সন্দ্বীপ ফেরি চলাচলে যেসব চালেঞ্জ দেখছেন দ্বীপবাসি

দেশের প্রথম সমুদ্রগামী ফেরি পেয়ে উচ্ছ্বসিত সন্দ্বীপবাসী। ঈদের আগে এমন উপহার পেয়ে দারুন উচ্ছ্বসিত সন্দ্বীপের সাড়ে ৫ লক্ষ মানুষ। তাদের জীবনে এমন খুশির দিন খুব একটা আসেনি। শত বছরের নৌ যাতায়াতের সমস্যা ফেরির মধ্য দিয়ে আশা জাগালেও এতে সমস্যার যেন অন্ত নেই। তবুও সমস্যা সমাধানের আশায় বুক বেঁধেছেন তারা। তবে যে ফেরির ওপর ভর করে নতুন করে স্বপ্ন দেখছে চার লাখ সন্দ্বীপবাসী, সেই ফেরিই প্রাকৃতিক কারণে সবসময় চালু রাখা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন করতে তাই সি ট্রাক ও কোস্টাল ফেরি চালু করা, নিয়মিত চ্যানেল ড্রেজিং, ফেরি ঘাটের স্থায়ী কাঠামো নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উঠে এসেছে।

এদিকে দ্বীপবাসী আশা করছে, বহু প্রতীক্ষিত ফেরি চালুর পর দ্বীপের সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কর্মসংস্থানসহ নানা সমস্যার হয়ত সমাধানের পথ খুলবে।

সন্দ্বীপ উপজেলার মাইট ভাঙার বাসিন্দা মো. ফসিউল আলম যেমন আশা করছেন, ফেরি চালু হওয়ায় দ্বীপে অনেক জিনিসের দাম কমবে।

এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, সরাসরি গাড়ি যেতে না পারার কারণ দেখিয়ে দ্বীপে অনেক জিনিসপত্রের বেশি দাম নিত। এখন ফেরিতে গাড়ি পারাপার হবে পণ্য নিয়ে। তাই জিনিসপত্রের দাম কমবে।

“আগে ঘাটের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ছিলে সন্দ্বীপের মানুষ। ফেরি চললে সেই অবস্থা আর থাকবে না।”

শুধু তাই নয়, ভাঙনপ্রবণ দ্বীপ সন্দ্বীপে যাতায়াতের সমস্যার কারণে গত কয়েক দশকে বহু মানুষ এ উপজেলা ছেড়েছে বলে জানালেন মো. ফসিউল আলম।

তিনি বলেন, “সন্দ্বীপের অনেক মানুষ শুধু চলাচলের সমস্যার কারণে সীতাকুণ্ড বা অন্যত্র জমি কিনে চলে গিয়েছিল। এখন আবার তারা হয়ত দ্বীপে ফিরবে।”

এ দ্বীপের মানুষের অন্যতম প্রধান চাওয়া হল সন্দ্বীপকে ভাঙন থেকে রক্ষা করা।

ফেরি চালু উপলক্ষে ঢাকা-সন্দ্বীপ এবং চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ রুটে নতুন করে বিআরটিসির বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। ফেরি উদ্বোধনের আগে এই বাস সেবার উদ্বোধন করেন উপদেষ্টারা। ছবি: মিঠুন চৌধুরী

আরও পড়ুন:  ৮০ জন চিকিৎসকের ১০ ঘণ্টার চেষ্টায় আলাদা শিফা ও রিফা

‘সন্দ্বীপের রাজনৈতিক, সামাজিক, পেশাজীবীসহ সর্বস্তরের নাগরিক সমাজ’ এর আহ্বায়ক আকবর হোসাইন বলেন, “সন্দ্বীপ ভাঙনপ্রবণ একটি দ্বীপ। তাই আমরা দ্বীপের চর্তুদিকে ডাবল লাইন রিং রোড বিশিষ্ট ব্লক বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছি।

“সন্দ্বীপ-স্বর্ণদ্বীপ-নোয়াখালী ক্রসড্যাম নির্মাণ ও ইতোমধ্যে গৃহীত উড়িরচর টু কোম্পানিগঞ্জ ক্রসড্যাম বাস্তবায়ন চাই। উড়িরচরের ভাঙন রোধে বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন। পাশাপাশি সব বাঁধের বাইরের অংশ বনায়ন করলে পরিবেশ রক্ষা হবে।”

সোমবার সকাল সাড়ে ৮টায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেরার বাঁশবাড়িয়া ঘাটে এই ফেরি সেবার উদ্বোধন করেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন ।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান; মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম; প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতারও উপস্থিত ছিলেন এসময়।

সকাল ৯টায় প্রথমবারের মত ফেরি যাত্রা করে সন্দ্বীপের উদ্দেশ্যে।

এ উপলক্ষে সন্দ্বীপ উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে আয়োজিত সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।

ফেরি যখন সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া ঘাট থেকে ছেড়ে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন উপস্থিত ছয় উপদেষ্টার সঙ্গে সন্দ্বীপবাসীর মত বিনিময় সভায় নিজেদের নানা প্রত্যাশা ও বঞ্চনার কথা তুলে ধরেন দ্বীপের বাসিন্দারা।

উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত হোসেন বলেন, “দ্বীপের অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ডাবল লেইন সড়ক দরকার। সমুদ্র পারাপারের সমস্যার কারণে অনেক রোগী মারা যান। কারো চিকিৎসায় বিলম্বের কারণে অনেক শারীরিক ক্ষতি হয়ে যায়।

আরও পড়ুন:  সাবেক সংসদ সদস্য নদভী আটক

“তাই উপজেলার হারামিয়া ২০ শয্যার যে হাসপাতালটি আছে, সেটিকে সচল করে ৩১ শয্যায় উন্নীত করতে হবে। সন্দ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলের চিকিৎসা কেন্দ্রটি ১০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত করা এবং উড়িরচরের ইউনিয়ন চিকিৎসা কেন্দ্রটি ১০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত করা আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি।”

সন্দ্বীপের এই ফেরি সেবা চালুর উদ্যোগ নেন দ্বীপের সন্তান বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।

সমাবেশে তিনি বলেন, “এটি একটি দুরূহ প্রকল্প। বাংলাদেশে সামুদ্রিক ফেরি চলাচলের অভিজ্ঞতা নেই। সংশ্লিষ্ট সবাইকে অর্ধেক ধন্যবাদ। বাকি ধন্যবাদ দিব সন্দ্বীপের অন্য সব সমস্যা দেখে সেগুলোর সমাধান করলে।”

সমাবেশে প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত বিশেষ সহকারী ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, “শুধুমাত্র সময়মত মূল ভূখণ্ডে পৌঁছাতে না পারার কারণে অনেক রোগী মারা গেছেন সন্দ্বীপের। এজন্য দুঃখিত।

“এখানে ২০ শয্যার যে হাসপাতালটি আছে, সেটি সক্রিয় করার চেষ্টা করব। সেটিকে ৩১ শয্যায় উন্নীত করা যায় কিনা তার যৌক্তিকতা যাচাই করে দেখা হবে।”

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, “দুর্গম অঞ্চলে সব সেক্টর অবহেলিত থাকে। আমার বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে আজই কথা বলব। শিক্ষাখাতের সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করব।”

কিন্তু যে ফেরিকে ঘিরে এত মানুষ আশায় বুক বাঁধছে, সেই ফেরি বৈরী আবহাওয়ায় কতটা সচল থাকতে পারবে?

‘কপোতাক্ষ’ ফেরির মাস্টার সামশুল আলম সাইফুল বাঁশবাড়িয়া ঘাটে দাঁড়িয়ে ফেরি ছাড়ার আগে বলেন, “এই ঘাটের পাশে কোনো সার্পোটিং নেই। জোয়ারের পানি বাড়লেই পন্টুন ভেসে ভিতরের দিকে চলে যায়। ট্রায়ালের সময় কখনো কখনো ফেরি চালিয়ে রাখতে হয়েছে। তারপর ঘাটের দিকে বস্তা দিয়ে এরপর গাড়ি নামাতে হয়েছে। এটার স্থায়ী সমাধান দরকার।”

ফেরি উদ্বোধনের পর সন্দ্বীপ উপজেলা পরিষদের মাঠে অনুষ্ঠিত সমাবেশে ফেরির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমদ মোস্তফাও কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেন।

আরও পড়ুন:  পুলিশের অনুপস্থিতিতে রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ শিক্ষার্থীরা

তিনি বলেন, “জোয়ারের সময় ঘাটের সামনের অংশ পানিতে ডুবে থাকে। ফেরিঘাট নির্মাণে সাফল্য ধরে রাখা চ্যালেঞ্জিং। দুই পাড়ে খাল খনন করে যে চ্যানেল সৃষ্টি করা হয়েছে তা নিয়মিত ড্রেজিং করতে হবে।

“মার্চ থেকে সাগর উত্তাল হতে শুরু করে। প্রায় ১৮ কিলোমটার এই নৌপথ। ভরা ও মরা কাটালের সময় ৭ মিটার বা ২১ ফুট উচ্চতার তারতম্য হয়। এখানে সাগরে চলাচল উপযোগী ফেরি প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় জনবল ও বরাদ্দ দরকারি।”

উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণের সমাবেশে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ সন্দ্বীপে বর্ষায় চলাচলের জন্য দুটি সি ট্রাক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “বাংলাদেশের কোন উন্নয়নই উন্নয়ন না, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ উন্নত না হয়।

“তবে এই যে ফেরি, এটা টেম্পোরারি। দু-তিন মাস চলবে। এখনো আমরা সি ট্রাক দেব। সি ট্রাকে গাড়ি আসতে পারবে না। লোকজন আসতে পারবে। এখানে গাড়ি ও মানুষ পারাপারের জন্য কোস্টাল ফেরি দিতে হবে। সেটা আমাদের নেই। আনতে হবে।”

সন্দ্বীপের মানুষের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য, ছয় জন উপদেষ্টার আশ্বাস এবং বহুল প্রতীক্ষিত ফেরি চলাচল শুরু হওয়ায় আশাবাদী দ্বীপের বাসিন্দা মো. হেলাল।

তিনি বলেন, “আমাদের সন্দ্বীপের অনেক বঞ্চনা। কিন্তু স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা আশ্বাস দিয়েছেন। অতীতে বারেবারে ফেরি চলাচলের আলোচনা হলেও কেউ তা করেনি। এই সরকার সাত মাসের মধ্যে সেটা করতে পেরেছে।

“তাই আশা করি অন্য সমস্যাগুলোও একে একে হয়ত সমাধানের পথে আগাবে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *