দিলাল রাজার ও তার বংশধরেরা

ইকবাল  সারওয়ার সোহেল
সন্দ্বীপের শেষ স্বাধীন শাসক দেলোয়ার খাঁ (দিলাল রাজা নামে যিনি অধিক পরিচিত) বাংলাদেশের সন্দ্বীপের শেষ স্বাধীন শাসক ছিলেন। একজন শক্তিশালী ও দানশীল শাসক হিসেবে তার খ্যাতি ছিল, যার কারণে তাকে বাংলার রবিন হুড নামে অবিহিত করা হয়। তিনি ধনীদের থেকে চুরি করে গরীবদের উপহার দিতেন। তাঁর জীবনী আজও জনপ্রিয় এবং সন্দ্বীপের স্থানীয় লোককাহিনী ও অদ্ভুত কেচ্ছায় তাঁর নাম পাওয়া যায়। তাঁকে সতেরশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী বাঙ্গালী মুসলিম শাসক হিসেবে গণ্য করা হয়।
বলা হয়ে থাকে, পর্তুগিজদের যুদ্ধে হারিয়ে সন্দ্বীপের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন দিলাল রাজা। দিলাল রাজা একটানা প্রায় ৫০ বছর সন্দ্বীপ শাসন করেন। ১৬১৬ থেকে ১৬৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি স্বাধীনভাবে সন্দ্বীপের রাজা ছিলেন, গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও মুদ্রাব্যবস্থা। 
সম্ভবত ১৫৮৫ সালে ঢাকায় দেলওয়ার খাঁর জন্ম হয়েছে। তাঁর ছোটবেলা নিয়ে আনেক জনশ্রুতি আছে। কয়েকটি বর্ণনায় কথিত আছে যে শিশু দিলাল তাঁর মায়ের সাথে জাহাজে ছিলেন। জাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে তারা সন্দ্বীপের সৈকতে পড়েন। সন্দ্বীপ পর্তুগিজ জলদস্যুতার জন্য তখন পরিচিত ছিল। লোককাহীনি অনুযায়ী একটি কোবরা শিশু দিলালকে রোদ থেকে রক্ষা করেছিল। ভবিষ্যৎ-এ সন্দ্বীপের ইতিহাসে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে দিলাল, এই ঘটনা তাই যেন প্রমাণ করে।
ইতিহাসবিদদ্বয় সৈয়দ মুর্তাজা আলী এবং মুহাম্মদ আব্দুল কাদের বলেন যে দিলালের মাতৃভূমি ঢাকায় ছিল। তিনি মুঘল নৌবাহীনিতে কর্মরত ছিলেন। যদুনাথ সরকারের বর্ণনায় দিলাল ছিল মুঘল নৌবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যিনি পালিয়ে নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
যেহেতু বহু দশক ধরে সন্দ্বীপে জলদস্যুতা প্রভাব ছিল, এভাবে অনেক লোকই সন্দ্বীপকে শাসন করেছিল। পর্তুগিজ জলদস্যু সেবাস্তিয়ান গঞ্জালেস তিবাঁওকে পরাজিত করার পর আরাকান রাজ্য ক্ষমতা গ্রহণে সফল হয়। মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে ও ইবরাহিম খান ফতেহ জঙ্গ বাংলার সুবাহদার থাকাকালে দিলাল ঢাকার মুঘল নৌবাহিনীর একজন অধিনায়কের চাকরী পান। সন্দ্বীপ দখল করার জন্য দিলাল এই দায়িত্ব থেকে গোপনে পদত্যাগ করেন ও সন্দ্বীপে তিনি তার খান্দান এবং ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী নিয়ে স্বাধীনভাবে শাসন করতে শুরু করেন। সৈয়দ মুর্তাজা আলীর মতে, আরাকানের মগদের বিরুদ্ধে মুঘলদের যুদ্ধ শুরু হওয়ায় দিলাল শান্তিপূর্ণভাবে সন্দ্বীপ শাসন করতে পেরেছেন। কেন যে দিলাল একটি স্থিতিশীল চাকরী থেকে পদত্যাগ করেছিলেন এবং নিজের জন্য বিপজ্জনক স্বাধীন জীবনধারা বেছে নিয়েছিলেন, তা অজানা। তিনি প্রায় ৫০ বছর শাসন করেন, যেটা ১৬১৬ থেকে ১৬২২ সালের মধ্যে যেকোন একসময় শুরু হয়েছিল। দিলালের ছেলে শরীফ খাঁন মুঘল অধীনস্থ ৫০০ সেনানীর মনসবদার নিযুক্ত হয়েছিলেন।
