এডভোকেট মোহাম্মদ এমলাক: সন্দ্বীপের এক আলোকিত নক্ষত্র

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান
সাগরকন্যা সন্দ্বীপ, বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এক অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এই দ্বীপ শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যেই নয়, ইতিহাসখ্যাত বীর ও গুণী মানুষের জন্মভূমি হিসেবেও খ্যাত। এই রত্নগর্ভা ভূমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও শব্দ সৈনিক কবি বেলাল মোহাম্মদের মতো বহু কৃতী সন্তানের জন্মস্থান। সন্দ্বীপের এই সমৃদ্ধ গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারক আরেক মহৎ ব্যক্তিত্ব হলেন বিজ্ঞ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ইমলাক।
আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রীপ্রাপ্ত হয়ে যার হাত ধরে আইনের প্রায়োগিক জগতে পদার্পন করেছিলাম তিনি হচ্ছেন সন্দ্বীপের অন্যতম প্রথিতযশা আইনজীবী আ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ইমলাক স্যার। আমার নিজের আইনজীবী হওয়ার পথচলা শুরু হয়েছিল তাঁরই ছায়ায়। ইমলাক স্যারের চেম্বারে বসে শুনেছি তাঁর বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতার মুগ্ধকর গল্প, যেখানে মিশে ছিল আমার নিজের পূর্বপুরুষদের গৌরবগাঁথা । সেই স্মৃতিগুলো আজও আমার হৃদয়জুড়ে অমলিন।
♦️জীবন: সাফল্যের মুকুটে আলোকিত এক অধ্যায়♦️
জীবন আর মৃত্যুর চিরায়ত নিয়মে মানুষ অমর হয় তার কর্মময় জীবন দিয়ে। অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ইমলাক সেই কর্মমুখর জীবনের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। কর্ম আর ত্যাগের মহিমায় তিনি পরিণত হয়েছেন সমাজের আদর্শে। তাঁর জীবনের গল্প প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মানুষের মনে বেঁচে থাকবে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার অক্ষয় স্মারক হয়ে।
সন্দ্বীপের মাটি যুগে যুগে গুণীজনদের জন্ম দিয়েছে। আইনের ক্ষেত্রে এই ভূমি তৈরি করেছে একাধিক তারকা, যেমন অ্যাডভোকেট একেএম শামসুল হুদা, অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হক, অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান, অ্যাডভোকেট মাজহারুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মো. হেফজুল কবির, এবং অ্যাডভোকেট এ এম আনোয়ারুল কবীর। এই দীর্ঘ তারকাসারির মাঝে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ইমলাক আজকের প্রজন্মের কাছে একজন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
♦️শৈশব থেকে যার আলোকিত জীবনের শুরু♦️
ইমলাক স্যারের পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া ন্যামস্তির ফয়েজ বক্স ডাক্তারের বাড়ি। পরবর্তীতে তাঁরা মুছাপুরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে ধোপারহাট সংলগ্ন মোল্লাপাড়ায় বসতি স্থাপন করেন। সেখানেই ১৯৫৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন এই মহান ব্যক্তিত্ব।
পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় তিনি দাদা মুন্সী মুকবুল আলীর কাছ থেকে শৈশবেই শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন। দারিদ্র্য আর নদীভাঙনের করুণ বাস্তবতার মধ্যেও ১৯৬৮ সালে বিজ্ঞান বিভাগে মেট্রিক পাস করেন। এরপর আইএ পাস করেন, যদিও পড়ালেখার খরচ চালাতে তাঁকে টিউশনি করতে হয়েছে।
পেশাগত জীবন শুরু হয় শিক্ষকতার মাধ্যমে। প্রথমে মগধরা হাই স্কুল ও সন্তোষপুর হাই স্কুলে, এরপর চট্টগ্রাম রেলওয়ে পলোগ্রাউন্ড হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পাশাপাশি তিনি এমএ এবং এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৮৭ সালের ৯ মার্চ চট্টগ্রাম বারে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। পরে ১৯৯১ সালের ২২ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগেও তালিকাভুক্ত হন।
♦️সমাজসেবার তাঁর নিরন্তর যাত্রা♦️
আইনের পেশাগত ব্যস্ততার মধ্যেও ইমলাক স্যার ছিলেন মানবসেবায় সদা নিয়োজিত। সমাজের অসংখ্য অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের মাধুর্য, বর্ণাঢ্য জীবন আর নিরলস সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড তাঁকে সত্যিকার অর্থে মহৎ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।
অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ইমলাক কেবল একজন আইনজীবী নন, তিনি সন্দ্বীপের ইতিহাসের এক জ্বলজ্বলে অধ্যায়। তাঁর কর্মমুখর জীবন, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর ত্যাগের অনন্য গুণাবলী তাঁকে অমর করে রেখেছে। সন্দ্বীপের আকাশে এই নক্ষত্রের আলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়বে, যেমনটি তিনি আজও আছেন আমাদের হৃদয়ে।
সহকারী অধ্যাপক (আইন)
সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রক্টর, ফেনী ইউনিভার্সিটি
শিক্ষা ছুটি-যুক্তরাজ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *