একজন আনিসুল হক ও কিছু অমলিন স্মৃতি

আনিসুল হক। নামেই যার পরিচয়। ২০১৭ সালের এই দিনে যুক্তরাজ্যের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।  রাজধানীকে পরিচ্ছন্ন করার কিছু উদ্যোগ নিয়ে প্রশংসিত হন তিনি। নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মৃত্যুর নীল কুয়াশায় হারিয়ে গেছেন ৮ অছর আগে। মৃত্যুর পরেও তিনি আলোচনায় রয়েছেন সমান।  ২০১৫ সালে  ঢাকা উওরের মেয়র নির্বাচিত হন। রাজধানীকে পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ ও ‘স্মার্ট’ নগরী হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়ে আলোচিত ও প্রশংসিত হন আনিসুল হক। ডিএনসিসির মেয়র হিসেবে মাত্র দুই বছর দুই মাস ২৪ দিন দায়িত্ব পালন করেন। এই স্বল্প সময়ে তিনি ঢাকাবাসীকে দেখিয়েছিলেন বিশ্বমানের নগরী গড়ার স্বপ্ন।
টিভি উপস্থাপক হিসেবে ৮০ ও ৯০-এর দশকে তার সুনাম ও পরিচিত ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে ৮০-এর দশকে বিটিভিতে ‘বলা না বলা’ এবং ‘জানতে চাই’ নামের অনুষ্ঠান দুটি উল্লেখযোগ্য। তবে ‘সবিনয়ে জানতে চাই’ নামের একটি এক পর্বের অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মাধ্যমে উপস্থাপক হিসেবে আনিসুল হক তুমুল জনপ্রিয়তা পান। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক নেতা বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা তার এই অনুষ্ঠানে প্রথম এবং শেষ বারের মতো মুখোমুখি বসেন। আনিসুল হক সে সময় এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সাধারণে গ্রহণযোগ্যতার শীর্ষে পৌঁছে যান।
২০১২ সালে হোটেল সোনারগাঁওইয়ে একটি অনুষ্ঠানে আনিসুল হকের সাথে আমার আলাপ পরিচয় ঘটে। এরপর, জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুর পর শেষ শ্রদ্বা জানাতে মরদেহ শহীদ মিনারে অানা হলে সেখানে দ্বিতীয় দফায় সাক্ষাত হয় তাঁর সাথে। এরপরে তিনি এনটিভির ক্যামেরার সামনে কথা বললেন হুমায়ুন আহমেদের উপরে। 
হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে কিছু মূল্যায়ন করার সুযোগ আমারও এলো। আমার পাশে ছিল সুশান্ত দাদা। অন্যদিকে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আলী ইমাম পাশাপাশি হুমায়ুন প্রেমী পাঠকদের কাছ থেকে অনুভূতি নিচ্ছিলেন। আমি এনটিভির সাথে কথা বলতে দেখে আলি ইমামের নজরে পড়লাম। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন হুমায়ুন আহমেদ নিয়ে আমার মূল্যায়ন।
স্পষ্ট মনে আছে সেদিন সাদা শার্ট কালো প্যান্ট পরিহিত একজন আনিসুল হকের দিকে আমি তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। তারপরে আরো বহুদিন বহুবার নানান অনুষ্ঠানে তাঁর মুখোমুখি হয়েছি। কথা বলেছি। সেই থেকে তাঁর নজর এড়ায়নি। ভালো লাগতো তাঁর কথা বলার ধরণ, স্টাইল। বলা যায় আমি আনিসুল হকের একজন গুণমুগ্ধ ছিলাম।
আমার কাছে তিনি অনুকরণীয় মানুষ ছিলেন। আশির দশকে টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মাধ্যমে তাঁর পরিচিতি- ঘটে। ব্যাপক তারকা খ্যাতিও অর্জন করে ছিলেন। দেশের বরেণ্য মানুষের তালিকায় তিনি অনেকের মতো আমার কাছে প্রিয়ভাজন ছিলেন। বিটিভিতে তাঁর অনুষ্ঠান যখন বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো ঠিক সেই সময়ে অসংখ্য তরুণীরা রক্ত দিয়ে চিঠি লিখেছিল প্রিয় আনিসুল হকের কাছে।
২০১৫ সালের ঢাকা সিটির নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী ছিলেন আনিসুল হক। নির্বাচনী প্রতীক ছিলো ‘দেয়াল ঘড়ি’। লোটাস কামাল টাওয়ারের ১৬তলায় “আমরা ঢাকা” নামে একটি প্রচারণায় তরুণদের সামনে নিয়মিত কথা বলতেন আনিসুল হক।সমাধান যাএার আমি সারথি হয়েছিলাম নির্বাচনের ১৬ দিন আগে। লোটাস কামাল টাওয়ারে প্রায় যাতাযাত ছিলো আমার।ঢাকার শত শত তরুণরা আনিসুল হকের প্রেমে অন্ধ হয়ে আসতো।প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে ৪ টা পর্যন্ত তিনি ঢাকার সমস্যা ও সমাধান যাএা নিয়ে কথা বলতেন। তাঁর সহধর্মিণী রুবানা হক,তাঁর ছেলের মুখে তাদের পারিবারিক গল্প শুনতাম। যদিও আনিসুল হক সম্পর্কে আমার বিশদ ধারণা ছিলো তার পূর্বে থেকে।
