দেশে ১৬ শতাংশ শিশু টিকা পায় না: গবেষণা

টিকাদান কার্যক্রমের মাধ্যমে ভ্যাকসিন প্রতিরোধযোগ্য রোগ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের যথেষ্ট অগ্রগতি ও অর্জন রয়েছে। তবে গত প্রায় ১২ বছর ধরে একই বৃত্তে আটকে আছে বাংলাদেশ। এই সময়ের মধ্যে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) মাধ্যমে দেশে টিকাদান অব্যাহত থাকলেও কোনোভাবেই ইপিআই কভারেজ ৮৪ শতাংশের ওপরে উঠতে পারছে না দেশ। এর ফলে এখনো দেশের ১৬ শতাংশের বেশি শিশু টিকা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমনকি এই কার্যক্রমে সবচেয়ে বেশি অবহেলা দেখা গেছে শহরকেন্দ্রিক টিকাদানে।

সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন ও ইউনিসেফ বাংলাদেশ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার এ তথ্য তুলে ধরেন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ।

অনুষ্ঠানে গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করে তিনি জানান, বাংলাদেশে ১৯৮৪ সালে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির কভারেজ ছিল ২ শতাংশের নিচে, যা বর্তমানে ৮৩ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তবে গ্রাম, শহর নির্বিশেষে এই কভারেজে ব্যাপক ভিন্নতা রয়েছে। টিকা কর্মসূচিতে শহরকেন্দ্রিক কার্যক্রমে ব্যাপক অবহেলা দেখা গেছে।

কার্যক্রম থাকলেও উন্নতি না থাকার প্রধান কারণ হিসেবে জনবলের ঘাটতির কথা তুলে ধরে ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে ইপিআই কর্মসূচির অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে টিকা কার্যক্রমে জনবলের ঘাটতি। এ ছাড়া অঞ্চলভিত্তিক টিকাকেন্দ্রের অসম বণ্টন, অপর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ, টিকার অপর্যাপ্ততা, টিকাদান কর্মীদের প্রশিক্ষণের অভাব, দুর্গম এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় টিকা পরিবহনজনিত সমস্যা, টিকাদান সম্পর্কিত প্রচারণার অভাবসহ নানা সমস্যা রয়েছে।’

আরও পড়ুন:  অভিনেতা মাহফুজ আহমেদের ব্যাংক হিসাব তলব

গবেষণায় উঠে এসেছে, মন্ত্রণালয়ের অধীনে শহর ও গ্রামে টিকাদান প্রকল্পে বরাদ্দকৃত জনবলের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ পদ এবং ইপিআই সদর দপ্তরে ৪৩ শতাংশ পদ এখনো শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া বরাদ্দকৃত জনসংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় কম, কারণ আরবান ইমিউনাইজেশন স্ট্র্যাটেজি-২০১৯ এবং ইপিআই মাইক্রোপ্ল্যান-২০২৪ অনুসারে প্রতি ৫০ হাজার জনসংখ্যার জন্য ছয়জন টিকাদানকর্মী প্রয়োজন, যা বাংলাদেশে এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি।

নিজাম উদ্দিন আহমেদ জানান, আগামী ২০২৯ সালের পর গ্যাভি টিকাদান প্রকল্পে সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে সরকারকে নিজস্ব অর্থায়নে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করতে হবে। ইপিআইর সাম্প্রতিক তথ্যানুসারে অক্টোবর ২০২৪ সাল পর্যন্ত টিকায় বাজেট বরাদ্দ থাকলেও বিশেষ কিছু এন্টিজেন যেমন- পিসিভি, ওপিভি এবং এমআর টিকার সংকট দেখা যাচ্ছে। টিকাদান কর্মীদের নিয়োগের পর টিকাদান বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও রিফ্রেসার প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া সারা দেশে শহর থেকে গ্রামপর্যায়ে টিকাদানকেন্দ্র পরিদর্শন, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের অভাব দেখা গেছে। দুর্গম এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় টিকা পরিবহন একটি বড় সমস্যা। বিশেষ করে পাহাড়ি, হাওর এবং নদীতীরবর্তী এলাকায় যানবাহনের সমস্যা থাকায় সঠিক সময়ে টিকাদানকেন্দ্রে টিকা পরিবহন সহজ হয় না। বস্তিবাসী, ভাসমান জনগোষ্ঠী, পাহাড়ি, হাওর এবং নদীতীরবর্তী এলাকায় টিকাদানের লক্ষ্যমাত্রা অজানা থাকায় জিরো ডোজ এবং মিসড ডোজ শিশুদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।

আরও পড়ুন:  শীতকালে কালোজিরাতেই পাবেন সব রোগের মুক্তি!

গবেষণার প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) উচ্চ কভারেজ নিশ্চিতের জন্য সুপারিশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো– স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে শহর ও গ্রামে টিকাদান প্রকল্পে বরাদ্দ করা জনবলের মধ্যে যে শূন্যপদ আছে সেখানে দ্রুত নিয়োগ দেওয়া; জনসংখ্যাভিত্তিক জনবলনীতি অভিযোজন করা; জনসংখ্যার ঘনত্বের ওপর ভিত্তি করে টিকাকেন্দ্রের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা; প্রতিটি টিকাদানকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা; ভ্যাকসিন সরবরাহ ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা; অদূর ভবিষ্যতে ভ্যাকসিনের যে সংকট দেখা দিতে পারে, সে ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া।

এছাড়া ইপিআই প্রোগ্রাম মনিটরিং এবং মূল্যায়নের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের অনুপ্রাণিত করে মানসম্পন্ন তত্ত্বাবধান এবং পর্যবেক্ষণ নিশ্চিতের মাধ্যমে টিকাদান কর্মসূচিকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। তা ছাড়া ভৌগোলিক এবং আর্থ-সামাজিক বৈষম্য চিহ্নিত করতে এবং শহুরে টিকাদান নীতিকে শক্তিশালী করার জন্য নিয়মিত মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। টিকাদানের ক্ষেত্রে একটি ডেটাবেজ তৈরি এবং কার্যকর করা প্রয়োজন, যা জাতীয় কর্মশক্তি পরিকল্পনার জন্য সঠিক তথ্য নিশ্চিত করবে। বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা এবং নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মানুষের মধ্যে টিকাদান নিশ্চিতের জন্য নির্দিষ্ট কৌশলের পরিকল্পনা (ম্যাপিং, মোবাইল ক্লিনিক, ডোর-টু-ডোর টিকাদান) বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং টিকাদানের জন্য সর্বোত্তম বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করার পাশাপাশি অ্যাডভোকেসি, বিকল্প তহবিল উৎসের জন্য নীতি সংস্কার এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব নিশ্চিত করাও জরুরি।

আরও পড়ুন:  সামাজিক মাধ্যম আসছে আয়করের আওতায়

সংবাদ সম্মেলনে আরও ছিলেন– ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন পরিচালিত ওই গবেষণা প্রকল্পের পলিসি অ্যাডভাইজার অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম, রাড্ডার নির্বাহী পরিচালক ডা. নাসরিন আখতার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *