দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে গত শনিবার রাতে অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্রসেনার বিক্ষোভ, হাইকমিশনারকে হত্যার হুমকি এবং প্রধান উপদেষ্টার কুশপুতুলে আগুন দেওয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গতকাল রোববার বলেন, দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন কূটনৈতিক এলাকার বেশ ভেতরে। সে পর্যন্ত হিন্দু চরমপন্থি সংগঠনের ২৫ জনের দলকে যেতে দেওয়া হয়েছে।
বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তৌহিদ হোসেন বলেন, এ বিষয়ে ভারতের প্রেসনোটে যা বলা হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যান করে। কারণ, যত সহজভাবে উত্থাপন করা হয়েছে, বিষয়টি এত সহজ নয়। এমনটা নয়, হাইকমিশন বাইরে কোনো জায়গায় বা কূটনৈতিক এলাকার শুরুতে অবস্থিত।
তিনি বলেন, তারা (ভারত) বলছে, ২০-২৫ জনের একটি দল, সংখ্যা কমবেশি হতে পারে, সেটা কথা নয়। ২৫ জনের একটা হিন্দু চরমপন্থি সংগঠনের একটি দল এতদূর (বাংলাদেশ হাইকমিশন) পর্যন্ত আসতে পারবে কেন, সুরক্ষিত একটি এলাকার মধ্যে! তার মানে, তাদের আসতে দেওয়া হয়েছে। সাধারণত আসতে পারার কথা নয়।
প্রসঙ্গত, ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্রসেনার ব্যানারে বাংলাদেশের হাইকমিশনের সামনে এসে বিক্ষোভ হয়। তারা প্রায় ২০ মিনিট ব্যানার নিয়ে বাংলাদেশ হাউসের সামনে অবস্থান করে এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশবিরোধী স্লোগানের পাশাপাশি ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহকে হুমকি দেয়।
উপদেষ্টা বলেন, সেখানে দাঁড়িয়ে (হাইকমিশনের সামনে) তারা হিন্দু নাগরিকের হত্যার প্রতিবাদে স্লোগান দিয়ে চলে গেছে, তা কিন্তু নয়। আরও অনেক কিছু বলেছে, সেটা আমরা জানি। বাংলাদেশের পত্রিকায় যে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে, সেটিকে ভারত বলছে বিভ্রান্তিমূলক– এটি সত্য নয়। বাংলাদেশের পত্রিকায় সঠিক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমার কাছে প্রমাণ নেই। কিন্তু আমরা শুনেছি, তাকে (বাংলাদেশ হাইকমিশনারকে) হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। সেখানে এসে তাকে হুমকি দেবে কেন এবং এ পর্যন্ত আসতে পারবে কেন! সাধারণত কোনো বিক্ষোভ দল যখন কোনো কূটনৈতিক মিশনের দিকে যায়, সেটা আগে থেকে জানানো হয় এবং পুলিশ আগে থেকে দূরে একটি জায়গায় তাদের আটকে দেয়। যদি কোনো প্রতিবাদলিপি দেওয়া থাকে, তাহলে দুয়েকজন গিয়ে সেটি হস্তান্তর করে আসে। এটি হচ্ছে সাধারণ নিয়ম। সবখানে এটি হয়, আমাদের দেশেও হয়।
তিনি বলেন, একজন বাংলাদেশি নাগরিক নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। এর সঙ্গে সংখ্যালঘুর নিরাপত্তাকে এক করে ফেলার মানে হয় না। যাকে হত্যা করা হয়েছে, তিনি বাংলাদেশের নাগরিক এবং এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যেভাবে এটিকে উপস্থাপন করা হয়েছে, গ্রহণযোগ্য না। আমরা মনে করি, কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তার স্বাভাবিক যে নিয়ম আছে, সেখানে তা ঠিকমতো পালন হয়নি। তবে মিশনের নিরাপত্তার বিষয়টি তারা দেখার কথা জানিয়েছে, আমরা সেটি নোট নিয়েছি।
এর আগে আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়েছে, ফলে ভারতে থাকা বাংলাদেশ মিশনগুলোতে কোনো নিরাপত্তার ঝুঁকি দেখছেন কিনা– উত্তরে তৌহিদ হোসেন বলেন, আমরা বিষয়টিতে সংবেদনশীলতা দেখিয়েছি। আশা করব, এ ধরনের পরিবেশ আর কখনও ভারতে সৃষ্টি হবে না।
ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সদস্য সংখ্যা কমিয়ে ফেলা হবে কিনা– উত্তরে তিনি বলেন, যদি তেমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তাহলে আমরা সেটা করব। এখন পর্যন্ত আমরা ভরসা রাখছি, ভারত যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেবে।
ভারতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোনো ঘাটতি ছিল? উত্তরে উপদেষ্টা বলেন, তারা (হিন্দু চরমপন্থি সংগঠনের সদস্যরা) এসেছে, কিছু স্লোগান দিয়েছে, বিষয়টি শুধু এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশ মিশনের ভেতরে হাইকমিশনার ও তার পরিবার বাস করে। তারা কিন্তু হুমকি অনুভব করেছে এবং আতঙ্কিত হয়েছে। কারণ, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। দুজন রক্ষী ছিল। তারা চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০২৪ সালের ২ ডিসেম্বর আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা চালায় হিন্দু সংঘর্ষ সমিতিসহ কয়েকটি সংগঠনের সমর্থকরা।
২০-২৫ যুবক জড়ো হয়েছিল: ভারত
বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভের ঘটনায় জবাব দিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আমরা বাংলাদেশ সংবাদমাধ্যমের কিছু অংশে এই ঘটনা নিয়ে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা লক্ষ্য করেছি। বাস্তবতা হলো, ২০ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে প্রায় ২০-২৫ যুবক জড়ো হয়েছিল। তারা ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাস হত্যার প্রতিবাদে স্লোগান তুলেছিল। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার আহ্বান জানিয়েছিল। কোনো সময় বেড়া ভাঙার বা নিরাপত্তা নাজুক করার চেষ্টা করা হয়নি। পুলিশ কয়েক মিনিট পরে দলটিকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ ঘটনার দৃশ্যমান প্রমাণ সবার জন্য প্রকাশ্যে পাওয়া যায়। ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে ভারত তার ভূখণ্ডে বিদেশি মিশন/পোস্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতির ওপর ভারত নিবিড় নজর রাখছে। আমাদের কর্মকর্তারা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। আমরা হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছি।’
নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি লক্ষ্য করেছি: ঢাকা
এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় বিজ্ঞপ্তিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের বাসভবনে ঘটে যাওয়া অযৌক্তিক ঘটনা দুঃখজনক। দুর্বৃত্তদের হাইকমিশনের বাইরে কার্যকলাপ চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ফলে কমপ্লেক্সের ভেতরে কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। হাইকমিশনকে এই সংগঠিত অনুষ্ঠান সম্পর্কে আগাম তথ্য দেওয়া হয়নি। তবে, আমরা ভারতে অবস্থিত সব বাংলাদেশি কূটনৈতিক পোস্টের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ভারত সরকারের প্রতিশ্রুতি লক্ষ্য করেছি।
এক হিন্দু নাগরিকের ঘটনাকে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হিসেবে চিত্রিত করার ভারতীয় কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টাকে আমরা প্রত্যাখ্যান করি। বাংলাদেশ সরকার এ ঘটনায় সন্দেহভাজনদের তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অনেক অঞ্চলের তুলনায় বাংলাদেশের আন্তঃসাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ভালো। বাংলাদেশ বিশ্বাস করে, এই অঞ্চলের সব সরকারের কর্তব্য সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।






