বাংলাদেশ ঘনিষ্ট কূটনীতিককে কেন পদ ছাড়তে বলেছেন ট্রাম্প?

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে আজ শপথ নিতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের আগেই সম্প্রতি তার সহযোগীরা বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটসহ দেশটির তিনজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিককে পদত্যাগ করতে বলেন। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা একে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক বহরে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত হিসেবেই দেখছেন, যার ছোঁয়া বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কেও লাগতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ বলেন, ‘ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের আগেই দেখেছি তাকে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দিতে। এরই মধ্যে তিনজন কূটনীতিককে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে। ট্রাম্প হলেন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিতে বিশ্বাসী। তাই কূটনৈতিক রদবদলের জন্য এমন আরও অনেক উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের পদত্যাগ করতে বলা হতে পারে। বাংলাদেশ আমেরিকার কাছ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের ছোট একটি দেশ, যার চারদিকে ভারতবেষ্টিত এবং ভৌগোলিক কারণে চীন ও ভারতের সবচেয়ে নিকটের দেশ। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে আমাদের সংযোগ রয়েছে আর চীনকে ঘিরে ট্রাম্পের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি আছে। তাই সে হিসেবে কিছুটা গুরুত্ব আছে বাংলাদেশের। বিগত সরকারের আমলেই যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া ছিল একটা ইনক্লুসিভ নির্বাচন। এখন যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার আছে দেশে, তাই এ সময়ে আমেরিকার দৃষ্টি থাকবে একটা ফ্রি ফেয়ার ইলেকশন যেন বাংলাদেশে হয়। আর হিউম্যান রাইটস যেন নিশ্চিত করা যায়, এসবে ট্রাম্পের নজর থাকবে।’

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় দেখা দরকার। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘ট্রাম্প এবার যেভাবে জিতেছেন, তা ঐতিহাসিক কারণ। এত ম্যান্ডেট আগে কেউ পায়নি যুক্তরাষ্ট্রে। নির্বাচনের আগেই তিনি বলেছিলেন, ‘ডিপ স্টেট’কে মুছে ফেলতে চান। কারণ, এতে কোনো লাভ হয়নি মার্কিনীদের। তাই স্টেট ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন কূটনীতিককে পদত্যাগ করতে বলা এবং শপথ গ্রহণের ৪৮ ঘণ্টা আগেই ফিলিস্তিনিদের যুদ্ধবিরতি এসব প্রমাণ করে, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে যেভাবে বলেছিলেন, সেগুলোই বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। বলাই যায়, আমেরিকার কাঠামো, রাজনীতি, পলিসি মেকিং ইত্যাদিতে বড় পরিবর্তন আসবে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতখানি গুরুত্ব পাবে বা ইমপেক্ট পড়বে কি না, সেটা বলা মুশকিল। তবে ট্রাম্পের নির্বাচনের আগে ও পরের দুটি টুইট আমরা দেখি, তাহলে সেটাকে সামনে রাখলে বাংলাদেশের মাইনরিটি ইস্যুকে তিনি বড়ভাবেই তুলেছেন, আরেকটা ভারতের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক করতে চাওয়া।’

আরও পড়ুন:  আমরা শুধু জিতব, জিতব এবং জিতব : ট্রাম্প

দায়িত্ব নিয়ে প্রথম দিনই ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় শ খানেক নির্বাহী আদেশে সই করতে পারেন বলে ইঙ্গিত মিলছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর কোনো প্রভাব পড়েতে পারে কি না—জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত সফিউল্লাহ বলেন, ‘ট্রাম্প অবৈধ অভিবাসীদের ওপর অনেক কড়াকড়ি আরোপ করবেন। তবে অভিবাসী খাতে কড়াকড়িতে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে বেশি প্রভাব পড়বে। যেহেতু বাংলাদেশেরও অনেকে সেখানে অবৈধভাবে বাস করেন, তাই কিছু বাংলাদেশির ক্ষেত্রে অবশ্যই সমস্যা হবে। কারণ, ট্রাম্পের যেহেতু প্রেসিডেন্ট হিসেবে এটা শেষ মেয়াদ, তাই তিনি চাইবেন অবৈধদের বের করে দিতে।’

এ বিষয়ে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, দেখুন মাঝে মাঝে প্রসাশন বদলের সঙ্গে সঙ্গে এমবাসির লোকজনও পরিবর্তন হয়ে যায়। লক্ষণীয় বিষয়, জো বাইডেন যাকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে ঠিক করেছিলেন, বাংলাদেশে তিনি কিন্তু আর আসছেন না। ট্রাম্প প্রশাসনই সিলেক্ট করবেন কে আসবে। তবে ইমপ্যাক্ট কী হবে, সেটা বলা মুশকিল। তবে হ্যাঁ, জো বাইডেনের সময় যেসব বিষয় গুরুত্ব পেয়েছিল, সেসব বিষয়ে গুরুত্ব ট্রাম্প নাও দিতে পারেন। কারণ, বড় আকারেই যেহেতু ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক করতে যাচ্ছে, সে হিসেবে বাংলাদেশের ওপর আমেরিকার গুরুত্বে ভাটাও পড়তে পারে। তবে এসব ঘটে কি না দেখতে হবে।

আরও পড়ুন:  মার্কিন নাগরিকত্ব হারাতে যাচ্ছেন লাখ লাখ ভারতীয়

ইনক্লুসিভ নির্বাচন হলে ট্রাম্প প্রশাসন আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ চাইবে কি না—জানতে চাইলে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘শুধু আমেরিকা নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নও ইনক্লুসিভ নির্বাচনের কথা বলছে। এ ছাড়া যদি এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বড় দল হিসেবে ধরি বিএনপিকে, তারাও কিন্তু ওইভাবে ইঙ্গিত দেয়নি যে কাউকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে না।’

এ বিষয়ে এম সফিউল্লাহ বলেন, আমেরিকার বেসিক নীতিতে তারা কোনো পার্টিকে ব্যান করার পক্ষে নয়। তারা চায় ডেমোক্রেটিক উপায়ে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলো চলুক এবং ফেয়ারভাবে ইলেকশন হোক। কোনো দল ক্ষমতায় এলো এটা তারা বিবেচনা করে না এবং কোনো দল নিষিদ্ধ হোক, সেটাও তারা চায় না। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া ইনক্লুসিভ অর্থাৎ সব দলের অংশগ্রহণ চায় তারা, কাউকে বাদ দিয়ে নয়।

আরও পড়ুন:  দুই সপ্তাহে এলো সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা

ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এবারের অভিষেকে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ইস্যুতে পরিবর্তন আসতে পারে কি না—জানতে চাইলে এম সফিউল্লাহ বলেন, ‘ট্রাম্পের মুসলিম ফোবিয়া আছে। তাই কিছুটা ভাবনার বিষয় রয়েছে। আর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন তাদের প্রায়োরিটি নয়। বরং এ খাতে সহায়তা আরও কমতে পারে। কারণ, ট্রাম্প অন্যদের অর্থ দেওয়ার চাইতে নিজের অর্থনীতিতে কন্ট্রিবিউটকে বেশি প্রাধান্য দেয়। ন্যাটোতেও অর্থ প্রদান করা বন্ধ করবে ট্রাম্প। বাংলাদেশের সঙ্গে জলবায়ু খাতে যেসব অংশীদারত্ব রয়েছে, তা কমতে পারে এবং অনেক এইডেই সহায়তার পরিমাণ কমাতে পারে। পাশাপাশি বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগিতার পরিমাণও কমতে পারে। কিন্তু এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে মনে হয় আমাদের ডেমোক্রেসি আর হিউম্যান রাইটস ঠিক থাকলে ট্রাম্প প্রসাশনের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ নয়, ভালোই হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *