শিবুকান্তি দাশ
কবি হেলাল হাফিজ আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি প্রায় ৭৭ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুটা খুবই করুণ ছিল। হোটেলের রুমেই তিনি শেষ বিদায় নিয়েছেন। তার বিদায় বেলায় কেউ পাশে ছিল না। কখন যে তিনি বাথরুমে পড়ে আহত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন কেউ জানে না। সংসার বিবাগি মানুষ। হলো না তার সংসার,হলো না পিতার আসন। ১৩ ডিসেম্বর শুক্রবার,২০২৪ তাঁর চিরবিদায়ের দিন। অথচ তিনিই আমাদের মুক্তির সংগ্রামের চেতনার মশাল জ্বালিয়েছেন। আহবান জানিয়েছিলেন কবিতার ছন্দে ছন্দে যুদ্ধে যাবার জন্য সাহসী তরুণ তরুনীকে। যে আহবান নেতার আহবানের উর্দ্ধে। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ। যার একটি কবিতার বই দেশ বিদেশের সাহিত্যমোদিদের তোলপাড় করেছে। তিনি নাড়া দিয়েছেন পরাধীন জনতাকে। প্রবল শক্তিশালি তার কবিতার চরণ। কি এক বিম্ময় তার কবিতার ফঁকা ফাঁকা লাইন গুলোয়। কিন্তু কবি কি করে জানতে পেরেছিলেন তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে ? কবিরা এক রকম মুনি- ঋষি ।
যাদের পরম পাওয়া হচ্ছে ঈশ্বরকে লাভ করা। কবির সাধনাও তো তাই। শীর্ষে পৌছে যাওয়া। পাঠকের মন জয় করার অভিলাষ না থাকলে কি কবি হয় কখনো কেউ। তখন কবি নিজেকে জেনে যায়। নিজেকে জানা হয়ে গেলে তো পরম প্রাপ্তি। তার আর কিছুর দরকার হয়। তিনি যা বলেন তাই হয়ে যায়। কবি হেলাল হাফিজ তাইতো নিজের মৃত্যুকে চিনতে পেরেছিলেন।
৩০ নভেম্বর,২০২৪ সাল। সেদিনও শুক্রবার ছিল। আমি সন্ধ্যায় রমনা পার্কে হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগ পেরিয়ে হোটেল শেরাটনের উল্টো দিকে সাকুরার পেছনের গলি ধরে একটু এগুলেই ‘হোটেল সুপার হোম’। তার সপ্তম তলায় কবি একটি রুমে ভাড়া থাকতেন বিগত বছর ৪-৫ বছর ধরে। তার আগে পুরো এক দশক ছিলেন তোপখানা রোডের আরেকটা হোটেলে। সে সময় পুরো দশক প্রায় দিন একসাথে প্রেস কøাবে নাস্তার টেবিলে কিংবা লাঞ্চের সময় দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। কতটা আড্ডা রাতের কতটা সময় ধরে কবির রুমে। কয়েকবার কবির জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়েছি রাত রারোটা এক মিনিটে ফুল আর মিষ্টি হাতে। তাতে তিনি তেমন খুশি বা অখুশি হতেন না। কিন্তু সেদিন যখন কবিকে দেখতে গেলাম প্রথমেই জানতে চাইলেন আমার পরিবারের কথা। তাদেরকে শুভেচ্ছা জানাতে বললেন আমাকে। কিন্তু আমি পরিবারের সাথে দেখা করে কবির শুভেচ্ছা পৌছানোর আগেই কবির প্রস্থান। এ কি মানা যায় ? আমাকে কতটা পছন্দ করতেন সে কথা নাইবা বললাম। জানতে চাইলাম, দাদু কি খাবেন বলুন।
তিনি খুব কষ্ট করে বললেন, শিবু আমি তো কিছুই খেতে পারি না। ডাইবেটিস এতটায় বেড়ে গেছে, ডাক্তার আপেল কমলা খাওয়াও বারণ করেছেন। আমি কিছু খেতে পারছি না । গলায় আটকে যায়। খুব নরম করে ভাত খায় বাঁচার জন্য। পানি ছাড়া কিছুই গিলতে পারি না। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি বোধহয় এই শীতে আর থাকছি না। আমার জন্য দোয়া করিও। শীতে আমার মতো বৃদ্ধরা তো অনেকে মরে যায়। আমারও চলে যেতে হবে’। কবির আবেগ অভিমানি কথা গুলো আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছিল। কিন্তু আমি সামলে নিয়ে বিদায় নিলাম। আবার পেছন ফিরে বললাম দাদু একটা ছবি তুলি ? তখন তিনি বেশ সরব হয়ে উঠলেন। আমার গা ঘেসে বসে ছবির পোচ দিলেন। পাশের রুমের এক ছাত্রকে অনুরোধ করার সাথে সাথে উনি এসে আমাদের ছবি তুলে দিলেন। মাত্র ১২ দিন গত হলো। শীত পুরোপুরি ঝাঁকিয়ে আসার আগেই কবি শীতকে তুচ্ছ করে নিজের পথেই পা বাড়ালেন।