ইংরেজ ভ্রমণকারী স্যামুয়েল পরচাস লিখেছেন, সন্দ্বীপের মুসলমান সংখ্যাগুরু হলেও দিলাল সংখ্যালঘু হিন্দুদের সাথে ন্যায্য আচরণ করতেন। দিলালের বিচার ব্যবস্থা ছিল অনন্য। তার একটি আইন ছিল যে ঝগড়ার পরে উভয় পক্ষকে একই জায়গায় দাঁড়াতে হবে এবং দিলালের আগমন ও রায়ের পরেই স্থান ত্যাগ করা যাবে। দিলাল প্রয়োজনে স্বজনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও দ্বিধা করেননি বলে জানা গেছে। তিনি হিন্দুত্ববাদের জাতি-বর্ণ ভেদাভেদকেও অস্বীকার করতেন।
শত্রু বা সামরিক কৌশলের হাত থেকে সন্দ্বীপের হেফাজতের ক্ষেত্রে, দিলালের অত্যন্ত কঠোর নীতি ছিল। সন্দ্বীপের একমাত্র রাস্তাটি খাড়ির মধ্য দিয়ে ছিল। এটি দ্বীপটিকে মূল ভূখণ্ড থেকে পৃথক করেছে। এটি ছিল অগভীর এবং সরু। দিনে দুইবার জোয়াড় আসতো এবং তখনই এই খাড়ি নৌকা চলাচলের উপযোগী হতো। এই জন্যই কোন নৌকাই বেশিক্ষণ এই খাড়িতে অবস্থান করতে পারতো না। এই খাড়ির মুখে তিনি একটি কেল্লা তৈরি করেছিলেন যেখান থেকে যেখান থেকে সহজেই যেকোন বহিঃশত্রুর আক্রমণ রুখে দেওয়া যেত। দ্বীপের অভ্যন্তরে তার মহলটি ছিল একটি কেল্লা, যার চারপাশে খাদ এবং পিছনে ঘন জঙ্গল ছিল।
১৬২৯ খ্রীষ্টাব্দে আরাকানের মগ রাজা সীরিসুদ্ধম বুঝতে পেরেছিল যে দিলাল রাজা তার আরাকানের অধিপত্য মানতে রাজী নন, তাই একটি সেনা-বহর পাঠিয়েছিলেন সন্দ্বীপের দিকে। দিলাল অবিলম্বে তার সেনানীদের সন্দ্বীপের প্রবেশপথে খাঁড়িতে চুপচাপ বসে থাকার হুকুম দেন। খাঁড়ি দিয়ে প্রবেশ করে, মগরা ভয় না পেয়ে তাদের নৌকা থেকে নেমে দিলালের মহলের দিকে যেতে লাগল। সেই মুহুর্তে, দিলালের সেনানীরা মগদের আক্রমণ করতে বেরিয়ে আসে এবং কেল্লার সেনানীরাও তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। অনেক মগ নিহত বা বন্দী হলেও কেউ কেউ তাদের ভাঙ্গা নৌকা নিয়ে আরাকানের দিকে পালিয়ে যায়। এই আক্রমণের স্মরণে এলাকাটি আজও মগধারা নামে পরিচিত। সন্দ্বীপ তখন থেকে একটি শান্তিপূর্ণ দ্বীপ ছিল এবং দিলাল পুরো দ্বীপটিকে সুরক্ষিত করে তোলেন যাতে শত্রুরা দ্বীপটি সহজে দখল করতে না পারে।
১৮ নভেম্বর ১৬৬৫ খ্রীষ্টাব্দে, বাংলার সুবেহদার শায়েস্তা খাঁ তাঁর এক সেনাপতি আবুল হাসানকে ৮০ বছরের বৃদ্ধ দিলাল রাজার শাসিত সন্দ্বীপ বিজয় করার হুকুম দিয়েছিলেন। ওলন্দাজ সেনাবাহিনীও এই অভিযান সমর্থন করেছিল। মগরা পর্তুগিজদের সাথে ছিটকে পড়েছিল, যার ফলে পর্তুগিজরাও তখন মুঘলদের সাহায্য করেছিল। শরীফ খাঁন খূব ভালো করে সন্দ্বীপকে হেফাজত করার চেষ্টা চালিয়েছিল কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রেই তিনি আহত হন। এরপর মুঘল বাহিনী দিলালের বাড়ির দিকে অগ্রসর হলে যেখানে আরেকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দিলাল একগুঁয়ে প্রতিরোধের প্রস্তাব দেন কিন্তু মুঘল ঘোড়সওয়ারদের দ্বারা আবদ্ধ হওয়ার পর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। ২৬ জানুয়ারি ১৬৬৬ এর মধ্যে বিজয় সফল হয় এবং ইউরোপীয় জলদস্যুদের প্রধান ক্যাপ্টেনকে পুরস্কৃত করা হয়। দিলাল, তাঁর ছেলে শরীফ এবং ৯২ জন সহযোগীকে একটি লোহার খাঁচায় বন্দী করা হয় এবং ঢাকার কারাগারে প্রেরণ করা হয়। বৃদ্ধ দিলাল সেই কারাগারেই জীবনের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসনের মতে, তাদের মুর্শিদাবাদে আটকে রাখা হয়েছিল কিন্তু ইতিহাসবিদ মুহাম্মদ আব্দুল কাদের দাবি করেন মুর্শিদাবাদ আসলে আঠারশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মুর্শিদকুলি খাঁ দ্বারা বাংলার রাজধানী স্থাপন করা হয়। বেশিরভাগ ইতিহাসবিদরা মনে করেন, দিলালকে বন্দী করে জাহাঙ্গীরনগরে পাঠানো হয়েছিল মোঘল সেনাপতি ও জমিদার মনোয়ার খাঁনের (ঈশা খাঁর বংশধর) দায়িত্বে। পরে সেখানেই দিলাল রাজা মৃত্যুবরণ করেন। ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দে পর্যায়ক্রমে আব্দুল করিমকে সন্দ্বীপের মুঘল ফৌজদার নিয়োগ করা হয়। ১৬৬৬ থেকে ১৭৬৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০০ বছর মোঘলরা সন্দ্বীপ শাসন করে।
দিলালের অনেক ছেলে ও দুই মেয়ে (মুছাবিবি ও মরিয়ম বিবি) ছিল। ছেলেদের মধ্যে শুধু শরীফ খাঁর নাম জানা আছে। ক্ষতিপূরণের উপায় হিসেবে, বাংলার সুবেহদার শায়েস্তা খাঁ দিলালের ছোট ছেলেদেরকে ঢাকা শহরের কাছে ১০-১২ গ্রামের জায়গীর প্রদান করেছিলেন, ধলেশ্বরীর তীরের পাথরঘাটা-মিঠাপুকুর এলাকায়। ২০০ বছর পর এসব গ্রামগুলো নদী ভাঙনের কারণে ধ্বংস হয়ে যায়। দিলালের বংশধররা তারপর সাভারের গেণ্ডা গ্রামে স্থানান্তরিত হন।
দিলাল রাজা বা নবাব দেলোয়ার খাঁর নবম উত্তর পুরুষ হচ্ছেন, ডাকসুর সাবেক ভিপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম (খান) সেলিম (৮ম বংশধর), সাভারের সাবেক এমপি আশরাফ উদ্দিন খান ইমু (৮ম বংশধর), মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের মেয়ে স্বর্ণালী ইসলাম, ছেলে তৌহিদুল ইসলাম খান (সুমন্ত), আশরাফ উদ্দিন খান ইমুর তিন ছেলে গোলাম মহিউদ্দিন খান শান্তুনু, গোলাম শফিউদ্দিন খান ও গোলাম ফয়েজ উদ্দিন খান এবং জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট মেম্বার, ঢাকা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান সবাই ৯ম বংশধর।
দিলালের মেয়েদ্বয়ের বংশধররা সন্দ্বীপে রয়ে গিয়েছিলেন। বড় মেয়ে মুছাবিবি চাঁদ খাঁর সাথ বিয়ে হয়েছিল এবং ছোট মেয়ে মরিয়ম বিবির বিয়ে হয়েছিল মুলিশ খাঁর সাথে। সন্দ্বীপে এখনও মুছাপুর এলাকা ও মুছাবিবির দিঘী উল্লেখযোগ্য আছে। চাঁদ খাঁ ও মুছাবিবির চারজন ছেলে হলেন জুনুদ খাঁ, মুকীম খাঁ, সুরুল্লাহ খাঁ এবং নূরুল্লাহ খাঁ। জুনুদ খাঁর ছেলে মুহম্মদ রাজা হলেন আবু তোরাব ও ফুলবিবির বাবা। মুকীম খাঁনের ছেলে মুহম্মদ হোসেন এবং তার ছেলে মুহম্মদ মুরাদ। ফুলবিবি ও মুহম্মদ মুরাদের বিয়ে হয় এবং তাদের ছেলে মুহম্মদ হানিফও সন্দ্বীপের একজন উল্লেখযোগ্য জমিদার ছিলেন। আবু তোরাবের মহল হরিশপুরে অবস্থিত ছিল এবং ১৭৬৭ সালে তিনিই ছিলেন বাংলার প্রথম ব্রিটিশ-বিদ্রোহী নেতা।
রাজা দেলওয়ার খার এক বোন ছিল, যার নাম ছিল হীরাবিবি। সন্দ্বীপের রহমতপুরের আদম খাঁ পাড়া বা আদিল খাঁর বাড়িই দিলাল রাজার বোন হিরাবিবির বাড়ি। এটিই ইতিহাসের সেই বাড়ি, যেখানে দিলাল তার বোনকে কথা অমান্য করার অপরাধে অশ্বথগাছ সংবলিত বনবাসে পাঠিয়েছিলেন বলে বিশ্লেষিত হয়ে আসছে। কালের হিসেবে বর্তমানে সন্দ্বীপের টিকে থাকা বাড়িগুলোর মধ্যে এটিই সবথেকে পুরাতন বাড়ি হিসেবে বিবেচিত হয়, যার আনুমানিক বয়স ৩৭০ বছর।
* আবু তোরাব (?-১৭৬৭): সন্দ্বীপের জমিদার ও স্বাধীনতা সংগ্রামী চৌধুরী আবু তোরাব খাঁ। আবু তোরাব নামেও পরিচিত।  অষ্টাদশ শতাব্দীর এই জমিদার মূলত সন্দ্বীপের জমিদার হলেও, তার জমিদারী হাতিয়া ও বামনী জিঞ্জিরায় বিস্তৃত হয়।
তিনি বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিরুদ্ধে বাংলার প্রথম বিদ্রোহী নেতা হিসাবে বেশী পরিচিত। স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে তার দৃঢ় সমর্থন ছিল এবং বাংলার ইতিহাসে তাকে একজন বীর হিসাবে গণ্য করা হয়।
আবু তোরাব মোগল আমলে সুবাহ বাংলার সন্দ্বীপের একটি সম্ভ্রান্ত বাঙ্গালী মুসলিম জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাপের নাম ছিলেন মুহম্মদ রাজা, যিনি চাঁদ খাঁর অন্যতম ছেলে জুনুদ খাঁর ছেলে। প্রপিতামহ চাঁদ খান বিয়ে করেছিলেন মুসাবিবিকে যিনি ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যবাদের কাছে পরাজিত সন্দ্বীপের সর্বশেষ স্বাধীন নৃপতি নবাব দেলোয়ার খাঁর ব​ড় কন্যা।
রাজা দেলওয়ার খাঁর দুই মেয়ে ছিল। মুছা বিবি ও মরিয়ম বিবি। তাঁর একাধিক পুত্র ছিল। তবে শুধু শরীফ খাঁ ছাড়া অন্য কারো নাম জানা যায়নি। সম্ভবত শরীফ খাঁ পিতার সঙ্গে জিনজিরায় কারারুদ্ধ অবস্থায় মারা যান। নবাব শায়েস্তা খাঁ রাজা দেলোয়ার খাঁর বয়ঃপ্রাপ্ত ছেলেদের ভরনপোষণের জন্য ঢাকার অদূরে ধলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত পাথরঘাটা মিঠাপুকুর নামক স্থানে ১০/১২ খানা গ্রাম জায়গীর স্বরূপ প্রদান করেন। প্রায় ২০০ বছর পূর্বে গ্রামগুলো নদী ভাঙনে হারিয়ে যায়। তখন হতে শরীফ খাঁর বংশধরেরা সাভারের গান্ডা গ্রামে বসবাস করে আসছে। উল্লেখ্য,রাজা দিলাল কে সন্দ্বীপ হতে বন্দী করে ঢাকায় আনার সময় তার কন্যাদ্বয়ের বংশধরেরা সন্দ্বীপেই থেকে যান। রাজা দেলওয়ার খাঁর প্রথম কন্যা মুছা বিবিকে বিয়ে করেন চাঁদ খাঁ ও মরিয়ম বিবিকে বিয়ে করেন মুলিশ খাঁ। মুছা বিবির নামানুসারে মুছাপুর গ্রাম ও মুছাবিবির দিঘী নামকরন করা হয় বলে জন শ্রুতি আছে। মুছাবিবির স্বামী চাঁদ খাঁর চার পুত্র ছিলেন- ১। জুনুদ খাঁ ২। মুকিম খাঁ ৩। সোরোল্লা খাঁ এবং ৪। নোরোল্লা খাঁ। আর জুনুদ খাঁর পুত্র হলেন মোহাম্মাদ রাজা, মোহাম্মাদ রাজার পুত্র আবু তোরাব ও কন্যা ফুলবিবি। অন্য দিকে মুকিম খাঁর ছেলে মোহাম্মাদ হোসেন, মোহাম্মাদ হোসেনের পুত্র মোহাম্মাদ মুরাদ। এই মুরাদ বিয়ে করেন জুনুদ খাঁর নাতনি ফুল বিবিকে। মুরাদ ও ফুল বিবির ঘরে জন্মে মোহাম্মাদ হানিফ, যিনি পরবর্তীতে জমিদারী প্রাপ্ত হন। অপরদিকে দেলোয়ার অন্য মেয়ে মরিয়ম বিবির বংশধরদের কোন হদিস পাওয়া যায়নি। আবু তোরাব চৌধুরী সন্দ্বীপের নেতা হিসেবে দেলোয়ার খাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।
সন্দ্বীপের পশ্চিমাংশের হরিশপুরে আবু তোরাব চৌধুরীর মহলটি অবস্থিত ছিল। ইংরেজ সূত্র অনুসারে, তিনি ১৫০০ সশস্ত্র গোলামদের একটি শক্তিশালী সৈন্যদল তৈরি করেছিলেন, যাদের প্রত্যেকের জন্য তিনি ভিন্ন ভিন্ন আবাস তৈরি করে দিয়েছিলেন, যদিও স্থানীয় সূত্র দাবি করে যে এটি সত্য নয়। আবু তোরাব চৌধুরী তার এলাকার সকল স্থানীয় জমিদারদের উপর কর্তৃত্ব করেছিলেন এবং এসব জমিদাররা তাকে গোকুল ঘোষালের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহযোগিতা করেছিল। গোকুল ঘোষাল ছিল খিদিরপুরের ভূকৈলাস রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং চট্টগ্রামের প্রথম ইংরেজ গভর্নর হ্যারি ভেরেলেস্টের কেরানি। ঘোষালের পরামর্শে, ভেরেস্ট ১৭৬৩ সালে সন্দ্বীপ দখল করেন এবং মোগল ওয়াদাদার ওজাকুর মলের বদলে ঘোষালকে প্রতিস্থাপন করেন। ভেরেলেস্টের একজন অনুগত কর্মচারী বিষ্ণুচরণ বসু ব্রিটিশ সন্দ্বীপে প্রথম ওয়াদাদারের দায়িত্ব নেন। সেই সময় রাম কিশোর বিষ্ণুচরণ বসুর সহকারী নিযুক্ত হন। বলা বাহুল্য, আবু তোরাব চৌধুরী গোকুল ঘোষালের কর্তৃত্ব মেনে নিতে পারেননি কারণ ঘোষাল ১৭৬৩ থেকে ১৭৬৪ সালের মাঝে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পক্ষে রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে সন্দ্বীপে এসেছিলেন। রাম কিশোর সন্দ্বীপে পা রাখার সাথে সাথে আবু তোরাব চৌধুরী তাকে প্রতিহত জন্য প্রস্তুত হন।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলায় ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের সূচনা হয় এবং অতঃপর বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় ইংরেজ প্রভাবিত বাংলার নবাব সৈয়দ মীর জাফর আলী খানের (১৬৯১ – ১৭৬৫) জামাতা নবাব মীর মুহম্মদ কাসিম আলী খানের (? – ৮ মে, ১৭৭৭) শেষ ব্যর্থ চেষ্টার (১৭৬৩) পর বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিরুদ্ধে সন্দ্বীপ থেকে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
১৭৬৭ সালে পলাশীর বিপর্যয় ঠিক ১০ বছর পর, আবু তোরাব চৌধুরী সন্দ্বীপের জনগণকে একত্রিত করেন এবং চট্টগ্রামে ঔপনিবেশিক গভর্নর এবং তাদের স্থানীয় মিত্র যেমন গোকুল ঘোষালের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। আবু তোরাব রাজস্ব জমা করা থেকে বিরত থাকেন এবং তার সেনাপতি মালকাম সিংকে ঘোষালের প্রতিনিধিদের সন্দ্বীপ থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন।  চট্টগ্রাম ও লক্ষ্মীপুর থেকে একদল কোম্পানির সৈন্য আবু তোরাব ও তার সৈন্যদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছিল। প্রতিরোধ ও চাপের মুখে কয়েক দিনের মধ্যে প্রতিনিধিরা সন্দ্বীপ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
অবশেষে, ক্যাপ্টেন নলেকিন্স এবং আরও কয়েকজন জেনারেলের নেতৃত্বে ছয়টি কোম্পানি সৈন্য নদী পার হয়ে ১৭৬৭ সালের মাঝামাঝি সন্দ্বীপে পৌঁছে। সন্দ্বীপ শহরের সামান্য উত্তরে চর বা চার আনি হাট থেকে দূরে কেল্লাবাড়িতে ক্যাপ্টেন নলেকিন্সের বাহিনী এবং আবু তোরাবের বাহিনীর মধ্যে একটি ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আবু তোরাব তার এক নিকট আত্মীয়ের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে এই যুদ্ধে নিহত হন যে তার যুদ্ধ কৌশল ব্রিটিশ কোম্পানির কাছে ফাঁস করেছিল। তার সশস্ত্র ক্রীতদাস দল সন্দ্বীপের বর্তমান গোলাম শ্রেণীর পূর্বপুরুষ।
