বীর মুক্তিযোদ্ধা এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের ফিউনারেল প্যারেড অনুষ্ঠিত

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ, জাতির গর্বিত কৃতী সন্তান এবং সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল আব্দুল করিম খন্দকার, বীর উত্তমের (অব.) ফিউনারেল প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি বাশার প্যারেড গ্রাউন্ডে রবিবার মরহুমের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।

এর আগে, শনিবার সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর ১১ মাস ২০ দিন। তিনি দুই পুত্র, এক কন্যা ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত থেকে মরহুমের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। রাষ্ট্রপতির পক্ষে সামরিক সচিব, উপদেষ্টা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সম্মানিত সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত থেকে মরহুমের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন।

এছাড়াও অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার, বীর উত্তমের (অব.) পরিবারের সদস্যগণ, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ, সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ এবং অন্যান্য পদবীর সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ফিউনারেল প্যারেড শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে বিমান বাহিনী ঘাঁটি বাশার এ অবস্থিত শাহীন কবরস্থানে দাফন করা হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধার সম্মানার্থে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী কর্তৃক ফ্লাই পাস্ট অনুষ্ঠিত হয়।

আরও পড়ুন:  নাশকতাকারীদের কঠোর হাতে দমনের আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

বীর মুক্তিযোদ্ধা এয়ার ভাইস মার্শাল আব্দুল করিম খন্দকার ১ জানুয়ারি ১৯৩০ সালে পাবনার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম খন্দকার আব্দুল লতিফ এবং মাতার নাম মরহুমা আরেফা খাতুন। তিনি মালদা জেলা স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন, রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং পিএএফ কলেজ, রিসালপুর থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ৫ জানুয়ারি ১৯৫১ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনী একাডেমীতে যোগদান করেন এবং ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫২ সালে জিডি (পি) শাখায় কমিশন লাভ করেন। এয়ার ভাইস মার্শাল আব্দুল করিম খন্দকার ছিলেন একজন চৌকস ফাইটার পাইলট। বিমান বাহিনীতে চাকরিকালীন তিনি L-19, T-6G, Tempest, Fury, T-33, F-5 এবং F-86 বিমান-এ সফলতার সাথে ৩৪০০ ঘণ্টারও অধিক উড্ডয়ন পরিচালনা করেন। চাকরিকালীন কর্মকর্তা দেশ-বিদেশে বিভিন্ন কোর্সে অংশগ্রহণ করেন এবং সফলতার সাথে তা সম্পন্ন করেন। তিনি জেট ইন্সট্রুমেন্ট রেটিং কোর্স, ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টরস কোর্স এবং এয়ার স্টাফ কোর্স অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করেন।

এয়ার ভাইস মার্শাল আব্দুল করিম খন্দকার, বীর উত্তম ১৯৭১ সালে ঢাকাস্থ পাকিস্তান বিমান বাহিনী ঘাঁটিতে সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে নিযুক্ত থাকাকালীন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি তার অধীনস্ত সাতজন বাঙালি কর্মকর্তা এবং কিছু সংখ্যক বিমানসেনা নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ১২ মে ১৯৭১ সালে ঢাকা থেকে ত্রিপুরার উদ্দেশে রওয়ানা হন এবং ১৫ মে ১৯৭১ তারিখে ত্রিপুরার মতিন নগরে পৌঁছান। তৎকালীন মুজিবনগর সরকার তাকে মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ পদে নিযুক্ত করেন। তিনি মুক্তিবাহিনীর অপারেশন্স এবং প্রশিক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এ দায়িত্ব পালনে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক অবস্থা ব্যক্তিগতভাবে পর্যবেক্ষণ এবং নিরীক্ষণ করতেন যা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী ও উদ্যমী ভূমিকা রাখতে সহায়তা করে। এ সময় তিনি ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে প্রথম বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠন করেন। তিনি মাত্র ০৯ জন কর্মকর্তা, ৫৭ জন বিমানসেনা ও ০৩টি বিমান দ্বারা গঠিত এ বাহিনী নিয়ে ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অভিযান পরিচালনা করেন।

আরও পড়ুন:  সচিবালয়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে সেনাবাহিনী

এ বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধি এবং মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার জন্য তিনি ১৯৭২ সালে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত হন।

স্বাধীনতার পর ০৭ এপ্রিল ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান হিসেবে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীনতা উত্তর মাত্র দুই বছরের মধ্যে ০১টি ফাইটার স্কোয়াড্রন, ০১টি হেলিকপ্টার স্কোয়াড্রন এবং ০২টি র‌্যাডার ইউনিট এই বাহিনীতে সংযোজন করতে সফলতা অর্জন করেন। তিনি বিমান বাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জাতীয় পতাকাবাহী বাংলাদেশ বিমানের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৭২-১৯৭৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে এই সংস্থাটিকে সুসংহত করার প্রয়াস পান। তিনি ১৫ অক্টোবর ১৯৭৫ তারিখে দীর্ঘ ২৩ বছর ১৯ দিন কমিশন চাকরি সমাপনান্তে বিমান বাহিনী প্রধান হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

আরও পড়ুন:  কাশ্মীর সীমান্তে রাতভর ভারত-পাকিস্তানের গোলাগুলি

এয়ার ভাইস মার্শাল আব্দুল করিম খন্দকার, বীর উত্তম ১৯৭৬-১৯৮২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় এবং ১৯৮২-১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা ও পরবর্তীতে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় মুক্তি বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে তার অসামান্য অবদান, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে একটি সুসংগঠিত ও কার্যকরী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা এবং সর্বোপরি স্বাধীনতা পরবর্তীকাল হতে অদ্যাবধি দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকে দেশ গঠনে অক্লান্ত পরিশ্রমের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১১ সালে তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ক্ষণজন্মা এই সাবেক বিমান বাহিনী প্রধানের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ গত ১০ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে তার নামে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘাঁটির নামকরণ করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *