ইসলাম একমাত্র ধর্মব্যবস্থা যা শুধু আল্লাহর ইবাদত ও আত্মশুদ্ধিকেই গুরুত্ব দেয় না, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে মানুষের হক আদায়ে সুস্পষ্ট ও শক্ত নির্দেশনা দিয়েছে। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ইসলামি শাসনব্যবস্থার অন্যতম প্রধান নৈতিক ভিত্তি।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই ছিলেন একজন নিখুঁত কর্মনেতা, যিনি কর্মীদের হক আদায়ের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন।
ইসলামের নির্দেশনা এতটাই মানবিক যে, মহানবী (সা.) নিজেই বলেন, “শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধ করো” (ইবনে মাজাহ: ৩/৯৭)। এটি শুধু একটি প্রজ্ঞাবাণ উক্তি নয়, বরং তা হলো মুসলিম সমাজের জন্য একটি নৈতিক ও সামাজিক বাধ্যবাধকতা। ইসলাম চায় না, কোনো শ্রমিক তার প্রাপ্য পাওয়ার জন্য অনিশ্চয়তায় থাকুক বা দাবির জন্য রাস্তায় নামুক।
শুধু এখানেই নয়, হাদিসে কুদসিতে আল্লাহতায়ালা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “কিয়ামতের দিন আমি নিজে তিন শ্রেণির মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করব—… যার মধ্যে অন্যতম হলো, যে শ্রমিক দিয়ে কাজ করিয়ে তার মজুরি দেয়নি” (সুনানে বাইহাকি: ২/১৪০)। এটি একটি চরম সতর্কবার্তা, যা শ্রমিক শোষকদের জন্য ভয়াবহ পরিণতির ইঙ্গিত দেয়।
শ্রমিকের অধিকার মানে শুধু তাকে একটা কাজ দেওয়া নয়, বরং কাজের শেষে সময়মতো এবং চুক্তিমতো পারিশ্রমিক দেওয়া। ইসলাম এই দুটি বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছে। শ্রমিক যদি মাসিক ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়, তবে মাস শেষ হওয়া মাত্রই বেতন দিতে হবে। আর দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করলে, সেই দিনেই মজুরি পরিশোধ করতে হবে।
বর্তমানে অনেক কলকারখানায় দেখা যায়, সময়মতো বেতন দেওয়া হয় না। উল্টো বিলম্ব হলে হাজিরা কাটা হয়, কখনো দিনের মজুরি পর্যন্ত আটকে রাখা হয়। এটি স্পষ্টতই ইসলামের মানবিক নীতির পরিপন্থী।
পোশাক শিল্পে প্রায়ই দেখা যায়, শ্রমিকরা ঈদের আগে বেতন-বোনাসের দাবিতে রাজপথে নামেন। এটি নিছক অর্থনৈতিক সংকট নয়, বরং এটি আমাদের মুসলিম সমাজের জন্য একটি বড় লজ্জার বিষয়। যে শ্রমিক সারা বছর তার শ্রম দিয়ে মালিকের সম্পদ বৃদ্ধি করে, সে কেন ঈদের জামা কেনার টাকার জন্য আন্দোলন করবে? ইসলাম মালিককে শ্রমিকের প্রয়োজন আগে মেটাতে বলে, কারণ ঈদের আনন্দ সবার।
যেসব শ্রমিক মালিকের বাসায় বা ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তাদের খাওয়া-পরা অনেক সময় মালিকের ওপর নির্ভর করে। মহানবী (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন, “তোমরা যা খাবে, তাদেরও তা খেতে দেবে। তোমরা যা পরবে, তাদেরও তা পরতে দেবে” (আবু দাউদ: ৫১৬৩)। এখানেও আমরা দেখি, ইসলাম সমতা চায়। মালিক নিজে গরম ভাত খেয়ে কাজের মেয়েকে বাসি ভাত খেতে দিলে, তা ইসলামসম্মত নয়। এই নির্দেশনা শুধু সহানুভূতি নয়, বরং সরাসরি একটি ফরজ দায়িত্ব।
ইসলাম এমনকি কাজের পরিমাণ নিয়েও স্পষ্ট। কোনো শ্রমিককে তার সামর্থ্যের অতিরিক্ত কাজ দেওয়া যাবে না। যদি কখনো অতিরিক্ত কাজ দেওয়া হয়, মালিককেও তাতে অংশ নিতে হবে। এটি একটি অনন্য উদাহরণ যেখানে শ্রমিক-মালিক সম্পর্ককে একত্রিত করে দেওয়া হয়েছে সমতার বন্ধনে।
যেকোনো সম্পর্কের ভিত্তি ক্ষমা। শ্রমিক যদি কোনো ভুল করে, ইসলাম বলে তাকে মারধর নয়, বরং প্রতিদিন ৭০ বার ক্ষমা করার মানসিকতা রাখতে হবে (আবু দাউদ: ৫১৬৬)। আজকের সমাজে যেখানে শ্রমিকরা গালিগালাজ, অসম্মান বা এমনকি নির্যাতনের শিকার হন, সেখানে এই শিক্ষা হলো মুক্তির দিশারি।
মহানবী (সা.) একবার আবু জর (রা.)-কে কঠোরভাবে বলেছিলেন, “তুমি তোমার কর্মচারীর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করো! সে তোমার ভাই। আল্লাহ তাকে তোমার অধীনে দিয়েছেন, কিন্তু তুমি তাকে ছোট করতে পারো না” (আবু দাউদ: ৫১৫৯)। ইসলাম কখনো কর্মচারী বা শ্রমিককে দাস হিসেবে দেখেনি; বরং ভাইয়ের মতো সম্মান দিতে বলেছে।
মৃত্যুশয্যায় থাকা অবস্থায় মহানবী (সা.) তার সর্বশেষ কথা হিসেবে বলেছিলেন, “তোমাদের অধীনস্থদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো” (আবু দাউদ: ৫১৫৮)। এটি শুধু আবেগ নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর জন্য চূড়ান্ত দায়িত্বের ঘোষণা। ইসলামের দৃষ্টিতে, অধীনস্থদের অধিকার রক্ষা না করে কেউ মুত্তাকি বা ধর্মপ্রাণ হতে পারে না।
ইসলামে শ্রমিক অধিকার কোনো দয়া নয়, বরং এটি একটি ঈমানদারের নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। শ্রমিকের ঘামে গড়া এই সমাজে, যদি আমরা তাদের প্রাপ্য সম্মান, সময়মতো মজুরি এবং মানবিক আচরণ না দিই, তবে আমরা শুধু আইন ভঙ্গ করছি না, বরং রাসূল (সা.)-এর আদর্শ এবং আল্লাহর হুকুমের অবমাননাও করছি। তাই শ্রমিক অধিকার রক্ষা শুধু একটি সামাজিক দায় নয়—এটি আমাদের আখিরাতের প্রশ্ন।
#এফএফ







