২০২৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
শুক্রবার (৬ জুন) জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানান, এই সময়ের মধ্যেই নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তার মতে, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, বিচার কার্যক্রম এবং নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে এই সময়টাই উপযুক্ত।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জানানো হয়, “এই নির্বাচন যেন উৎসবমুখর, শান্তিপূর্ণ ও সর্বজনগ্রাহ্য হয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন—এই তিনটি ম্যান্ডেট পূরণে আমাদের কাজ এগিয়ে চলছে।” তিনি আরও বলেন, নির্বাচন পূর্ববর্তী সংস্কার কাজ ঈদের আগেই শেষ করার আশাবাদ ব্যক্ত করছেন।
তবে প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণায় সন্তুষ্ট নয় বিএনপি। তারা মনে করছে, নির্বাচন পিছিয়ে এপ্রিল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবসম্মত নয়। শনিবার (৭ জুন) ঈদুল আজহার নামাজ শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “এপ্রিল মাসটি বাংলাদেশে নির্বাচন আয়োজনের জন্য অনুপযুক্ত। প্রচণ্ড গরম, ঝড়-বৃষ্টি, রোজার পরপরই উৎসব ও পাবলিক পরীক্ষার ব্যস্ততা সব মিলিয়ে সময়টি অস্বস্তিকর।”
বিএনপি’র আপত্তি আরও কিছু কারণে। তাদের মতে, নির্বাচন এপ্রিল পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়ায় নতুন সরকার গঠন, সংসদ অধিবেশন এবং বাজেট প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকবে না। আগামী অর্থবছর শুরু হবে ১ জুলাই থেকে। তার আগে জুনের প্রথম সপ্তাহেই বাজেট উপস্থাপন করতে হয়। বিএনপির দাবি, মাত্র এক মাসের মধ্যে বাজেট প্রণয়ন করা কঠিন হবে।
দলটি মনে করে, ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে আবহাওয়া অনুকূল থাকত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকত, এবং বাজেটসহ নতুন সরকারের প্রস্তুতির জন্যও পর্যাপ্ত সময় থাকত। বিএনপির নেতারা এটিকে সরকারের পক্ষপাতমূলক অবস্থান বলেই দেখছেন।
তবে সরকার বলছে, এপ্রিলের সময়টি বেছে নেওয়ার পেছনে যৌক্তিকতা আছে। বিচার ও সংস্কারের কার্যক্রমকে একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, প্রবাসী ও তরুণ ভোটারদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি যথাযথভাবে সম্পন্ন করাই তাদের লক্ষ্য। সরকারের মতে, এত সময় না থাকলে নির্বাচনের আগে সংস্কার প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ থেকে যেত।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামি ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা জানিয়েছে, ঘোষিত সময়ের মধ্যে সংস্কার এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হলে, এপ্রিল মাসে নির্বাচন নিয়ে তাদের আপত্তি থাকবে না। এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথে অগ্রগতি থাকলে আমরা সময় নিয়ে বিরোধিতা করবো না।”
তবে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলনসহ কয়েকটি দল এই সময় নির্বাচন আয়োজনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “তারিখ ঘোষণা ভালো, কিন্তু ডিসেম্বরেই নির্বাচন দিলে সমস্যা কোথায় ছিল?” গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকির মতে, সরকার অংশীজনদের সঙ্গে পরামর্শ করলেও অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের প্রস্তাব উপেক্ষিত হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সরকার এই সময় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত এককভাবে নিয়েছে, যা রাজনৈতিক সমঝোতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তারা বলেন, এপ্রিল মাসে রমজান পরবর্তী গ্রীষ্মের গরম, বজ্রপাত, ঘূর্ণিঝড় এবং পাবলিক পরীক্ষার চাপে নির্বাচন আয়োজন কঠিন হবে। এতে ভোটার উপস্থিতি, প্রচারণা এবং সার্বিক নির্বাচন পরিবেশ প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
নির্বাচনের সময় ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন দ্বিধা, বিরোধ ও সংশয়—সব মিলিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। সরকারের সিদ্ধান্ত এবং বিরোধী পক্ষের আপত্তির এই দ্বন্দ্ব কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা নির্ধারণ করবে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।