ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে অভিষেক অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে। গত নভেম্বরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এক অবিস্মরণীয় জয় নিয়ে আজ হোয়াইট হাউজের বাসিন্দা হতে যাচ্ছেন তিনি। দ্বিতীয় মেয়াদকালে তার প্রশাসনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনয়ন করা হয়েছে। তার নীতিমালা, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত এবং বিশ্বমঞ্চে ভূমিকা কেবল যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের জন্য নয়, বরং সারা বিশ্বের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হতে যাচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের মন্ত্রিসভায়, হোয়াইট হাউজ ও সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা দায়িত্ব পালন করবেন, এখানে তাদের পরিচিতি তুলে ধরা হলো:
১. সুসি উইলিস: তার প্রশাসনের প্রথম কর্মী হিসেবে তিনি তার নির্বাচনি প্রচার শিবিরের সহ-ব্যবস্থাপক সুসান সামারল উইলিসকে (সুসি উইলিস) বেছে নেন। সুসি উইলিস হোয়াইট হাউজের প্রথম নারী চিফ অব স্টাফ। রাজনীতিতে কাজ শুরু করার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তিনি ১৯৮০ সালে রোনাল্ড রেগানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযানে ছিলেন। ২০১৫ সালের রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনয়নের সময় ট্রাম্পের সঙ্গে উইলিস দেখা করেন এবং ট্রাম্পের ফ্লোরিডা প্রচারে কো-চেয়ার হন। সেই সময় ফ্লোরিডাকে দোদুল্যমান রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
২. রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র: সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাতিজা রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র পেশায় পরিবেশবাদী আইনজীবী। তিনি প্রথমে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার দিকে মনোযোগে দেন, তবে নানা বিতর্কের মধ্যে ভোটের দৌড় থেকে ছিটকে পড়েন এবং ট্রাম্পকে সমর্থন করেন। নির্বাচনের আগে শেষ দুই মাসে তিনি ‘মেইক আমেরিকা হেলদি এগেইন’ নামে ট্রাম্পের একটি প্রচার উদ্যোগে নেতৃত্ব দেন। কেনেডি জুনিয়র রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) এবং খাদ্য ও ওষুধ সুরক্ষা প্রশাসনের (এফডিএ) মতো জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত সংস্থার সঙ্গে বড় ভূমিকা পালন করবেন।
৩. ইলন মাস্ক: বিশ্বের সবচেয়ে এ ধনী ব্যক্তি চলতি বছরের শুরুতে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পক্ষে তার সমর্থন ঘোষণা করেন। ভোটে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম আমেরিকা পিএসিকে তিনি ১১৯ মিলিয়নের বেশি ডলার অনুদান দেন। টেসলা ও স্পেসএক্সের প্রধান এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স’র মালিক মাস্ক ভোটের প্রচারের শেষ সময়ে দৈবচয়ন ভিত্তিতে দোদুল্যমান রাজ্যের ভোটারদের প্রতিদিন ১ মিলিয়ন ডলার দিয়েছেন। তিনি অবৈধ অভিবাসন এবং ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকারের মতো বিষয়ে সোচ্চার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রশাসনে ইলন মাস্ককে ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি’ বিভাগের সহ-প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এই বিভাগের মূল লক্ষ্য হলো সরকারি আমলাতন্ত্র হ্রাস, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো এবং বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গঠন করে তাদের আরো কার্যকর ও দক্ষ করে তোলা। মাস্কের প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং সরকারি কার্যক্রমে দক্ষতা আনার অভিজ্ঞতা তাকে এই পদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সহায়ক হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি সরকারি ব্যয় হ্রাস এবং সংস্থাগুলোর পুনর্গঠনে মনোযোগ দেবেন, যা ট্রাম্প প্রশাসনের ‘সেইভ আমেরিকা’ উদ্যোগের অংশ।
৪. মাইক পম্পেও: তিনি ট্রাম্প প্রশাসনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন। মাইক পম্পেও একজন প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা এবং সিআইএর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক মঞ্চে চীন এবং ইরানের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান গ্রহণ করে। তিনি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির একজন দৃঢ় সমর্থক। কানসাসের সাবেক এই কংগ্রেসম্যান ট্রাম্পের আগের আমলে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) পরিচালক এবং পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পররাষ্ট্রনীতিতে তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন ও ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক হিসেবে পরিচিত এই ব্যক্তি ইসরায়েলের তেলআবিব থেকে মার্কিন দূতাবাসকে জেরুজালেমে স্থানান্তরে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। তিনি ছিলেন আব্রাহাম চুক্তি বাস্তবায়নের মূল ক্রীড়নকদের অন্যতম যে চুক্তি ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে।
৫. স্টিভেন টি নুচিন: তিনি অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি একজন সফল বিনিয়োগ ব্যাংকার এবং হেজ ফান্ড ম্যানেজার ছিলেন। তিনি কর সংস্কার এবং অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নে ট্রাম্প প্রশাসনের মূল কারিগর ছিলেন। তার নেতৃত্বে মার্কিন অর্থনীতি কর্পোরেট কর হ্রাস এবং ব্যবসায়িক সম্প্রসারণের দিকে মনোযোগ দেয়।
৬. বেটসি ডেভোস: তিনি ট্রাম্প প্রশাসনে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কারের পক্ষপাতী এবং প্রাইভেট স্কুলের পক্ষে জোরালো প্রচারক। তিনি চার্টার স্কুল এবং স্কুল ভাউচারের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প পথ তৈরি করার চেষ্টা করেন।
৭. জেমস ম্যাটিস: তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি ছিলেন একজন অভিজ্ঞ সামরিক নেতা এবং মেরিন কর্পসের জেনারেল। তার সময়কালে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক খাতে শক্তিশালী বিনিয়োগ করে এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নতুন কৌশল গ্রহণ করে।
৮. উইলবার রস: তিনি ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এবং শিল্পোদ্যোক্তা। তিনি বাণিজ্য চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন এবং চীনের বিরুদ্ধে শুল্ক আরোপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
৯. জেফ সেশন্স: তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং প্রাক্তন সিনেটর। অভিবাসন নীতি কঠোর করা এবং মাদকসংক্রান্ত অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১০. নিকি হেইলি: তিনি জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত। তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারী, যিনি ট্রাম্প প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হন। জাতিসংঘে তার সময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের স্বার্থরক্ষায় সোচ্চার ছিলেন।
এশীয় বংশোদ্ভূত যারা—
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রশাসনে বেশ কয়েকজন এশীয় বংশোদ্ভূত কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন:
১১. শ্রীরাম কৃষ্ণান: ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান উদ্যোক্তা শ্রীরাম কৃষ্ণানকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি মাইক্রোসফট, টুইটার, ইয়াহু এবং ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন।
১২. কাশ প্যাটেল: কাশ্যপ ‘কাশ’ প্যাটেলকে ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)-এর পরিচালক পদে মনোনীত করেছেন ট্রাম্প। তিনি নিউইয়র্ক থেকে আইন ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে আন্তর্জাতিক আইনে সনদপ্রাপ্ত। কাশ প্যাটেল ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ ও অনুগত হিসেবে পরিচিত।
১৩. হারমিত কে ধিলোঁ: মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী হারমিত কে ধিলোঁকে মানবাধিকারসংক্রান্ত সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের পদে নিয়োগ দিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বহু বিখ্যাত মামলা পরিচালনা করেছেন।
১৪. উষা চিলুকুরি ভেন্স: উষা চিলুকুরি ভেন্সকে সেকেন্ড লেডি অব আমেরিকা হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভেন্সের স্ত্রী এবং অন্ধ্রপ্রদেশের বাসিন্দা। উষা ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত।
১৫. ডা. জয় ভট্টাচার্য: কলকাতায় জন্মগ্রহণকারী ডা. জয় ভট্টাচার্যকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (NIH)-এর পরিচালক পদে মনোনীত করা হয়েছে। তিনি সায়েন্টিফিক এবং হেলথকেয়ার লিডারশিপে ভারতীয়-আমেরিকানদের গুরুত্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছেন।
১৬. বিবেক রামস্বামী: বিবেক রামস্বামীকে ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সির সর্বোচ্চ পদে বসানো হচ্ছে। তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা এবং বিনিয়োগকারী হিসেবে পরিচিত।
১৭. তুলসি গ্যাবার্ড: সাবেক কংগ্রেসওম্যান এবং ২০২০ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল প্রার্থী তুলসি গ্যাবার্ডকে ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স (DNI)-এর পরিচালক করা হয়েছে। তিনি হাওয়াই থেকে নির্বাচিত প্রথম হিন্দু কংগ্রেসওম্যান।