সাড়ে ১০ হাজারেরও বেশি হয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত

নাশকতা ও জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির অভিযোগে ২০২২ সালের ২৯ নভেম্বর মানিকগঞ্জে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের ১৫ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। ওই মামলায় ওই রাতে আটক করা হয় জেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুদ পারভেজ ও ছাত্রদলের কর্মী জসিম উদ্দিন ওরফে আকাশকে। মামলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নাশকতা সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়।

ওই মামলাটিকে ‘গায়েবি’ ও ‘হয়রানিমূলক’ মামলা হিসেবে উল্লেখ করে জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা বলেন, ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ বানচাল করতে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দেওয়া ও নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এসএ জিন্নাহ কবির বলেন, তার নামেও গত আওয়ামী লীগ আমলে ৩৩টি ভুয়া ও হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হয়রানিমূলক মামলার কারণে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের হাজারো নেতাকর্মী ছিলেন ঘরছাড়া। এভাবে শুধু মানিকগঞ্জ নয় সারা দেশে হাজার হাজার মামলা হয় বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের (বিএনপি-জামায়াত) বিরুদ্ধে।

বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তথা ২৯ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত সকল হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন-১ শাখার কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এ পর্যন্ত সারা দেশে সাড়ে ১০ হাজার মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন:  বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্য জনগণই নির্ধারণ করবে : মির্জা ফখরুল

তিনি আরও জানান, এ পর্যন্ত  সারা দেশে ১০ হাজার ৫০৬টি হয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে স্ব স্ব জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে পত্র মারফত মামলার নম্বর উল্লেখ করে জেলা পাবলিক প্রসিকিউটরকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা জানান, জেলা ম্যাজিসেট্রটকে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ৪৯৪ ধারার আওতায় এই মামলাগুলো প্রত্যাহার করে না চালানোর জন্য সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক কারণে হওয়া হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের লক্ষ্যে দুটি কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। এর মধ্যে একটি জেলা পর্যায়ের কমিটি এবং অন্যটি মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটি।

জেলা পর্যায়ের কমিটির সভাপতি হিসেবে থাকবেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সদস্যসচিব অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং সদস্য পুলিশ সুপার (মহানগর এলাকার জন্য পুলিশের একজন ডেপুটি কমিশনার) ও পাবলিক প্রসিকিউটর (মহানগর এলাকার মামলাগুলোর জন্য মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর)।

জেলা কমিটির কাছে যদি মনে হয় মামলাটি রাজনৈতিক বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে হয়রানির জন্য করা হয়েছে, তাহলে মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য কমিটি সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সেই সুপারিশ, মামলার এজাহার, অভিযোগপত্রসহ আবেদন পাওয়ার ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী তথ্যাদিসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন।

আরও পড়ুন:  ইজতেমা ময়দানে ১৪৪ ধারা জারি

এ ছাড়া ব্যক্তি পর্যায়েও আবেদন করা যাবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব অথবা আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর বরাবরেও আবেদন নেওয়া হচ্ছে। তবে সেই আবেদনগুলো যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রথমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তালিকা প্রস্তুত করে। এরপর আইন উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে রেজুলেশন আকারে অনুমোদন হয়। পরে  স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়। পরে আবারও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়। সেখান থেকে ফেরত আসার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে স্ব স্ব জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর চূড়ান্তভাবে চিঠি পাঠানো হয়।

জেলা পর্যায়ের কমিটির কার্যপরিধি ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, জেলা কমিটির কাছ থেকে সুপারিশপ্রাপ্তির পর মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটি সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। প্রত্যাহারযোগ্য মামলা চিহ্নিত করে তালিকা প্রস্তত করবে এবং মামলা প্রত্যাহারের কার্যক্রম গ্রহণ করবে। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪এর আওতাধীন মামলাগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলাগুলো দ্য ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৫৪ এর ১০(৪) ধারার বিধানমতে কমিশনের লিখিত আদেশ ছাড়া প্রত্যাহার করা যায় না বিধায় এ ধরনের মামলা চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি করতে হবে। এ ধরনের মামলার বিষয়ে করণীয় পরে নির্ধারণ করা হবে।

আরও পড়ুন:  নির্বাচন বিলম্বিত হচ্ছে, দেশও অস্থিরতার দিকে যাচ্ছে : আমীর খসরু

মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটির সভাপতি হিসেবে আছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন জননিরাপত্তা বিভাগের আইন-১ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব। আর সদস্য হিসেবে থাকছেন জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব, অতিরিক্ত সচিব (আইন ও শৃঙ্খলা) ও যুগ্ম সচিব (আইন) এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি (যুগ্ম সচিব পর্যায়ের নিচে নয়)।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত দায়ের হওয়া রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলার শিকার যে কেউ এই সুযোগ পাবেন। তবে আবেদনপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মামলার এজাহার এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিযোগপত্রের (চার্জশিট) সত্যায়িত অনুলিপি দাখিল করতে হবে।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা (পরিচালক) ফয়সল হাসান বলেন, নিরাপরাধ ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অনর্থক হয়রানি থেকে পরিত্রাণ দেওয়ার লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে গৃহীত এই কার্যক্রম চলমান থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *