অধ্যক্ষ মুকতাদের আজাদ খান
সন্দ্বীপের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সর্বজনবিধিত কয়েকজন প্রেসিডেন্ট/চেয়ারম্যান হলেন, খান সাহেব আমিন মিয়া (হরিশপুর), শামসুদ্দিন মিয়া (সন্তোষপুর),  কাজী আবদুল আহাদ (সারিকাইত), মৌলভী গোলাম খালেক (বাউরিয়া), ওসমান গনি তালুকদার (মুছাপুর), অহিদ উল্যাহ (মগধরা), মুছা মিয়া (ন্যায়ামস্তি), খান বাহাদুর খবিরুল হক (মাইটভাঙ্গা), হাফেজ আহমদ চৌধুরী (বাউরিয়া), হাজী আবদুল বাতেন সওদাগর (রহমতপুর), আসাদুল হক সাহাব মিয়া (কাটগড়-কালাপানিয়া), আলী আকবর (হুদ্রাখালী),  মোস্তফা কামাল পাশা (রহমতপুর), মাস্টার মোহাম্মদ শাহজাহান (বাউরিয়া), সেরাজুল মাওলা (মগধরা), মাস্টার হাফিজুর রহমান (মাইটভাঙ্গা), গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী (হরিশপুর), মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রফিকুল ইসলাম (হরিশপুর), মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল আলম সিএনসি (গাছুয়া), মিসেস তাহমিয়া হক চৌধুরী (কাটগড়-উড়িরচর),  মাস্টার আজিজ উল্যাহ (মগধরা) প্রমুখ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মাস্টার হাফিজুর রহমান চেয়ারম্যান সম্পর্কে আমার তালত ভাই। তিনি আমার অগ্রজ চট্টগ্রাম জজ কোর্টের সিনিয়র এডভোকেট আলহাজ্ব মুহাম্মদ সলিমুল্লাহ সাহেবের ভায়রা ভাই। আমার ভাবি চেয়ারম্যান সাহেবের সহধর্মিনীর ফুফাত বোন। আমার ভাইয়ের চেম্বারে চেয়ারম্যান সাহেবর সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। সন্দ্বীপে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হত-কথা হত। সন্দ্বীপে দেখা সাক্ষাতে তিনি আমাকে ‘প্রফেসর সাহেব’ বলে আর চট্টগ্রামে ভাইয়ার চেম্বারে দেখা হলে ‘তালত ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। তিনি একজন মজার মানুষ ছিলেন। মানুষ থেকে ষ্টাম্প বা নগদ আমানত নিয়ে তিনি কখনো শালিস বিচার করেননি। এমনকি পরিষদের সদস্যদেরকেও নগদ আমানত নিয়ে শালিস করা থেকে বিরত রাখতেন।
জন্ম-
জনাব হাফিজুর রহমান ১৯৫০ সালের ৩০ জুন মাইটভাঙ্গা ইউনিয়নের ৫ নাম্বার ওয়ার্ডের মনসাদ সারেং বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা-মুরশিদ মিয়া, মাতা- মায়মুনা খাতুন, সহধর্মিনী-হোসনে আরা বেগম। তিনি পিতা-মাতার একমাত্র ছেলে। তাঁর একমাত্র বোন দেলাপনূর বেগম দেলু।
পড়ালেখা-
জনাব হাফিজুর রহমান মুছাপুর দক্ষিণ পূর্ব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, মুছাপুর বদিউজ্জামান উচ্চ বিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগ থেকে ১৯৬৭ সালে এসএসসি, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে এইচএসসি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে ১৯৭২ সালে বিএ পাস করেন।
সাব রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগদান না করা প্রসঙ্গে-
তৎকালীন সময়ে বিএ পাস করা মানুষের সংখ্যা খুবই কম ছিল। বিএ পাস করার পর তিনি সাব-রেজিষ্ট্রার হিসেবে চাকুরীর সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে সাব রেজিস্ট্রারের চাকুরীতে যোগদান না করে সন্দ্বীপ চলে আসেন।
বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ- মুছাপুর ওমেদ আলী মুন্সির বাড়ি নিবাসী মোক্তার/এডভোকেট সেকান্দর হোসেন সাহেবের মেয়ে হোসনে আরা বেগমের সাথে তিনি ১৯৭০ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সেকান্দর হোসেন মোক্তার তাঁর শিক্ষক ছিলেন। এডভোকেট সেকান্দর হোসেনের চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে হোসনে আরা বেগম ছিলেন সবার বড়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ-
১৯৭১ সালে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।
দুই হাই স্কুলে শিক্ষকতা-
তিনি ১৯৭৩-৭৫ সালে মুছাপুর বদিউজ্জামাল উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং ১৯৭৫-৭৭ সালে আবেদা-ফয়েজ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
প্রথমবার চেয়ারম্যান নির্বাচন করেই বাজিমাত-
জনতার দাবির মুখে শিক্ষকতা ছেড়ে ১৯৭৭ সালে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়ে প্রথম বারেই বাজিমাত। নির্বাচনে তিনি দুই বাঘা প্রার্থী রানিং চেয়ারম্যান মোস্তানচ্ছের বিল্যাহ ও শক্তিশালী প্রার্থী ডা. ফোরক আহমদকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
জাতীয় পর্যায়ে গোল্ড মেডেল অর্জন-
একটানা ০৬ বার নির্বাচিত হয়ে টানা ৩২ বছর দায়িত্ব পালন করায় ২০০৬ সালে সরকার তাঁকে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান মনোনীত করে ‘প্রধানমন্ত্রী গোল্ড মেডেল’ নামক সম্মাননা স্মারক প্রদান করে।
উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা-
দেশে প্রথমবার উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালে। ঐ নির্বাচনে তিনি দ্বিতীয় হন। তখন অল্প ভোটের ব্যবধানে তিনি হেরে যান। দ্বিতীয়বার উপজেলা নির্বাচন করেন ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত নির্বাচনে। অভিযোগ রয়েছে এই নির্বাচনে তাঁকে, তাঁর কর্মী সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে যেতে দেয়নি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। তারপরও তিনি দ্বিতীয় হয়েছিলেন।
অসাম্প্রদায়িক-
বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে সংঘটিত দাঙ্গাকালে তিনি নিজের লাইসেন্স করা বন্দুক নিয়ে কোন কোন হিন্দু বাড়িতে রাতে পাহাড়া দিতেন। ফলশ্রুতিতে হিন্দুরা সব নির্বাচনে তাঁকে এককভাবে সমর্থন দিয়ে থাকতো।
প্রকৃত জনদরদী-সদা হাস্যোজ্জ্বল জনাব হাফিজুর রহমান পিতার জমি বিক্রয় করে অনেক মানুষকে প্রবাসে পাঠিয়েছেন। কেউ তাঁর সেই অর্থ ফেরত দিয়েছেন, কেউ দেননি। এতে তিনি কিছু মনে করেননি। প্রতিহিংসা পরায়ন ছিলেন না। নির্বাচনে কে পক্ষে ছিলেন কে বিপক্ষে ছিলেন তা তিনি কখনো মনে রাখেননি। সকালে নাস্তার সময় বা দুপুরে ভাতের সময় কেউ বাড়িতে আসলে না খেয়ে যেতে দিতেন না। তিনি বলতেন, মেহমান আল্লাহর নেয়ামত। খুব সহজে তিনি ছোট বড় বৃদ্ধ সবার আপন হয়ে যেতে পারতেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সম্পৃক্ততা-
মাইটভাঙ্গা জমুনিয়া হাফিজিয়া কোরআনিয়া মাদরাসা ও এতিমখানা পরিচালনা কমিটির সভাপতি, আবেদা ফয়েজ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি, সন্দ্বীপ কারামতিয়া ফাজিল মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি, মাইটভাঙ্গা দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি, সাউথ সন্দ্বীপ হাই স্কুল পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি এবং সাউথ সন্দ্বীপ কলেজ পরিচালনা কমিটিতে একাধিকবার যুক্ত ছিলেন।
রাজনীতি-
কলেজ জীবনে তিনি জাসদ এর রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। ৮০ দশকে তিনি জাতীয় পার্টি সন্দ্বীপ উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৯০ এর দশকে মাইটভাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি, উপজেলা কমিটির সদস্য ছিলেন। সবশেষে তিনি ২০০১ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আন্তরিকভাবে বিএনপি’র সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি কৃষকদল সন্দ্বীপ উপজেলা শাখার সভাপতি এবং বিএনপি’র সন্দ্বীপ উপজেলা শাখার সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ব্যক্তিগত জীবন-
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তিন ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের পিতা। তাঁর সন্তানগন হলেন, এডভোকেট আরিফুর চৌধুরী (যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আইনজীবী), মোঃ আতিক সমীর (ব্যবসায়ী), তাহমিনা বেগম শিউলী (গৃহিণী), আশিকুর রহমান রুবেল (ব্যবসায়ী)।
ইন্তেকাল
 মাস্টার হাফিজুর রহমান চেয়ারম্যান ২০২৩ সালের ১২ আগস্ট, শনিবার সকাল সাড়ে ০৮টার দিকে ৭৭ বছর বয়সে নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। একইদিন বাদ এ আছর সাউথ সন্দ্বীপ হাই স্কুল মাঠে জানাজার নামাজ শেষে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
তথ্যঋণ: জনাব এডভোকেট আরিফুর চৌধুরী এবং বিশিষ্টজন। ছবি: অনলাইন থেকে সংগৃহিত।
প্লিজ, লেখাটি কপি করলে সূত্র উল্লেখ করুন। এটি করা আপনার নৈতিক দায়িত্ব। কেননা, এই লেখাটি লিখতে আমাকে অনেক পরিশ্রম, দীর্ঘ সময় ও চিন্তার সমন্বয় করতে হয়েছে।
লেখক-
সম্পাদক ও প্রকাশক, সাপ্তাহিক আলোকিত সন্দ্বীপ পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *