একদিকে দাবানল, আরেকদিকে তুষারপাত; লণ্ডভণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের জনজীবন

ইতিহাসের ভয়াবহতমই শুধু নয় হলিউডে তৈরি কল্পনার ফানুসে ভরা দাবানলকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে হলিউড সংলগ্ন এলাকায় চলমান অগ্নিকান্ড। নিমেষেই আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করছে বসত-বাড়ি, ব্যবসা-অফিস-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাদ যায়নি ধর্মীয় উপাসনালয়ও। সবুজে আচ্ছাদিত বৃক্ষরাজিও জ্বালানিতে পরিণত হয়ে এক সময় মিশে গেছে সহায়-সম্পদের ছাইয়ে। 

শুক্রবার সকালের তথ্য অনুযায়ী লসএঞ্জেলেসের প্যালিসেডেস, ইটন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্যালিসেডেসর আগুনে  পুড়েছে বাড়ি-ঘরসহ ১৯ হাজার একরের সহায়-সম্পদ-বৃক্ষরাজি। দাবানলের মাত্র ১০% এর মত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। ইটনের আগুনে পুড়েছে ১৩ হাজার একর জমির বসত-বাড়ি-বৃক্ষরাজি। হার্স্টে পুড়েছে ৭৭১ একর ভূমির সহায়-সম্পদ। কেনেথ দাবানলের ৩৫% নেভানো সম্ভব হলেও বাতাসে আদ্রতা কম থাকায় ভয়াবহতা কমেনি।

llllllllllllllllll

দমকল বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রাথমিক তথ্যে শুক্রবার ভোরে জানান, ১০ জনের মৃত্যু এবং ১০ হাজারের অধিক বাড়ি-গাড়ি, স্থাপনা পুড়ে ছাই হয়েছে। প্রায় দু’লাখ অধিবাসীকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এর আগে এক লাখ ৮০ হাজার মানুষকে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে হয়েছে। একদিকে ভয়ংকর তান্ডব, অপরদিকে মানুষ শুন্য বাড়ি-ঘরে লুটপাট আর চুরির ঘটনায় পুলিশ ২০ দুর্বৃত্তকে আটক করেছে। দমকল কর্মীদেরকে সহায়তার জন্যে মুক্তি দেয়া হয়েছে ৮০০ কয়েদিকে।

বেসরকারি আবহাওয়া সংস্থা একিউওয়েদারের হিসাব অনুসারে, দাবানলে ১৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার থেকে ১৫ হাজার কোটি ডলারের মতো আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আশেপাশের ছয় স্টেটের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের ক্যালিফোর্নিয়ার লসঅ্যাঞ্জেলেসে দাবানল নিয়ন্ত্রণের কাজে পাঠানো হচ্ছে বলে ফেডারেল কর্মকর্তারা জানান। ভয়াবহ দাবানল মোকাবেলার অভিজ্ঞতা আছে কানাডার। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো দক্ষিণাঞ্চলীয় ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল মোকাবেলার সক্ষমতাসম্পন্ন উড়োজাহাজ পাঠিয়েছেন।  তিনি আরও বলেছেন, কানাডার ফায়ার সার্ভিসের ২৫০ জন কর্মীকে মোতায়েনের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন:  লস অ্যাঞ্জেলেসে দাবানল, লুটপাট ঠেকাতে কারফিউ জারি

এদিকে নব নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প লসঅ্যাঞ্জেলসের দাবানল নিয়ে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্র্যাটিক দলীয় গভর্নরের সাথে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন। ট্রাম্প পানি সঙ্কটের জন্য ক্যালিফোর্নিয়া প্রশাসনের প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

llllll
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, আলাদা ছয়টি দাবানলের মধ্যে অনেকগুলোই নিয়ন্ত্রণের পুরোপুরি বাইরে চলে গেছে। হারিকেন তীব্রতার বাতাস, শুষ্ক আবহাওয়া এবং পানির চাপ কম থাকায় আগুন নেভাতে হিমশিম খাচ্ছে দমকল কর্মীরা।

আগুনের তীব্রতা দেখে তা নিয়ন্ত্রণ করার বদলে সাধারণ মানুষকে সরিয়ে নেয়ার কাজ করছেন ফায়ার ফাইটাররা। এমন অবস্থায় শুক্রবার থেকে নতুন করে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর সান্তা আনার ওয়েস্ট হিল ও নর্থ অব কালাব্যাসা থেকে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই কেনেথ ফায়ার ৩৫ হাজার একর এলাকায় (ম্যানহাটানের দ্বিগুণ সাইজ) ছড়িয়ে পড়েছে। লসএঞ্জেলেসের দমকল বাহিনীর প্রধান ক্রিস্টিন এম ক্রাউলি বলেন, এমন দুর্যোগ মোকাবেলায় আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছি। কিন্তু গত মঙ্গলবার থেকে শুরু এই দুর্যোগ নিয়ে দমকল কর্মীরা নাস্তানাবুদ হয়েছেন। কেনেথ ফায়ার আপনা-আপনি শুরু হয়নি, কেউ লাগিয়েছে সন্দেহে ভেঞ্চুরা কাউন্টি শেরিফ এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে লসএঞ্জেলেস থেকে।

আরও পড়ুন:  এখনো জ্বলছে যুক্তরাষ্ট্র: সিএনএন এর প্রতিবেদন

লসএঞ্জেলেস কাউন্টির আগুনের লেলিহান শিখা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এমন অবস্থায় ঘর ছাড়া বাসিন্দারা ছুটে আসছেন অবশিষ্ট কিছু আছে কিনা কিংবা নতুন বসতি স্থাপনের সম্ভাবনা কতটা দূর ইত্যাদি অবলোকন করতে। কিন্তু সকলেই হতাশ। বাড়ি-গাড়ি এবং গৃহপালিত পশু-পাখির কিছুই অবশিষ্ট নেই। পোড়া মাটি। দীর্ঘশ্বাস সকলেরই। তবুও স্বান্তনা যে প্রাণটা রক্ষা পেয়েছে। গৃহহারা মানুষদের পুনর্বাসনে সবধরনের অর্থ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট গভর্নরও একই ঘোষণা দিয়ে সকলকে আশ্বস্ত করেছেন। ডেমোক্র্যাট মেয়র কারেন বাস বলেন, “আমরা লস অ্যাঞ্জেলেস দ্রুত এবং কার্যকরভাবে পুননির্মাণের দিকে মনোনিবেশ করছি।” প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ফেডারেল সরকার আগামী ১৮০ দিনের জন্য ধ্বংসাবশেষ অপসারণ, অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র এবং প্রাথমিক উদ্ধারকারীদের পারিশ্রমিকসহ পুনরুদ্ধার ব্যয়ের শতভাগ বহন করবে।

হোয়াইট হাউসে জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকের পর বৃহস্পতিবার অপারাহ্নে বাইডেন বলেন, “আমি গভর্নর ও স্থানীয় কর্মকর্তাদের বলেছি, দাবানল নিয়ন্ত্রণে যেখানে যা খরচ করা দরকার সবটাই যেন সরকারের বরাদ্দ থেকে করা হয়।”

আরও পড়ুন:  পবিত্র আশুরা ১৭ জুলাই, ১৪৪৬ হিজরি

lllllll

প্রকৃতির বৈরি আচরণে হতভম্ব আমেরিকানরা। কারণ, ক্যালিফোর্নিয়া আগুনে জ্বলার পাশাপাশি আশেপাশের ২৬ স্টেটে শুক্রবার ১০ জানুয়ারি শুরু হয়েছে তুষার ঝড়। জাতীয় আবহাওয়া দফতরের বুলেটিনে শুক্রবার ভোরে বলা হয়েছে যে, এসব স্টেটের কোথাও কোথাও ১৪ ইঞ্চি পর্যন্ত তুষারপাত হতে পারে। এজন্যে সতর্কতা জারি করা হয়েছে টেক্সাস, ওকলাহোমা, ক্যানসাস, লুইঝিয়ানা, আরকানসাস, মিসিসিপি, আলাবামা, জর্জিয়া, সাউথ ক্যারলিনা, নর্থ ক্যারলিনা, ভার্জিনিয়া, কেন্টাকি, ইন্ডিয়ানা, ইলিনয়, টেনেসী, মিজৌরি এবং মন্টানা স্টেটে। আরো রয়েছে ওহাইয়ো, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, মিশিগান, ওয়াশিংটন, নিউ মেক্সিকো, কলরাডো, ওরেগণ, পেনসিলভেনিয়া এবং ম্যারিল্যান্ড স্টেট। শৈত্য প্রবাহের এই সতর্কবার্তায় কয়েক কোটি আমেরিকান তিনদিনের ব্যবধানে আবারো গৃহবন্দির পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন।

একদিকে দাবানল আরেকদিকে তুষার ঝড়ের এই ভয়াবহতাকে জলবায়ু পরিবর্তনের নগ্ন প্রভাব বলে মনে করছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। তাই জলবায়ু পরিবর্তনে বিশেষজ্ঞগণের পরামর্শ অনুযায়ী কালক্ষেপণ করা উচিত নয় বলে সুধীজন বলাবলি করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *