১৩ বছরের আব্দুল্লাহ প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে একটি সাদা প্লাস্টিকের বস্তা কাঁধে নিয়ে রাস্তায় নামে। শহরের অলিগলি, ড্রেনপাড়, খোলা ময়লা জমার স্থান—সব জায়গা ঘুরে সে কুড়িয়ে নেয় প্লাস্টিক বোতল, খাবারের প্যাকেট ও বর্জ্য। প্রতিদিন সে সংগ্রহ করে ৭-৮ কেজি বর্জ্য, যার বিনিময়ে পায় ৬০-৭০ টাকা। এই সামান্য আয় দিয়েই চলে তার পরিবারের নিত্য খরচ। তার কথায়—”এই প্লাস্টিক কুড়াইয়া যা পাই তাতেই আমাগো পেট চলে।”
এই একবাক্যে যেন ফুটে ওঠে বাংলাদেশের প্লাস্টিক দূষণ সংকটের আসল চিত্র—যেখানে মুনাফার সুবিধাভোগী এক শ্রেণি, আর ক্ষতির ভার বহন করে আরেকজন।
বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে তৈরি হয় প্রায় ৩,০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য। ২০২৩ সালের Waste Concern-এর গবেষণায় দেখা যায়, এর ৩৬% ফেলে দেওয়া হয় উন্মুক্ত স্থানে, ২৩% যায় খাল ও নদীতে, আর মাত্র ৯% পুনর্ব্যবহার হয়। এই বর্জ্যের বড় অংশ জমে থাকে শহরের দরিদ্র বসতিগুলোতে—বিশেষত বস্তি ও নদীপাড় ঘেঁষা এলাকাগুলোতে। ফলে, নোংরা পানি, ড্রেনের জট আর বৃষ্টির সময় জলাবদ্ধতায় ভুগতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের।
কাকরাইল বস্তির আমেনা বলেন, “প্লাস্টিক ড্রেন বন্ধ কইরা দেয়। বৃষ্টিতে পানি ঘরে ঢোকে। বাচ্চা-পোলাপান ডায়রিয়া হয়।”
বাংলাদেশে বর্তমানে ৭,০০০-এর বেশি প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। Science Direct-এর তথ্য বলছে, দৈনিক গড়ে ৬৪৬ টন বর্জ্য সংগ্রহ করা হলেও তার বড় অংশ যায় বস্তি ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের মধ্য দিয়ে ডাম্পিং সাইটে। যেখানে স্বাস্থ্যঝুঁকি চরম।
Waste Concern-এর হিসাব অনুযায়ী, ঢাকার ৩৬% বর্জ্য ফেলা হয় খোলা জায়গায়, আর ২৩% যায় নদী-নালায়। অথচ কোনো উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বাধ্য নয় তার উৎপাদিত প্লাস্টিক পুনরুদ্ধার করতে। ফলে পুনর্ব্যবহারের দায়িত্ব পড়ে আব্দুল্লাহ, আফিয়া বেগমদের মতো দরিদ্র সংগ্রাহকদের ওপর।
নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য চাল, ডাল, তেল, শ্যাম্পু, সাবান সবই ছোট ছোট প্লাস্টিক প্যাকেটে আসে। এই প্যাকেট ব্যবহারের ফলে প্লাস্টিক দূষণ আরও বাড়ছে। অথচ এর ব্যবস্থাপনার কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেই। পরিবেশ সংগঠনগুলো বলছে—এই ব্যবস্থায় দরিদ্ররা একদিকে দূষণের শিকার, অন্যদিকে নিজের পছন্দ অনুযায়ী নিরাপদ প্যাকেজিংয়ের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত।
“ভোক্তার যেমন স্বাস্থ্যগত অধিকার আছে, তেমনি সরকারের দায়িত্ব তাদের বিকল্প ও নিরাপদ প্যাকেজিং নিশ্চিত করা,” বলেন পরিবেশ কর্মী শরীফ জামিল।
মহাখালী বস্তির আফিয়া বেগম ১২ বছর ধরে বর্জ্য কুড়াচ্ছেন। এখন তিনি ত্বকের নানা রোগে আক্রান্ত। GAIA এবং UNEP – এর গবেষণায় দেখা গেছে, বর্জ্য সংগ্রাহকদের ৭০ শতাংশই চর্মরোগে আক্রান্ত। ব্র্যাকের ২০২২-২০২৪ সালের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ৬১% নারী সংগ্রাহক হাতের সংক্রমণ ও ৪৯% শ্বাসকষ্টে ভোগেন।
প্লাস্টিক পোড়ানোর এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে চোখ জ্বালাপোড়া ও শ্বাসকষ্টের হার সাধারণ এলাকার তুলনায় প্রায় ২.৫ গুণ বেশি। অর্থাৎ, যারা প্লাস্টিক ব্যবহার করে না, তারাই এর ভয়াবহ পরিণতির শিকার বেশি।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এবং প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০২০ থাকা সত্ত্বেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কার্যকর কোনো নিরাপত্তা নেই। Extended Producer Responsibility (EPR) নীতিতে বলা হয়েছে, উৎপাদকদের তাদের উৎপাদিত প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না।
“উৎপাদকরা দায় নেয় না বলেই দরিদ্র মানুষ ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় তা কুড়িয়ে বেড়ায়,” বলেন অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিক দূষণের সমাধান শুধুমাত্র পলিথিন নিষিদ্ধ করে হবে না। দরকার সামাজিক ন্যায্যতা ও কাঠামোগত পরিবর্তন। উৎপাদকদের তাদের দায় নিতে বাধ্য করতে হবে। যারা বর্জ্য সংগ্রহ করেন, তাদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি, নিরাপত্তা সরঞ্জাম, চিকিৎসা ও ন্যায্য মজুরি দিতে হবে।
পাশাপাশি, দরিদ্র ও প্রান্তিক এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা, পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হবে। খুলনার একটি সমীক্ষা জানায়, শহরের ডাম্পিং এলাকাজুড়ে প্রায় ৮০ শতাংশ দরিদ্র জনগণ বাস করেন, যাদের দিন কাটে দুর্গন্ধ, বর্জ্য ও অসুস্থতার সঙ্গে।
পাট, কাগজ ও কম্পোস্টেবল উপকরণ দিয়ে তৈরি বিকল্প প্যাকেজিংয়ের দিকে এগোনো এখন সময়ের দাবি। এর জন্য সরকারি প্রণোদনা, গবেষণা সহায়তা ও জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
পরিবেশ কর্মী শরীফ জামিল বলেন, “এই শহরে কেউ প্লাস্টিক ফেলে, কেউ কুড়িয়ে জীবন চালায়। কিন্তু দূষণের ভার সমান নয়।”
একটি সুষ্ঠু, সহানুভূতিশীল এবং দায়িত্বশীল নীতিগত কাঠামো ছাড়া শুধু সচেতনতা দিয়ে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। প্লাস্টিক দূষণ আজ একটি পরিবেশগত সংকটের পাশাপাশি, একটি সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন।
#এফএফ