সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বাঙালি নববর্ষ অন্য রকমের, মধ্যরাতের নয়, অতিপ্রত্যুষের; সূর্য ওঠার আগের। একুশে ফেব্রুয়ারিও তা-ই ছিল, সে দিনটিরও সূচনা হতো প্রভাতফেরি দিয়ে; মধ্যরাতে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন শুরু হয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। বাঙালিপনার দিক থেকে বিচার করলে রাত ১২টা ১ মিনিটে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন শুরু করাটা অপ্রত্যাশিত বটে। উদযাপনের এই নতুন পদ্ধতি থেকে বোঝা গেছে স্বাধীনতার পর স্বাধীন দেশের গতি কোন দিকে হবে– পূর্বমুখী নাকি পশ্চিমমুখী। পূর্বে সকাল, পশ্চিমে মধ্যরাত। মধ্যরাতে একুশের উদযাপন যে কেমন ঝুঁকিপূর্ণ বিশেষ করে মেয়েদের পক্ষে, সেটাও প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু পহেলা বৈশাখকে নিশ্চয়ই রাতের ব্যাপারে করা যাবে না। থার্টি ফার্স্ট নাইটকে যেমনভাবে করা হয়ে থাকে।
থার্টি ফার্স্ট নাইটের সঙ্গে পহেলা বৈশাখের এই ব্যবধানটা একেবারেই মৌলিক। সকালকে আমরা সকালেই চাই, গভীর রাতের অন্ধকারে নয়। উদযাপনের পদ্ধতিতেও পার্থক্য রয়েছে। পহেলা বৈশাখের গান আর ইংরেজি নববর্ষের গান কখনোই এক রকম হবে না। হওয়া সম্ভব নয়। লোকগুলোও আলাদা। পোশাক-পরিচ্ছদ তো বটেই। তবে এটা অবশ্য ঠিক যে, যারা থার্টি ফার্স্ট নাইটের অন্ধকারকে আলোকিত করে আমোদ-আহ্লাদ করে থাকে, তাদের সবার না হোক, কারও কারও পিতামাতা এখনও পহেলা বৈশাখে কিছু দূর গাড়িতে গিয়ে কিছুটা পায়ে হেঁটে রমনা বটমূলে উপস্থিত হন। অন্যদিকে থার্টি ফার্স্ট বেশ রহস্যময়, উদযাপনকারীদের মতোই। তুলনায় পহেলা বৈশাখ খোলামেলা।
তবে আশঙ্কা করাটা মোটেই অমূলক নয় যে, যতই দিন যাবে ততই আমরা অধিক মাত্রায় পশ্চিমমুখো হব, আমরা মানে আমাদের মাথারা, তারাই তো সব। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জের কথা এখন খুব ধুমধামে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু চ্যালেঞ্জটা কী তা বলা হচ্ছে না। কম্পিউটার প্রযুক্তি, ইনফরমেশন টেকনোলজি, এসবের কথা শুনি, কিন্তু আসলে চ্যালেঞ্জটা যে অন্য কিছুর নয়; সরাসরি যে বাজারের, সে-কথাটা শুনি না। বিশ্বায়ন অর্থ হচ্ছে বিশ্বের দিক থেকে বাজার দখল এবং একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে সেই বাজারের সর্বগ্রাসী প্লাবনের মুখে আক্রান্ত রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে আত্মরক্ষা ও নিজের পায়ে দাঁড়ানো। নানান প্রচারণা ও প্রতারণার সাহায্যে এই সত্যটাকে অন্তরালবর্তী করার চেষ্টা চলছে। তথাকথিত উন্নত বিশ্ব তাদের পণ্য আমাদের দেশে অবাধে পাঠাবে, আকাশপথে পণ্যের মাহাত্ম্য প্রচার করবে, দরকার থাকুক না-থাকুক বাধ্য হবে। সেসব পণ্য কিনতে। আমাদের উৎপাদকরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না, ক্রমান্বয়ে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমরা পরিণত হবে ক্রেতায় ও দোকানদারে এবং সেবকে। আমাদের লোকেরা যাতে ওসব জিনিস কিনতে পারে তার জন্য ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়াস অব্যাহত থাকবে। ম্যাক্রোক্রেডিট ও মাইক্রোক্রেডিট দুটোই আসবে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সহযোগিতার অভাব ঘটবে না।
কেবল যে ভোগ্যপণ্য কেনা হবে তা নয়, সমরাস্ত্রও কেনা হতে থাকবে। বিশ্বব্যাংক যা চাইবে বাংলাদেশ তা-ই করবে। আমলারা চাকরি ও অন্যান্য সুবিধার লোভে বিশ্বব্যাংককে সন্তুষ্ট করতে ব্যস্ত থাকবেন। গ্যাস ও তেল এবং কয়লা বাংলাদেশের বড় সম্পদ, সে-সম্পদও বিদেশি কোম্পানিগুলো অনুসন্ধান, উত্তোলন ও বিতরণের দায়িত্ব নিয়ে হস্তগত করে ফেলবে। বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল সমানভাবে আত্মস্বার্থ পুষ্টকরণে ব্যস্ত এবং সে-কারণে বিদেশি কর্তাদের সন্তুষ্ট করতে সচেষ্ট; কাজেই গ্যাস, তেল ও কয়লা বাংলাদেশের জন্য সম্পদ না হয়ে যে বিপদের কারণ হতে পারে– এই আশঙ্কটা মোটেই অমূলক নয়।
অতীতেও এমনটা ঘটেছিল। বাংলার সম্পদই বাংলাকে বিপদে ফেলেছিল; দেশ চলে গিয়েছিল বিদেশিদের দখলে। এবারও সেটাই ঘটতে পারে। যদি আমরা সতর্ক না থাকি।
বিদেশি পণ্য অবাধে আসছে, কিছু আসছে বৈধ পথে, তার চেয়েও অধিক পরিমাণে আসছে অবৈধ উপায়ে, চোরাচালানের মধ্য দিয়ে। সেই সঙ্গে আকাশপথে চলছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। সামনে পুঁজিবাদী সংস্কৃতির যত বিকৃতি রয়েছে, আমরা নিজের খরচায় এসব নোংরা ও ক্ষতিকর বস্তু নিয়ে আসছি। ভাবছি উপকার হচ্ছে। বিশ্বায়নের এও একটি পথ। বাজার দখল করবে, মগজও দখল করবে। বাজারও মগজ দখলই এক প্রকারের এবং মগজ-দখল বাজার দখলকে চিরস্থায়ী করার পদ্ধতিও বটে।
উপায়টা তাহলে কী? কীভাবে বাঁচব আমরা বিশ্বায়নের এই আগ্রাসন থেকে? কী করে রক্ষা করব পহেলা বৈশাখের সকালকে, থার্টি ফার্স্ট মিডনাইটের নিষ্ঠুর গ্রাস থেকে? জবাবটা নিহিত রয়েছে ওই শেষ প্রশ্নটির ভেতরেই। দাঁড়াতে হবে পহেলা বৈশাখের পক্ষে। দৃঢ়তার সঙ্গে এবং ঐক্যবদ্ধ অঙ্গীকারে।
তার মানে কি এই যে, আমরা বিশ্ববিমুখ হব? পরিণত হব কুয়োর ব্যাঙে? না, মোটেও তা নয়। বিশ্বের যেখানে যা কিছু মহৎ আছে আমরা নেব। অবশ্যই নেব, কিন্তু নিতে হবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, বৃক্ষের মতো এবং বৃক্ষের আদর্শে; পরগাছার মতো নয়, তার আদর্শ অনুসরণ করেও নয়। শুধু আমরা কেন, সারাবিশ্বেই আজ ওই ধ্বনি উঠেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হবার কথা জাতিসংঘের চেয়ে শক্তিশালী ও দুর্ধর্ষ প্রতিষ্ঠান, সে পথেই এগোচ্ছিল। কিন্তু একটা অপ্রত্যাশিত বিস্ফোরণ ঘটে গেল। তার সম্মেলন উপলক্ষে, আর সেটা ঘটেছিল অন্য কোথাও নয়, খোদ আমেরিকাতেই। সিয়াটলে। অপ্রত্যাশিত বটে, কিন্তু ঘটনাটা অস্বাভাবিক নয়। কেননা, বিক্ষোভ আছে, বিক্ষোভ জমছে। এই বিক্ষোভেরই একটা ভিন্ন রকমের আত্মপ্রকাশ হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি। একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনে আমরা যতই থার্টি ফার্স্ট নাইটের উপাদান সংযুক্ত করার চেষ্টা করি, এ দিবস মাতৃভাষা দিবসই আসলে; সে-হিসেবেই বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে। স্বীকৃতির পেছনে রয়েছে এই বোধ যে, প্রতিটি জাতিসত্তারই আছে নিজের মতো করে এবং নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে টিকে থাকার অধিকার। স্বীকৃতিটি সতর্ক করে দিচ্ছে এই বলে যে, বিশ্বায়ন যেন বাড়াবাড়ি না করে। সবকিছুকে যেন এক মানদণ্ডে বিচার না করে। পুঁজিবাদের নিজস্ব রাষ্ট্রভাষা রয়েছে, সে ভাষা সকলের মাতৃভাষা নয়। কিন্তু সকলের মাতৃভাষা থাকবে। তাকে বাঁচাতে হবে। পহেলা বৈশাখের কাছেই যেতে হবে, যে-পহেলাতে একুশে ফেব্রুয়ারিও অন্তর্ভুক্ত বটে। পহেলা বৈশাখের যে-স্বাতন্ত্র্য ও নিজস্বতা, একুশে ফেব্রুয়ারি তাকেই রক্ষা করতে চেয়েছে, আন্দোলনের ভেতর দিয়ে। এবং ওই লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে অনিবার্য করে তুলেছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।

ই দেশ এখনও কতটা স্বাধীন সে-নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবশ্য অসংগত নয়। এবং অসংগত যে নয় তার অন্য সব প্রমাণের একটি হচ্ছে এই সত্য যে, পহেলা বৈশাখ এখনও সর্বজনীন হয়নি। বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে বিদ্যমান শাসনামলে। বাঙালির নববর্ষ এখনও সকল বাঙালির নয়। কেবল বিত্তবানদেরই, গরিবদের নয়। গরিব মানুষ চৈত্র-বৈশাখের আগমনে উৎফুল্ল হয় না। সকালে নবজীবন দেখে না, প্রচণ্ড রৌদ্রের আশঙ্কা দেখে, চৈত্রদিনে তারা যে সর্বনাশটা দেখতে পায়, সেটা প্রিয়ার চোখে নয়, প্রকৃতির চোখে বটে। বড়লোকদের যে-অংশ ক্ষমতাধর তারা ইংরেজি নববর্ষই পালন করে। পহেলা বৈশাখ পালন করে না। সেটাও এই কথাটাই বলে দিচ্ছে যে, সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে অনেক অনেক দূরে, তারা পহেলা বৈশাখে নেই, থার্টি ফার্স্ট যে কোথায় ঘটে, কোন আলোকিত অন্ধকারে– সে খবর তো তারা রাখেই না। স্বাধীনতা পূর্ণ হয়নি, মুক্তি তো আরও পরের কথা। অর্থনীতি পঙ্গু ও আবদ্ধ, সংস্কৃতি আগ্রাসন-কবলিত এবং সার্বিকভাবে ভবিষ্যৎ বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন; এই পরিবেশে পহেলা বৈশাখের সাতসকাল কোন বাণী নিয়ে আসে কে জানে।
বাণী অবশ্য আছে। সেটা রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা যে-বাণী দেবেন সেটা নয়, গণমাধ্যম ও প্রচারমাধ্যম যা নিয়ে হইচই করতে থাকবে তাও নয়, সেটি হচ্ছে এই যে– তোমরা আত্মসমর্পণ করো না, তোমরা রুখে দাঁড়াও এবং ঐক্যবদ্ধ হও। ঐক্য ছাড়া শক্তি নেই, ব্যক্তিগত উদ্যম বা বিদ্রোহে কাজ হবে না, সমষ্টিগত প্রচেষ্টা চাই।
এই কথাগুলো বাংলা ভাষার যারা চর্চা করছেন তারাও বলে গেছেন বিভিন্নভাবে, সুরে ও কণ্ঠে। তাদের কথাই বলছি যারা আমাদের গর্ব। তাদের কারণে আমাদের মাতৃভাষা আজ এতটা পর্যন্ত আসতে পেরেছে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসূদন, মীর মশাররফ, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ– এরা এক মাপের ছিলেন না, কিন্তু সকলেই মনীষী ছিলেন এবং ছিলেন পহেলা বৈশাখের পক্ষে। আধিপত্য মানেননি। অথচ লিখেছেন তাঁরা ঔপনিবেশিক শাসনের প্রসারিত থাবার নিচে বসে।