দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অবদান রাখার জন্য বরেণ্য অভিনেতা আবুল হায়াত পেয়েছেন ‘মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা’। শুক্রবার রাজধানীর বাংলাদেশ চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে তাঁর হাতে সম্মাননার ক্রেস্ট তুলে দেন অভিনেত্রী দিলারা জামান। এ সময় মঞ্চে ছিলেন স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক।
নিজের অনুভূতি জানিয়ে আবুল হায়াত বলেন, ‘ধন্যবাদ প্রথম আলো ও মেরিলকে। কিন্তু সে ধন্যবাদ পরিপূর্ণ হবে না, যদি আমার অনুজপ্রতিম মতিউর (প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান) ও অঞ্জন চৌধুরীকে (স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক) কৃতজ্ঞতা না জানাই। আমার কর্ম, কর্মময় জীবন ও শিল্পের পথে যে যাত্রা, তাকে মূল্যায়ন করার জন্য আপনাদের কৃতজ্ঞতা শুধু নয়, অশেষ ভালোবাসা। পুরো প্রথম আলো ও মেরিল পরিবারকে আন্তরিক ধন্যবাদ, আমি তোমাদেরই লোক।’

আবুল হায়াত আরও বলেন, ‘আর এ দেশের দর্শক, যাঁরা আজীবন আমার অভিনয়কে ভালোবেসেছেন, যাঁদের কাছে বিভিন্ন চরিত্রে আমি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছি। যাঁরা আমার অভিনীত চরিত্রের আনন্দ–বেদনার সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেছেন, আমি মনে করি যেকোনো অভিনেতার মতো সেটি আমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার।’
নিজের অভিনয়জীবন নিয়ে আবুল হায়াত বলেন, ‘পৃথিবীর একমাত্র সত্যিকারের অভিনেতারাই একজীবনের বহু জীবন করার মতো বিরল সৌভাগ্য হয়। এই যে আমার বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা, এই জীবনে হয়তো কয়েক হাজার চরিত্রে জীবনের জটিলতাকে আমি ধারণ করতে পেরেছি বা চেষ্টা করেছি। তাদের ভাবনা, তাদের যন্ত্রণা, তাদের সংগ্রাম, সংকট, দুঃখ, কষ্ট সবকিছুকে আমি আত্মস্থ করেছি, করার চেষ্টা করেছি। নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সেসব চরিত্রে রূপান্তর করার চেষ্টা করতে হয়েছে। এ কাজকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য, একজন অভিনেতাকে নিজের খোলস থেকে বেরিয়ে আসার এক জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, গভীর প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়, সাধনার প্রয়োজন হয়, শিল্পের প্রতি ভালোবাসার প্রয়োজন হয়। তারপর সে যখন রঙ্গমঞ্চে দাঁড়ায়, সংলাপ বলে, তার ভেতরে সে অভিনীত চরিত্ররা একটু একটু করে তার ভেতরে বাসা বাঁধতে থাকে। আমি অভিনয়ের পর হয়তো মেকআপ মুছে, পোশাক বদলে, বাড়িতে ফিরে যাই, কিন্তু সেখানে আমার একা ফেরা হয় না। আমার সঙ্গে যায় অভিনীত চরিত্রের রক্ত–মাংসের সঙ্গে মিশে সে রক্ত মাংসগুলো চলে যায়।’
আবুল হায়াত আরও বলেন, ‘আজ এখানে দাঁড়িয়ে কি আমি কেবলই একজন আবুল হায়াত? না, মানুষ হিসেবে আমার ভেতরে বাস করছে সহস্র সহস্র চরিত্র। আমার ভাষায় মিশে আছে তারা, আমার চিন্তায় মিশে আছে তাদের ভাবনা প্রক্রিয়া। সুতরাং এই যে আজকের আজীবন সম্মাননা, এ পুরস্কার আমার একার নয়, সেসব চরিত্রেরও, যারা আমার ভেতর দিয়ে কখনো কখনো সত্য হয়ে উঠতে পেরেছিল, এই পুরস্কার তাদের জন্য।’
এই যাত্রায় সহকর্মী সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আবুল হায়াত বলেন, ‘আমি শ্রদ্ধা জানাই সেই সৃজনশীল নাট্যকারদের, যাঁদের হাতে সৃষ্টি হয়েছিল অসাধারণ সব চরিত্রের, যেগুলোতে আমি অভিনয় করেছি। সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি সেসব প্রযোজক পরিচালককে, যাঁরা আমাকে অভিনেতা হিসেবে ভালোবেসেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন। আন্তরিক ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানাই আমার সহশিল্পীদের, যাঁরা প্রতিমুহূর্তে আমাকে সাহায্য–সহযোগিতা করেছেন। কৃতজ্ঞতা জানাই সেসব মেকআপ আর্টিস্টকে, যাঁদের ছাড়া আমি অন্য মানুষে রূপান্তরিত হতে পারতাম না। ধন্যবাদ জানাই মঞ্চ, টেলিভিশন, ফিল্ম, রেডিও, বিজ্ঞাপন—সব মিডিয়ায় যাঁরা পর্দার পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন একটি সার্থক প্রোডাকশন তৈরি করার জন্য। ধন্যবাদ জানাই সাংবাদিকদের, যাঁরা আমাকে তাঁদের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় বারবার আবদ্ধ করেছেন।’
পরিবারের অবদানের কথা উল্লেখ করে আবুল হায়াত বলেন, ‘আর পরিবারের কথা এটুকু বলব, পরিবার আমার সব অনুপ্রেরণার উৎস। আমার মা–বাবা, আমাকে শুধু প্রশ্রয়ই দেননি, তাঁরা আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন, আজকের এই রবি বা আবুল হায়াত হতে। তাঁরা আমার সঙ্গেই আছেন, সঙ্গেই থাকেন, সব সময় থাকেন।’
জীবনের সফলতার কৃতিত্ব স্ত্রীকে দিয়ে বরেণ্য অভিনেতা বলেন, ‘আর আমার স্ত্রী শিরী, ওই যে ওইখানে বসে আছে, শিরী তোমাকে ছাড়া আমার জীবনের এই সফলতা কোনো দিনই আসতে পারত না। আজকে যে পুরস্কার পেলাম, এ পুরস্কারটা তোমার।’
সবশেষে আবুল হায়াত বলেন, ‘আমি সবশেষে যে কথাটা বলব, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন দেখি একমাত্র ভালোবাসা আর শিল্প—এ দুইটাই সত্য। আপনারা ভালো থাকবেন, সুখে থাকবেন।’
সাত দশকের অভিনয়জীবন। মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র থেকে বিজ্ঞাপনচিত্র—সব মাধ্যমেই পেয়েছেন সাফল্য। ১৯৬৮ সালে নাগরিকের ‘ইডিপাস’ দিয়ে টিভিতে অভিষেক। ১৯৭২ সালে প্রথম চলচ্চিত্র ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। এরপর উপহার দিয়েছেন একের পর এক মনে রাখার মতো চরিত্র। তিনি আবুল হায়াত।
মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার দেওয়া শুরু হয় ২০০২ সালে চতুর্থ আসর থেকে। আবুল হায়াতসহ এ পর্যন্ত ২৩ জন গুণী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। শেষ ২০২৩ সালের মেরিল-প্রথম আলোর আজীবন সম্মাননা পেয়েছিলেন প্রয়াত অভিনেতা মাসুদ আলী খান।