‘আমাদের শৈশবকে রঙিন করেছে “আলিফ লায়লা”। সিরিয়ালটি দেখার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকতাম। স্মৃতিময় দিনগুলো খুব মিস করি।’ নব্বই দশকের আলোচিত সিরিয়াল ‘আলিফ লায়লা’র সঙ্গে বহু দর্শকের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বিটিভিতে প্রচারের পর সিরিয়ালটি দর্শকমহলে রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিল। প্রতি শুক্রবার রাত আটটার বাংলা সংবাদের পর ‘আলিফ লায়লা’ দেখতে টিভি সেটের সামনে হুড়োহুড়ি করতেন দর্শকেরা।

এক দর্শক ফেসবুকে লিখেছেন, ‘রাত সাড়ে আটটা বাজার আগেই পুরো গ্রামের মানুষের খাওয়া–দাওয়া শেষ হত। উত্তেজনা, ভয় আর আনন্দের মিশ্রণে “আলিফ লায়লা”র জন্য অপেক্ষা করতাম।’
আরেক দর্শক ফেসবুকে লিখেছেন, ‘টিভির সামনে চেয়ার পেতে, পাটি বিছিয়ে বসে পড়তাম ছোট-বড় সবাই। তখন অবশ্য বিদ্যুৎ ছিল না। ব্যাটারি দিয়ে সাদা-কালো টিভি চালিয়েই সুখ খুঁজে পেতাম।’

সূচনা সংগীত ‘আলিফ লায়লা, আলিফ লায়লা’ দর্শকের হৃদয়ে রীতিমতো উন্মাদনা তৈরি করত। পারিবারিক আবহে সিরিয়ালটি বুঁদ হয়ে দেখতেন দর্শকেরা। সিন্দাবাদ, দস্যু কেহেরমান, আলাদিন ও মালিকা হামিরার মতো চরিত্রগুলো এখনো নব্বইয়ের দর্শকদের হৃদয়ে অমলিন।
প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের জীবনেও সিরিয়ালটি ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছিল। খেলার ছলে দস্যু কেহেরমানের মতো একচোখা ‘চশমা’ বানানোর চল ছিল।

সিন্দাবাদের ‘সোলেমানি তরবারি’ নিয়ে কিশোরদের আলাদা আগ্রহ ছিল। সেই সময় মালিকা হামিরার বিচ্ছু আকরামের আদলে খেলনা বিক্রির ধুম পড়েছিল।
আশি ও নব্বই দশকে ‘দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান’, ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অব সিন্দবাদ’, ‘দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চারস অব রবিনহুড’সহ বেশ কয়েকটি সিরিয়াল বিটিভিতে প্রচার হয়েছিল। দর্শকপ্রিয়তায় শীর্ষে ছিল ‘আলিফ লায়লা’; সিরিয়ালটির জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী।

কোথা থেকে এল
আশির দশকে বেশ কয়েকটি ইংরেজি সিরিয়াল বিটিভিতে ‘অরিজিনাল ভাষায়’ প্রচার করা হত। তবে ‘আলিফ লায়লা’ বাংলা ভাষায় ডাব করে প্রচার করা হয়েছিল। বলা হয়, এটিই বিটিভিতে বাংলা ভাষায় প্রচারিত প্রথম কোনো বিদেশি সিরিয়াল।
আরব্য রজনীর ‘আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ’, ‘আলী বাবা ও চল্লিশ চোর’, ‘নাবিক সিন্দাবাদের গল্প’সহ বেশ কয়েকটি গল্প অবলম্বনে হিন্দি ভাষায় ‘আলিফ লায়লা’ বানিয়েছে ভারতীয় প্রযোজনা সংস্থা সাগর এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেড। সুভাষ সাগরের প্রযোজনায় ‘আলিফ লায়লা’ নির্মাণ করেছেন অমৃত সাগর ও শক্তি সাগর।

সিরিয়ালটি ১৯৯৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘দূরদর্শন ২’ চ্যানেলে প্রচারে আসে। ১৪৩ পর্বের সিরিয়ালটির প্রতিটি পর্বের দৈর্ঘ্য ২৩ মিনিট। পরবর্তীতে দর্শকের আগ্রহ বিবেচনা করে সেটি বাংলা ভাষায় বিটিভিতে প্রচারিত হতে থাকে।
জানা গেছে, ভারতেই সিরিয়ালটি বাংলা ভাষায় ডাব করেছে সাগর এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেড। বাংলা ডাব করা ‘আলিফ লায়লা’ বিটিভি অবিকৃতভাবে প্রচার করেছিল। সিরিয়ালটি প্রচারের জন্য চুক্তি অনুযায়ী সাগর এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেডকে অর্থ পরিশোধ করেছিল রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনটি।

‘আলিফ লায়লা’ দেখে বিটিভিতে চিঠি লিখতেন দর্শকেরা। তখন এই সিরিয়াল নিয়ে পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখিও হতো।
সিরিয়ালটি বিটিভিতে প্রচারের পর ২০০০ সালের দিকে একুশে টিভিতেও সেটি প্রচারে এসেছিল। মাঝে গাজী টিভিতেও প্রচারিত হয়েছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে ‘আলিফ লায়লা’ তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বাংলাদেশের বাইরে মিসর, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকায়ও প্রচারিত হয়েছে। ‘আলিফ লায়লা’ ভারতে সেরা সিরিয়াল হিসেবে একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছে।
নির্মাণে, অভিনয়ে ছিলেন কারা
সিরিজের প্রযোজক, নির্মাতা ও শিল্পীদের মধ্যে কেউ কেউ বেঁচে নেই। এর মধ্যে সিরিয়ালের প্রযোজক সুভাষ সাগর ভারতের বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল প্রযোজনা করেছেন। প্রযোজনার পাশাপাশি অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবেও তিনি পরিচিত। ২০০৯ সালে ৭২ বছর বয়সে মারা যান সুভাষ সাগর।
সিরিয়ালটি সহপ্রযোজনা করেছেন প্রেম সাগর। চিত্রনাট্য লিখেছেন দিপালি জানজাপ্পা। সংগীত করেছেন গৌরব ইসার।
বাদশাহ শাহরিয়ারের ভূমিকায় দেখা গেছে পাঞ্জাবের অভিনেতা গিরিজা শঙ্করকে; যিনি এ সিরিয়ালে অভিনয়ের আগে ‘মহাভারত’ সিরিয়ালে অভিনয় করে ভারতজুড়ে পরিচিতি পেয়েছিলেন।

অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে তাঁর। রিয়ালের পাশাপাশি ‘হক’, ‘হানিমুন’, ‘গাদ্দার: দ্য ট্রেইটর’সহ বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন ৭৫ বছর বয়সী গিরিজা শঙ্কর।

বাদশাহ শাহরিয়ারের স্ত্রী শেহেরজাদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ভারতীয় অভিনেত্রী দামিনি কানওয়াল শেঠি। শতাধিক টিভি সিরিয়ালের এই অভিনেত্রী চিত্রনাট্যকার ও প্রযোজনায়ও যুক্ত আছেন। তিনি ২০২১ সালে ‘চয়েজ’ নামে একটি হিন্দি সিনেমা পরিচালনাও করেছেন।

আলাদিনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেতা নবদীপ সিং। অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালক, প্রযোজক ও সংগীত পরিচালক হিসেবেও পরিচিত তিনি।
সিন্দাবাদ চরিত্রে অভিনয় করেছেন ভারতীয় অভিনেতা শাহনেওয়াজ প্রধান। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মারা গেছেন তিনি। শাহরুখ খানের ‘রইস’, সাইফ আলী খানের ‘ফ্যান্টম’, ওয়েব সিরিজ ‘মির্জাপুর’-এ অভিনয় করেন শাহনেওয়াজ।
তথ্যসূত্র: সাগর ওয়ার্ল্ড