আবু তোরাবের পতনের পর সন্দ্বীপের ছোট ছোট জমিদাররা তাদের জমিদারির (জমি, এস্টেট) বিনিময়ে গোকুল ঘোষালের অত্যাচার মেনে নেয়। সন্দ্বীপের প্রকৃত শাসক হওয়ার পর, গোকুল ঘোষাল ভবানীচরণ দাসের নামে আবু তোরাবের এস্টেট দেন।  কিছুকাল পরে, ঘোষাল সমস্ত জমিদারি পুনরুদ্ধার করে এবং সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করে। ঘোষাল রাজবংশ দুর্নীতি, লুটপাট, লবণ ইজারা এবং বেনামী জমিদারির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছিল।  কিদারপুরে তাদের ভূকাইলাস প্রাসাদটি আজ দাঁড়িয়ে আছে, সন্দ্বীপের কৃষকদের সম্পদ দিয়ে নির্মিত, স্থানীয়রা ঘৃণার সাথে স্মরণ করে। ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে অসংখ্য সংযুক্ত বিদ্রোহ পরবর্তীকালে সন্দ্বীপে সংঘটিত হয়, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি পর্যন্ত।
সন্দ্বীপ টাউনের বিলুপ্ত দিঘীটি প্রখ্যাত জমিদার চৌধুরী আবু তোরাব খাঁ খনন করেছিলেন। ঐতিহাসিক এই দিঘীটি ‘আবু তোরাব চৌধুরীর দিঘী’ নামে পরিচিত ছিল এবং তার অবস্থান ছিল আবু তোরাব চৌধুরীর বাড়ীর সম্মুখভাগে। আবু তোরাব চৌধুরীর শাহাদাতের পর তাঁর বাড়ী, দিঘী ও দিঘীর পাড়ের সকল স্থাপনা বাজেয়াপ্ত করে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এখানেই সদর দপ্তর স্থাপন করে সন্দ্বীপ টাউন গড়ে তুলে। এভাবেই কালক্রমে আবু তোরাব চৌধুরীর নাম মুছে গিয়ে দিঘীটি ‘সন্দ্বীপ টাউন দিঘী’ নামে পরিচিতি পায় এবং প্রায় দেড়শ’ বছর পর বাজেয়াপ্তকৃত আবু তোরাব চৌধুরীর বাড়ীর কিয়দংশ মাহমুদ মিয়া (উকিল বজলুর রহিম সাহেবের পিতা) সরকার (তখন বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর স্থলে সরাসরি বৃটিশ সরকার) থেকে কিনে নেন। আবু তোরাব চৌধুরীর বাড়ীর ঐ কিয়দংশটিই পরবর্তীতে শাহজাহান মিয়ার বাগান নামে পরিচিতি পায়। উল্লেখ্য যে, শাহজাহান মিয়া (আবুল মোহসিন চৌধুরী) ছিলেন মাহমুদ মিয়ার পৌত্র এবং উকিল মরহুম বজলুর রহিম সাহেবের ছেলে।
* মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি। তিনি স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এর প্রথম সহ সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছিলেন।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৬ এপ্রিল ঢাকার অদূরে সাভারে। বাবা মোসলেহ উদ্দিন খান ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা আর মা উম্মে হানী খানম ছিলেন নারীনেত্রী ও সমাজসেবক। স্কুল জীবনে স্কাউটসহ নানাবিধ সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। স্কুলছাত্র থাকাকালীন ১৯৬৬ সালে আউযুব খানের বিরুদ্ধে মিছিল করতে গিয়ে সেলিম কারাবরণ করেন। কলেজে পা দিয়েই সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন ও রাজনীতিতে। এ সময় তিনি গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও যুক্ত হন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন। সেলিম স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) প্রথম সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স করেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
ছাত্র জীবন শেষে সেলিম পার্টি-জীবনকে বেছে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ক্ষেতমজুরদের সংগঠিত করার কাজে মনোযোগ দেন। তিনি বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে শুরুর দিক থেকে সেলিম বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে ২০১২ সালে পার্টির দশম কংগ্রেসে সভাপতি নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক কারণে প্রায় আট বছর কারাবরণ ও আত্মগোপনে ছিলেন এই নেতা।
ব্যক্তিগত জীবনে সেলিম এক মেয়ে ও এক ছেলে সন্তানের জনক। মেয়ে স্বর্ণালী ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রে ন্যানো টেকনোলজি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। ছেলে তৌহিদুল ইসলাম খান (সুমন্ত) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়ছে।
• আশরাফ উদ্দিন খান ইমু বাংলাদেশের ঢাকা জেলার রাজনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা ও তৎকালীন ঢাকা-১২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য।
আশরাফ উদ্দিন খান ইমু ১ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে ঢাকা জেলার সাভারের গেন্ডায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম কবির উদ্দিন খান (তারা মিয়া) ছিলেন সাভার আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মাতার নাম অজিফা খানম। এক ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট।
তিনি সাভার অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন।
তার তিন ছেলে যথাক্রমে বড় ছেলে গোলাম মহিউদ্দিন খান শান্তুনু, মেঝ ছেলে গোলাম শফিউদ্দিন খান ও ছোট ছেলে গোলাম ফয়েজ উদ্দিন খান।
আশরাফ উদ্দিন খান ইমু ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তিনি ১৯৬৪ সালে ছাত্রলীগে যোগদান করে ১৯৬৫ সালে জগন্নাথ কলেজে ছাত্রলীগের যুগ্মসম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ সালে মানিকগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সাভারের কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালে সাভার আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৮৮ সালের চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সম্মিলিত বিরোধী দলের হয়ে তৎকালীন ঢাকা-১২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৮৫ সালে সাভার উপজেলা প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও ১৯৯৪-২০০৩ মেয়াদে সাভার পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এছাড়াও তিনি ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সাভার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ও ১২ জুন ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন ঢাকা-১২ আসন থেকে পরাজিত হয়েছিলেন।
আশরাফ উদ্দিন খান ইমু ১৮ই সেপ্টেম্বর ২০২৫ সালের বৃহস্পতিবার ইন্তেকাল করেন।
* তথ্য সূত্র ও ছবিঃ
১। উইকিপিডিয়া।
২। শাশ্বত সন্দ্বীপ- এবিএম ছিদ্দিক চৌধুরী, ১৯৮৮ ইং।
৩। সন্দ্বীপের ইতিহাস” – রাজকুমার চক্রবর্তী ও অনঙ্গ মোহন দাস রচিত, ১৯২৪ইং।
৪। M Faruq U Chowdhury
৫। Sagor Shahnewaz
৬। Rupom Hasan
৭। এআই।
সংকলকঃ  সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম জেলা কমিটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *