পবিত্র ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়ার সরকার নির্ধারিত মূল্য মাঠ পর্যায়ে কার্যকর হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। ২০২৫ সালের ৭ জুন শনিবার, ঈদের দিন রাজধানীর মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বড় গরুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে। ছোট গরুর চামড়ার দাম আরও কম, অনেক জায়গায় ২০০ টাকাও পাওয়া যায়নি।
মিরপুর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা আব্দুল হামিদ বলেন, “দেড় লাখ টাকা দিয়ে গরু কিনলাম, চামড়ার দাম দিল ৫০০ টাকা! সরকার দাম ঠিক করলেও, মাঠে তো সরকার কিনে না। যারা কিনে, তারা তো সেই দাম মানে না।”
তাঁর প্রতিবেশী রাইসুলও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “চামড়া গরিবের হক। সরকার যদি তা নিশ্চিত করতো, তাহলে ভালো হতো। সরকার নির্ধারিত দামের অর্ধেকও দিতে চাইছে না কেউ।”
চামড়া সংগ্রহে থাকা একজন ব্যাপারী বিষ্ণুদাস বলেন, “আমি এখন পর্যন্ত নয়টা চামড়া কিনেছি। ৭০০, ৭৫০, ৮০০ টাকায়। ছোটগুলো ৫০০ টাকাও দেইনি।” তিনি জানান, তালতলা থেকে কিনে আমিনবাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে চামড়া নিচ্ছেন। তাঁর ভাষায়, “একটু দরকষাকষি করলে কিছু টাকা রাখা যায়। তবে লাভ বড় কথা না, ক্ষতি যেন না হয়।”
এই ব্যাপারী অতীতের চামড়া বাজারের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার যেমন চামড়ার বাজার শেষ করেছিল, এই সরকারও তেমন করেছে। আসলে কোনো সরকারই চামড়া বাজার ভালো রাখতে পারেনি।”
এ বিষয়ে রাজনৈতিক পরিচয় থাকা আরেক ক্রেতা বলেন, “সরকার যদি বলে ১২০০ টাকা দাম, তাহলে আমরা ১২০০ টাকা দিয়ে কিনে কিভাবে বিক্রি করবো? আমরা যেখানে যত কমে পারি কিনে নেই। পরে একসঙ্গে করে বিক্রি করি। সারাদিন পরিশ্রম করি, কিছু না থাকলে সংসার চলবে কীভাবে?”
তিনি জানান, আগের মতো আর ১৫০০ বা ২০০০ টাকায় চামড়া কেনা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ বাজার সেই মূল্য ধরে রাখতে পারছে না।
চামড়া নিয়ে এমন পরিস্থিতি নতুন নয়। প্রতি বছর ঈদুল আজহার পর সরকার পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিলেও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে বড় ধরনের গড়মিল দেখা যায়। চলতি বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
সরকারের পক্ষ থেকে এবার ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৬৫ থেকে ৭০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সেই হিসাবে একটি গড়পড়তা গরুর চামড়ার দাম পড়ার কথা ১২০০ টাকার বেশি। অথচ বাস্তবে সেই চামড়া বিক্রি হচ্ছে অর্ধেক দামে বা তারও কমে।
এমন বাস্তবতায় ক্ষুব্ধ বিক্রেতারা বলছেন, সরকার দাম নির্ধারণ করলেও তদারকি না থাকায় মাঠে সেই দামের কোনো প্রতিফলন নেই। ফলে প্রতি বছর গরিব ও সাধারণ কোরবানি প্রদানকারীরা ঠকছেন।
অভিযোগ উঠেছে, মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় একটি সিন্ডিকেট চামড়া সংগ্রহ করছে কমদামে। তারা জানে, বিক্রেতারা বিকল্প জানে না, হিমাগার বা সরাসরি ট্যানারির সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগও নেই। এই সুযোগে দর কষে অতি কম দামে চামড়া সংগ্রহ করে তা আমিনবাজার বা হাজারীবাগের মতো স্থানে নিয়ে বিক্রি করছে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, চামড়া শিল্প একটি বড় রপ্তানি সম্ভাবনাময় খাত হলেও এ খাতের ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিন ধরেই অনিয়ম ও দুর্নীতি বিদ্যমান। প্রতি বছর ঈদের সময় একবারই এই কাঁচা চামড়া সংগ্রহ হয়, আর তখনই বাজারে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
তাদের মতে, সরকার যদি চামড়ার মূল্য বাস্তবায়নে মনিটরিং টিম নিয়োগ করতো, প্রয়োজনে স্থানীয় প্রশাসন ও ট্যানারি মালিকদের সমন্বয়ে একটি স্বচ্ছ নীতিমালা অনুসরণ করতো, তাহলে এই পরিস্থিতির উন্নতি হতো। চামড়া সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় হিমাগার বা ট্রান্সপোর্ট সুবিধা না থাকায় ছোট বিক্রেতারা একমাত্র ভরসা করেন মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চামড়া একটি দান হিসেবেই ধরা হয় ইসলামী মূল্যবোধে। গরিব ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে এ সম্পদ ব্যবহারের কথা থাকলেও বাস্তবে তা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাতে গিয়ে মূল্য হারিয়ে ফেলছে। এই অব্যবস্থাপনা শুধু বিক্রেতার ক্ষতি করছে না, দেশের চামড়া শিল্প ও অর্থনীতির জন্যও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।