২০১০ সালের কোন এক সময় কবির সাথে পরিচয়। তার কবিতার সাথে তো আরো আগেই আমার পরিচয়। প্রেস ক্লাবেই আমাদের যোগাযোগ হতো বেশি। ২০১৬ সালে কবির সাথে পরিচয় হতে এবং বাংলাদেশ ভ্রমনে কলকাতা থেকে আসেন ‘উতুল হাওয়া’ নামে একটি সাংস্কৃতিক দল। তাদের প্রকাশনা ও রয়েছে। তার প্রধান কর্তা কবি গবেষক উল্লাস চটোপাধ্যায়। সে বছর আমার ‘এক ব্যাগ বই’ শিরনামে ছয়টি বই প্রকাশ করে খ্যাতিমান প্রকাশনা সংস্থা ‘আদিগন্ত প্রকাশন’। ‘এক ব্যাগ বই’ উল্লাস দাকে উপহার দিলাম হেলাল হাফিজ ভাইয়ের উপস্থিতিতে। সে দলে আসছিলেন, সুরমিতা চক্রবর্তী দিদি সহ আরো অনেকে। সবাই আমার বই দেখে তো উল্লাসিত। পরের বছর ২০১৭ সালে আমি পেলাম ‘অগ্রণী ব্যাংক শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার’। ‘এক ব্যাগ বই’ এর একটি বই ছিল ‘আমি নাকি দুষ্টু ভীষণ’। কিশোর কবিতার বই। উল্লাস দাদা বললেন এই বইটি আমি কলকাতা থেকে প্রকাশ করব। হেলাল হাফিজ ভাই আমার হয়েই সম্মতি দিয়ে দিলেন। কারণ হেলাল হাফিজ ভাইয়ের ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইটির পুন প্রকাশ করবেন তিনি। দুটো বইয়ের প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করা হয় ঢাকার ‘পাঠক সমাবেশ’ লাইব্রেরী হলে। সেই উৎসবে জাতিস্বত্তার কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও খ্যাতিমান আরো অনেক গুনীজন উপস্থিত ছিলেন। বই দুটোর মোড়ক উম্মোচন করা হয় কলকাতা বইমেলা মঞ্চেও। সেই সময় আমি আর কবি আমন্ত্রিত ছিলাম ভীষণ ভাবে। কিন্তু কবি অসুস্থ বোধ করায় যেতে পারেননি। কবির নিদের্শে আমিই গিয়েছিলাম কলকাতা। সে সময় গরিয়ায় সুরমিতা চক্রবর্তী দিদির বাড়িতে পুরো সপ্তাহ কাটিয়ে এলাম। সে স্মুতি ভুলে যাওয়ার নয়। সবই হেলাল হাফিজ ভাইয়ের ঈশারায় হয়েছে।
কবি হেলাল হাফিজ ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তখন পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘কবি হেলাল হাফিজকে পুরস্কার প্রদান করে সম্মানিত হয়েছেন বাংলা একাডেমি’। পরে তিনি একুশে পদকও লাভ করেন। তিনি কখনো প্রচারে যেতে আগ্রহি হতেন না। যেখানে প্রচারনার ব্যাপার থাকতো কবি তা বিনয়ের সাথে এড়িয়ে যেতেন। কবিকে জীবনের বাঁকে বাঁকে কষ্টকেই বেচে নিতে হয়েছে। কষ্টই যেনো তার ভালোবাসা। কষ্টের জীবন তার শৈশব থেকেই। মা হারিয়ে অস্থির জীবনে পা রাখেন কবি। তিনি নানা মাধ্যমে বলেছেন, বাবাই ছিল আমার সব। তিনি মা, তিনি বাবা।
কবি বিয়ে করেননি ঠিকই কিন্তু যৌবনে তরুণীদের কাছে ছিলেন ক্রেজি। কেউ কেউ তাকে বাসায় দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যেতেন। তার একটু সহচার্যের জন্য অনেক তরুণী পাগল হয়ে থাকতেন। তিনি কাউকে মনোরঞ্জন থেকে দূরে টেলে দিতেন না। সেসব কথা তিনি অকপটে স্বীকার করে গেছেন নানা মাধ্যমে। মাত্র কয়েক বছর আগেও তিনি একটি দৈনিকে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, ‘৭২ বছরের জীবন পেলাম। সময়টা নেহাত কম নয়। দীর্ঘই বলা যায়। এই দীর্ঘ জীবনের পেছনে ফিরে তাকালে তিনটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। তিনটি ঘটনাই আমার জীবনকে ওলটপালট করে দিয়েছে। আমি সফল নাকি ব্যর্থ, হিসাব কষতে বসলেও ওই তিনটি ঘটনা অবধারিতভাবে সামনে চলে আসে। আজ আমার যতটুকু সফলতা, সেই তিনটি ঘটনা তার পেছনে দায়ী। আবার আমার যতটা ব্যর্থতা, তার পেছনেও আছে ওই তিন ঘটনা।
প্রথম ঘটনা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) থাকি। ওই দিন সন্ধ্যায় নিউমার্কেটের দিকে আড্ডা দিয়ে রাতে হলে ফিরেছি। ক্যান্টিন বন্ধ। খেতে গেলাম মেডিকেল গেটের কাছে পপুলার নামের একটা রেস্টুরেন্টে। খাওয়া শেষে মনে হলো, ফজলুল হক হলে বন্ধু হাবিবুল্লাহ থাকে, ওর সঙ্গে একটু দেখা করে আসি। গেলাম ফজলুল হক হলে। হাবিবুল্লাহর কক্ষে গিয়ে আমি আড্ডা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর, রাত তখন পৌনে ১০টা হবে, হঠাৎ গোলাগুলির বিকট আওয়াজ। আমরা হলের ছাদে উঠে দেখলাম, নীলক্ষেত, নিউমার্কেটের দিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।
২৭ মার্চ সকালে ইকবাল হলে গিয়ে দেখি, মাঠের মাঝখানে, এখানে-ওখানে শুধু লাশ আর লাশ। নিজের কক্ষে গিয়ে স্যুটকেস গুছিয়ে দ্রæত বেরিয়ে পড়লাম। এখান থেকে পালাতে হবে, না হলে বাঁচা সম্ভব নয়। হলের গেটে এসে দেখি নির্মলেন্দু গুণ দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, ‘আমি ভেবেছি তুমি মারা গেছো, তোমার লাশ নিতে এসেছি।’ বলেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আমিও সজোরে কাঁদতে লাগলাম। তারপর সেখান থেকে আমার বড় ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উঠলাম।
এই ঘটনা আমার হৃদয়ে ব্যাপকভাবে ছাপ ফেলল। আমার তখন কেবলই মনে হতো, ওই রাতে যদি আমি ফজলুল হক হলে না গিয়ে নিজের হলে ফিরতাম, তাহলে তো বাঁচতাম না। একটা বোনাস জীবন পেয়েছি এই উপলব্ধি আমার ভেতর বিরাট বৈরাগ্য এনে দিল। এক ধরনের সন্ন্যাস জীবনযাপন শুরু করলাম আমি।
এর পরের ঘটনা ’৭৩ সালের জুনের। ১৯ জুন আমার পিতার মৃত্যু হলো। তিন বছর বয়সে মা মারা যাওয়ার পর আব্বাই ছিলেন আমার সবকিছু। তাঁর মৃত্যু প্রবলভাবে ধাক্কা দিল আমাকে। মনে হলো, জগৎসংসার তুচ্ছ। সব অর্থহীন। আমার বৈরাগ্য আরও প্রগাঢ় হলো।
আব্বার মৃত্যুর মাসখানেক পরই ঘটল তৃতীয় ঘটনা। ঘটনা ঘটাল হেলেন, আমার প্রেমিকা। হেলেন হঠাৎ ডেকে বলল, ‘কবি, তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।’ আমরা গিয়ে বসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে। সে বলল, ‘আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। বাবা-মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।’
ছোটবেলা থেকে আমি খুব সহনশীল ছিলাম। প্রচÐ সহ্যশক্তি আমার। তাই ভেতরের ঝড় বুঝতে দিলাম না হেলেনকে। ওখান থেকে উঠে রিকশা নিয়ে সোজা হলে চলে গেলাম। ওটাই হেলেনের সঙ্গে আমার শেষ দেখা ও শেষ কথা।
এই তিনটি ঘটনা আমাকে চিরস্থায়ীভাবে সংসারবিমুখ করে ফেলল। আমার আর ঘর হলো না, সংসার হলো না, অর্থকড়ি হলো না, প্রতিষ্ঠা হলো না।
এখন জীবনের প্রায় শেষপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। এখন কেবলই আমার মনে হয়, জীবনের সময়গুলো বৃথাই অপচয় করেছি। কত সুন্দর সুন্দর কবিতার পঙ্ক্তি এসেছে মাথায়, আমি টেবিলে বসিনি, লিখিনি। জীবনটা অপচয়ই করেছি বলা যায়। এ জন্য আমি এখন ভীষণভাবে লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী। এই দীর্ঘ জীবনে যাঁরা আমাকে ভালোবেসেছেন, তাঁদের সবার প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ। আর যাঁরা আমাকে ভালোবাসেননি, তাঁদের প্রতি আরও বেশি কৃতজ্ঞতা। কারণ তাঁদের অবহেলা, অনাদর, প্রত্যাখ্যান আর ঘৃণাই আমাকে কবি বানিয়েছে।
১৯৪৮ সালের ৭-ই অক্টোবর নেত্রকোনা জেলার বড়তলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কবি হেলাল হাফিজ। তিনি নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল থেকে ১৯৬৫ সালে মেট্রিক এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন। ওই বছরেই কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র “দৈনিক প‚র্বদেশে” সাংবাদিকতায় যোগদান করেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন “দৈনিক প‚র্বদেশের” সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি “দৈনিক দেশ” পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে যোগদান করেন । সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে বহুল আলোচিত তাঁর বিখ্যাত কবিতার বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ প্রকাশিত হয়।কবি এ পর্যন্ত বেশ কিছু পুরুষ্কারে ভ‚ষিত হয়েছেন। বিশেষ করে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের জন্যে তিনি পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জ বৈশাখী মেলা উদযাপন কমিটির কবি সংবর্ধনা (১৯৮৫), যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), নেত্রকোনা সাহিত্য পরিষদের কবি খালেদদাদ চৌধুরী পুরস্কার ও সম্মাননা প্রভৃতি। “যে জলে আগুন জ্বলে”–এ কাব্যগ্রন্থে হেলেন নামে এক নারীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যিনি ছিলেন কবির প্রেমিকা। তার সাথে বিচ্ছেদের ২৬ বছর পর ২০১২ সালে আসে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’। তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’; এ কবিতার দুটি পঙক্তি ‘‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’’ বাংলাদেশের কবিতামোদী ও সাধারণ পাঠকের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়ে থাকে। অবশেষে, ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভ‚ষিত হন।
কেবল কবিতার পাঠকের নিরিখে নয়, যে ব্যক্তি অতটাও সাহিত্যের খোঁজখবর করেন না, এমন অনেকের হৃদয়েও দোলা দিয়েছে হেলাল হাফিজের পঙ্ক্তি। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থভুক্ত প্রতিটি কবিতার শেষে উল্লেখিত তারিখ অনুযায়ী কবিতাগুলো লেখা হয়েছে ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে।
লড়াইয়ে, সংগ্রামে, প্রেমে-বিরহে, দ্রোহে যাপিত জীবনের পরতে পরতে হেলাল হাফিজ স্পর্শ দিয়ে যান। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র মতো ‘অগ্ন্যুৎসব’ কবিতাও শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আগুন জ্বেলে দেয়। এ কবিতায় কবি বলেছেন, ‘ছিল তা এক অগ্ন্যুৎসব, সেদিন আমি/ সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে? জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে/ রক্তঋণে স্বদেশ হলো,/ তোমার দিকে চোখ ছিল না/ জন্মভ‚মি সেদিন তোমার সতীন ছিলো।’ কেবল মুক্তিযুদ্ধ কিংবা গণ-অভ্যুত্থানের মতো প্রেক্ষাপটে নয়, যেকোনো অন্যায়ে-শোষণে-অবিচারে হেলাল হাফিজের এ উচ্চারণ সবার হয়ে ওঠে।
‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থই হেলাল হাফিজকে দিয়েছে অসামান্য খ্যাতি। এরপর দীর্ঘদিন আর কোনো বই বের করেননি তিনি। ২০১২ সালে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার সঙ্গে কিছু কবিতা যুক্ত করে প্রকাশ করা হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’। সর্বশেষ ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় তৃতীয় কবিতার বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। এত কম কবিতা লিখে এত খ্যাতি পাওয়ার নজির বাংলাদেশের সাহিত্যে নেই।