অসংখ্য তরুণ তরুণীদের প্রশ্নবানে তিনি জর্জরিত হতেন তখন। তাঁর কথার দ্যুতিময়তা দিয়ে তিনি মুগ্ধতা ছড়াতে পারতেন বলেই ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতাম। অনেকের মতো আনিসুল হকের কাছে ঢাকা নিয়ে নানান প্রশ্ন সেই দাবি জানিয়েছেন। আমি শুধু মশা মুক্ত, যানজটমুক্ত ঢাকার পক্ষে দাবি জানিয়েছিলাম।হাউজে শতাধিক তারুণ্যের কাছে অন্য ইস্যু প্রাধান্য পেলেও,আমার মুখে মশক নিধনের পরিকল্পনাকে প্রথমে প্রাধান্য দিয়ে বক্তব্য রেখেছি বলে অনেকে সেদিন সমস্বরে হাসলেন।আমি কিছুটা বিব্রত হয়েছিলাম তখন। উওরে তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন আপনি কেন মশক নিধনকে প্রথমে জোড় দিতে বললেন? উত্তরে বলেছি – আপনি রাজধানীর অভিজাত এলাকার বাসিন্দা, মশা নগরবাসীর জন্য কতটা অভিশাপ? আর যানজট সবার প্রতিদিনের জীবন যন্ত্রণা,কর্মঘন্টা ধ্বংস করে। আনিসুল হক আমার দাবির প্রশংসা করেছেন সেই সাথে স্বীকার করেছেন এই দুটি সমস্যা নিরসন কতটা জরুরি ও ইউনিক।প্রতিদিনই এই দাবি জানিয়েছি।
আমি নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারিনি। তাঁর প্রতি অগাধ-ভালোবাসা আমাকে নির্বাচনী প্রচারণা, গণসংযোগে নামিয়েছে। যার ফলে প্রায় ৪০টির বেশি ওয়ার্ডে তাঁর সাথে গণসংযোগে অংশ নিয়েছিলাম।মোহাম্মদপুর, শ্যামলী,কল্যাণপুর,টেকনিক্যাল, মিরপুরের আশ পাশে,কাফরুল,শেওড়াপাড়া,স্টেডিয়ামসহ মিরপুর ১,২,৬,১০,সারো ১১, মিরপুর ১৪, সেই সাথে অসংখ্য বস্তি এলাকা চষে বেড়িয়েছি ‘আমরা ঢাকা’র সমাধান যাএা টিমের সাথে।আনিসুলের বক্তব্য শুনতে মানুষের উৎসাহ ছিলো প্রচুর।আমি দেখেছি খুব কাছ থেকে গারো নেভী ব্লু টি শার্ট ঘামে ভিজে যেতো।বক্তব্য দিতে দিতে আনিসুল হকের শব্দ আসতো না।তবুও তার প্রচেষ্টায় তিনি নির্বাচনে ঢাকাবাসীর জোড়ালো সমর্থন তাঁর পক্ষে গেছে।গণজোয়ারে তিনি বিজয়ের মুকুট পড়তে পেরেছিলেন। নির্বাচনের বেশ কদিন আগে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনিষ্টিটিউডে “শিশুদের জন্য নিরাপদ ঢাকা” নামে একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন আনিসুল হক, নাদের চৌধুরীসহ ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থী সাঈদ খোকন ও জোনায়েদ সাকি।
অনুষ্ঠান শেষে আনিসুল হকের গাড়ি বহরে আমাকে দেখে নাদের চৌধুরী বলেই ফেললেন তারেক তোমাকে মনে হয় আমি হারিয়েছি। আমি বিব্রত হয়েছিলাম। নাদের চৌধুরীর একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাই, ফলে তিনি ভেবেছিলেন তার সাথে কাজ করবো, সময় দিবো কিন্তু না সেটা হয়নি। আমি দলীয় নির্বাচনের প্রার্থীর জন্য কাজ করেছি স্ববিবেচনায়। তিনি যে শুধু দলীয় প্রার্থী তা কিন্তু নয়,অানিসুল হক আবাল্য প্রিয় নাম, প্রিয় ব্যক্তিত্ব।
যদিও তিনি আজ শুধু ফ্রেমে বাঁধা ছবি। কিন্তু এটাও সত্য তিনি বেঁচে থাকবেন আজীবন এদেশের কোটি মানুষের হ্রদয়ে। দূর দিগন্তের ওপার থেকে অনুপ্রেরণা জোগাবেন অসংখ্য তারুণ্যের স্বপ্নের ক্যানভাসে। নিঃসন্দেহে তিনি দর্শক প্রিয়তা পেয়েছিলেন। নন্দিত একজন সফল উপস্থাপকের সকল গুণাগুণ তাঁর মধ্যে উপস্থিত ছিলো। মিডিয়ার পাশাপাশি নিজেকে একজন শিল্পদ্যোক্তায় পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফ বিসিসিআইয়ের সভাপতিও হয়েছেন। সামাজিক,সাংস্কৃতিক,অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক কোথায় নেই তিনি। নিজকে একজন দক্ষ নগর প্রশাসক হিসেবে প্রমাণিত করেছেন সমস্যার শহর ঢাকাতে। সবুজ ঢাকা গড়তে এমন সবুজ হ্রদয়ের মানুষের অভাব ছিলো দীর্ঘদিন। অথচ,ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, তিনি আমাদের মাঝে নেই। অনন্তে যাএী হয়েছেন তিনি। নিরন্তর যিনি মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন একটি সবুজ ঢাকা গড়তে। সবুজ ঢাকার সবুজ মানুষটির প্রয়োজন অনুভব করে তাঁর প্রিয় ঢাকা।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *