সংরক্ষণে আমাদের সকলের একযোগে কাজ করা প্রয়োজন। সুন্দরবনের বিপন্ন প্রাণীদের মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মেছো বাঘ, ছোট মদন টাক, গ্রেট নট পাখি, রাজগোখরা, জলপাই রঙের কাছিম, দুই প্রজাতির ডলফিন (ইরাবতী ও গাঙেয়), দুই প্রজাতির উদবিড়াল এবং লোনা পানির কুমির উল্লেখযোগ্য।

আরও পড়ুন:  গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান বিবেচনা করবে নিরাপত্তা পরিষদ

সুন্দরবনের বিপন্ন প্রাণীরা: সুন্দরবনের প্রধান প্রতীক, তবে শিকারের কারণে এদের সংখ্যা হুমকির মুখে। এরা জলের আশেপাশে বসবাস করে এবং মাছ ও ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী খায়। এদের সংখ্যা কমে যাওয়ার মূল কারণ হলো বাসস্থান হারানো এবং শিকার। এদের সংখ্যাও ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে, বিশেষ করে বিষাক্ত জলে বাস করার কারণে। সুন্দরবনের জলজ জীবের অন্যতম, কিন্তু দূষণ এবং নৌকার প্রপেলার আঘাতে এদের জীবন হুমকির মুখে। এদের সংখ্যা কমছে এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য এটি একটি বিপজ্জনক সংকেত।

সুন্দরবন সংরক্ষণে পদক্ষেপ: সুন্দরবনের সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শ এবং সুপারিশ অনুসরণ করা জরুরি। প্রাণীদের বাসস্থান পুনরুদ্ধারের জন্য পুনর্বনায়ন প্রকল্প চালু করা। শিকার বন্ধে কঠোর নিয়মাবলী প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা। পর্যটনের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং পরিবেশবান্ধব পর্যটন ব্যবস্থা চালু করা। স্থানীয় জনগণ এবং পর্যটকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কর্মশালার গুরুত্ব: সম্প্রতি রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এবং এর সুরক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করেছেন। এই কর্মশালায় বলা হয়েছে যে সুন্দরবনের আয়তন কমে যাওয়ার প্রবণতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং এটি বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

সুন্দরবনের জলাধার এবং কাঁকড়া বিচরণস্থলের হ্রাস এবং সুপার সাইক্লোন সিডরের ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে আপনার উদ্বেগ খুবই যৌক্তিক এবং জরুরি। সুন্দরবনের জলাধার এবং কাঁকড়া বিচরণস্থলের হ্রাস:

  • জলাধার: ২০১০ সালে যেখানে সুন্দরবনের জলাধারের আয়তন ছিল ৪৪৮ হেক্টর, তা ২০২০ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৩২২ হেক্টরে।
  • কাঁকড়া বিচরণস্থল: ৩,১১৫ হেক্টর থেকে কমে ১,৬৩৪ হেক্টরে নেমে এসেছে।

সুপার সাইক্লোন সিডরের প্রভাব: সুন্দরবনের ১০ শতাংশ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে।

জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণে পদক্ষেপ: বন ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় লোকজনকে সহযোগী হিসেবে গড়ে তোলা। এই প্রোটোকল অর্জনে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। সুন্দরবনের মৎস্যসম্পদ কমে যাচ্ছে, এটি রক্ষা করতে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সমাধান খুঁজতে হবে। জেলেরা যেন নিয়ম মেনে মাছ ধরেন সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।

আরও পড়ুন:  ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজসহ ৪ আসামি ৩ দিনের রিমান্ডে

প্রাকৃতিক সমাধান: পরিকল্পিতভাবে গোলপাতার গাছ রোপণ করে এটি বাড়তে দিতে হবে। যে মাছগুলো বিপন্ন সেগুলো ধরা থেকে বিরত রাখতে হবে এবং জালের ব্যবহারেও নিয়ম মেনে চলতে হবে।

বিলুপ্ত প্রাণী এবং মাছ: ইতিপূর্বে সুন্দরবন থেকে গণ্ডার, বনমহিষ, মিঠাপানির কুমির, এক প্রজাতির হরিণ, চিতা বাঘ এবং ৪ প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়েছে। বিলুপ্ত হতে চলেছে ১৯ প্রকার মাছ।

সুন্দরবনের গুরুত্ব শুধু জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত দিকেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এটি দেশের বনজ সম্পদের একক বৃহত্তম উৎস এবং বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহকারী।

সুন্দরবনের অর্থনৈতিক পরিবেশগত ভূমিকা: কাঠের ওপর নির্ভরশীল শিল্পের কাঁচামাল জোগান দেয়। ঘর ছাওয়ার পাতা, মধু, মৌচাকের মোম, মাছ, কাঁকড়া ও শামুক-ঝিনুক আহরণ। বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন উদ্ভিদ এবং প্রাণীজ সম্পদ সরবরাহ করে। পানি বিশুদ্ধ করতে সহায়ক। পলি সঞ্চয় করে মাটি রক্ষা করে। ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করে। উপকূলীয় এলাকা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ সরবরাহ করে। পর্যটকদের আকর্ষণ করে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা: সুন্দরবন সিডর, আইলা, ফণী, আম্ফান, বুলবুলসহ ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় প্রাকৃতিক প্রাচীর হিসেবে কাজ করেছে। ম্যানগ্রোভ বনভূমি ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব কমিয়ে দেশকে রক্ষা করেছে। অবৈধ শিকার, বন উজাড়, দূষণ ইত্যাদি কারণে সুন্দরবন হুমকির মুখে পড়েছে। সুন্দরবনের আয়তন কমে আসার ফলে প্রতিবেশ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং গাছপালা, লতাগুল্ম ও প্রাণীর সংখ্যা কমছে। সুন্দরবনের নদী ও খালের পাড় ভাঙন ঠেকানো যায়নি।

সুন্দরবন রক্ষা করা শুধু দেশের পরিবেশগত ভারসাম্য এবং জীববৈচিত্র্যের জন্যই নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরবন সংরক্ষণে আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *