এস এম যাহিদুল আলম সুমন
নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি সন্দ্বীপ। বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব উপকূলে, বঙ্গোপসাগরের উত্তর পূর্ব কোণে, মেঘনা মোহনায় অবস্থিত প্রাচীন এই দ্বীপের অবস্থান। এখানে প্রায় চার লক্ষ মানুষের বসবাস। বঙ্গোপসাগরের ভয়ংকর জলরাশির সাথে মিশে আছে এখানকার মানুষের জীবন জীবিকার গল্প। হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ পাদপিঠ চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ।
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ব্যবসায় ও শিল্পকেন্দ্রীক অর্থনীতিতে সন্দ্বীপ একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল বলে বিবেচিত।পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভ্রমণকারীরা এই অঞ্চলে এসে তাদের জাহাজ নোঙ্গর করতেন ও সহজ বাণিজ্য ব্যবস্থা এবং পরিবহন সুবিধাদি থাকায় এই অঞ্চলে ব্যবসা ও বসতি স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। ১৭৭৬ সালের এক প্রতিবেদনে জানা যায় যে, প্রতি বছর সন্দ্বীপ উৎপাদিত প্রায় এক লক্ষ ত্রিশ হাজার মণ লবণ, তিনশ জাহাজে করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হত।
পৃথিবীর প্রাচীন এবং আধুনিক ইতিহাস থেকে আমরা জানি সন্দ্বীপের মানুষেরও প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ১৬০০ শতকের দিকে সন্দ্বীপ, লবণ, বস্ত্র শিল্প (তুলা/সুতা) এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পে এগিয়ে থাকলেও বেশিরভাগ মানুষের মূল পেশা ছিল কৃষিকাজ। পরবর্তীতে সন্দ্বীপের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ নাবিকের পেশা বেছে নেন এবং বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল। আশির দশকের দিকে সন্দ্বীপের মানুষ মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী হয় পরবর্তীতে আমেরিকা এবং ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। চারিদিকে সমুদ্র দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় সন্দ্বীপে এবং এখানকার মানুষের ব্যবসার প্রধান অন্তরায় ছিল যাতায়াত ব্যবস্থা। ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাই স্বাধীনতার পর পর্যন্ত সন্দ্বীপ থেকে শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠেনি। কিন্তু সন্দ্বীপের স্বাধীনচেতা মানুষ তাদের সাহস এবং মনোবলকে পুঁজি করে এসে সাগর পাড়ি দিয়ে মূল ভূখণ্ডে এসে শহরে (মূলতঃ ঢাকা ও চট্টগ্রাম) শিল্প কল-কারখানা গড়ে তোলে।
আমার লেখায় আমি শুধু বর্তমান সময়ে যেসব উদ্যোক্তা ঢাকা, চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠান গড়ার মাধ্যমে সন্দ্বীপের এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান ব্যবস্থা করেছেন এবং করে চলছেন তাদের নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করব। আমার তথ্যকেন্দ্রীক কোনো সীমাবদ্ধতা থাকলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটতে থাকে। সন্দ্বীপ থেকে মূল ভূখণ্ডের বাহিরে এসে ব্যবসা-বাণিজ্যে যারা পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম এম ওবায়দুল হক। ৬০ এর দশকে তার হাত ধরে শুরু হয় সিরামিক শিল্পের যাত্রা। পিপলস সিরামিক নামের একটি কারখানা গড়ে তোলেন তিনি। বর্তমানে তার বড় ছেলে সারোয়ার কারখানাটি পরিচালনা করেন। মরহুম ওবায়দুল হককে বলা চলে জাতীয় স্তরে সন্দ্বীপবাসীর শিল্পায়নের রূপকার।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সন্দ্বীপের আরেকজন সফল উদ্যোক্তা ছিলেন প্রয়াত নুরুল ইসলাম। চট্টগ্রামে তার প্রতিষ্ঠিত বাবু ওয়েল মিল অত্যন্ত সুনামের সাথে ব্যবসা পরিচালনা করছেন তিনি। তাছাড়াও তিনি ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের একজন উদ্যোক্তা ও পরিচালক ছিলেন এবং পরবর্তীকালে এর চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন।
ব্যাংক বীমা এবং পত্রিকা জগতে সন্দ্বীপের সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান এক অনন্য নাম। তিনি দৈনিক রূপালী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।এছাড়া সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকা সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি বিসিআই ব্যাংকের মাধ্যমে সন্দ্বীপ সহ সারাদেশের অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে তিনি রুপালি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। এখানেও দেশব্যাপী হাজারো তরুণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।
ব্যবসায় এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান নিয়ে আলোচনায় যেসব শাখার কথা আসে সেগুলো হলো রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প, চামড়া শিল্প, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিজ তথা এক্সেসরিজ শিল্প, জ্বালানি খাত, কৃষি খাত, ঔষধ শিল্প, সেবা খাত, হাসপাতাল, হোটেল, আইটি খাত, আবাসন খাত, ফার্নিচার শিল্প, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ইত্যাদি।নিম্নে খাত ভিত্তিক আলোচনা করা হলো:
* রপ্তানি মুখী পোশাক শিল্প :
১৯৭৭- ৭৮ সালের দিকে বাংলাদেশে রপ্তানি মুখী পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয় নুরুল কাদের এর দেশ গার্মেন্টস এর মাধ্যমে। এর মাধ্যেমেই শিল্পে সন্দ্বীপের মানুষের পদচারণা শুরু হয়। বাংলাক্রাফটের সভাপতি সেলিম উদ্দিন হায়দারের প্রতিষ্ঠিত রেডিয়েন্ট গার্মেন্টস এক্ষেত্রে একটি উত্তম উদাহরণ। সন্দ্বীপের নজরুল ইসলামও সমকালীন সময়ে গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করেন। উভয়ের গার্মেন্টস ব্যবসায় অনুপ্রাণিত হয়ে জার্মান থেকে ফিরেন স্বপ্নবাজ এবং অত্যন্ত মেধাবী দুজন তরুণ ফিরোজ আলম এবং রেজ্জাকুল হায়দার মঞ্জু। গার্মেন্টস ব্যবসায় নিজেদের স্বপ্ন দেখেন কিন্তু বাঁধ সাধে পুঁজি। কিন্তু মাথায় যাদের আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন তাদের রুখতে পারে কে? তারা আরো দুজন মেধাবী ব্যাক্তি আবুল কাশেম হায়দার এবং মস্তানছের বিল্লাহকে সঙ্গী করে ১৯৮৪ সালে ইয়ুথ ফ্যাশন লিমিটেড এবং ১৯৮৫ সালে”চৌধুরী অ্যাপেলস” নামে গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠা করে ব্যবসা শুরু করেন। শুরুর পর থেকে তাদেরকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তাদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইয়ুথ ফ্যাশন লিমিটেড, ইয়ুথ গার্মেন্টস, প্যানোরমা প্যাকেজিং ইউনিকম টেক্সটাইল মিলস লিঃ, কমফিট কম্পোজিট নিট লিঃ নামে শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ। ইয়ুথ গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ সন্দ্বীপ তথা সমগ্র বাংলাদেশের সুপরিচিত একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান। বলতে গেলে ইয়ুথ গ্রুপের মাধ্যমে সন্দ্বীপের ছেলেদের ব্যাংক বীমার বাইরে বিভিন্ন মুখী চাকরির সুযোগ তৈরি হয় এবং পরবর্তীতে কিছু উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী তৈরি হয়।
বর্তমানে এনবিআর এবং কাস্টমসে ব্যবহৃত গার্মেন্টসের সকল প্রকার এক্সেসরিজ পরিমাপের ফরমেটগুলো ইয়ুথ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্হাপনা পরিচালক মরহুম ফিরোজ আলম এর সুপারিশকৃত।
পারস্পরিক আস্থা এবং সততার মাধ্যমে ইয়ুথ গ্রুপ আজ বৃহৎ পরিসরে ছড়িয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রুপ নিয়েছে। ইয়ুথ গ্রুপের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে – ইয়ুথ স্পিনিং মিলস লিঃ, চৌধুরী এ্যাপারেল (প্রাঃ) লিঃ,ইয়ূথ প্রপাটিজ লিঃ, ইয়ূথ রিয়েল ষ্টেট লিঃ, ইয়ূথ হেচারী এন্ড এগ্রো লিঃ, ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিঃ,ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলসহ প্রভৃতি।
গার্মেন্টস সেক্টরে ইয়ুথ গ্রুপের পরে আসে নিউটেক্স গ্রুপের নাম। যার কর্ণধার ছিলেন আবুল কাশেম বাবুল এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আকরাম খান দুলাল। নিউটেক্স গ্রুপও বহু মানুষের কর্মসংস্থানের বিশাল প্লাটফর্ম। এছাড়া খায়রুল মোস্তফা, আবুল কাশেম এবং …….. প্রতিষ্ঠা করেন ইম্পেরিয়াল ফ্যাশন লিমিটেড নামে গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান।
আবুল কাশেম সাহেব পরবর্তীতে ইম্পেরিয়াল গার্মেন্টস হতে বের হয়ে গিয়ে ১৯৯৭ সালে শামসুল আলম ও দেলোয়ার হোসেনের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা করেন একেএইচ গ্রুপ। গ্রুপটি AKH Fashions Ltd, AKH Shirts Ltd, Angshuk Ltd, AKH Apparels Ltd, AKH Knitting & Dyeing Ltd, AKH Knitware Ltd, AKH Stitch Art Ltd, AKH Packaging & Accessories Ltd., AKH Trims Ltd., AKH Washing Ltd এর সহযোগে আজ বিশাল মহীরুহ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার নেতৃত্বে আছেন গ্রুপের ডিএমডি আবুল কাসেম।
১৯৯৩ সালে আব্দুল জলিল, মরহুম ফরিদ উদ্দিন মিলাদ এবং মহিউদ্দিন শাহজাহান মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ডিজাইন এন্ড ফ্যাশন লিমিটেড নামে একটি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে আব্দুল জলিল এক্সকম ফ্যাশন নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান করছেন যেখানে বহু সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান ঘটেছে। পরবর্তীতে আবু তাহের সাহেবের ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত লুসিড এ্যাপারেলস লিঃ, নাজমুল আহসান, আহসান, লতিফ সাহেবদের আইভি এ্যাপারেলস, নাজমুল হোসেন বাবুল, দিদারুল আলমদের স্যান্ডইয়র্ক নিটিং এবং স্যান্ডঢাক গার্মেন্টস নামের প্রতিষ্ঠান গুলোর উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে বহু বছর আগে।
সন্দ্বীপের আরেকটি সফল প্রতিষ্ঠান ছিলো আমিনুর রসুল সাহেবের প্যান্টম এ্যাপারেলস লিঃ। ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজার ট্রাজেডির ফলে স্বনামধন্য এ প্রতিষ্ঠানের কপালে নেমে আসে চরম পরিণতি। ইঞ্জিনিয়ার তামজিদুর রহমান এবং নাজিম উদ্দিন সাহেবের করুনা ফ্যাশন লিঃ সুনামের সাথে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে।
ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত সন্দ্বীপের আরো একটি প্রতিষ্ঠান হলো টিএনজেড গ্রুপ। মাইটভাঙ্গার শাহাদাত হোসেন শামীমের প্রতিষ্ঠিত এই গ্রুপে এ্যাপারেল প্লাস ইকো লিঃ, এ্যাপারেল আর্ট লিঃ, বেসিক ক্লোদিং লিঃ সহ একাধিক গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান এবং স্টাইলেক্স কর্পোরেশর নামে এটি বৃহৎ বায়িং হাউজ আছে যেখানে প্রচুর লোকজন কাজ করছে।
ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত সন্দ্বীপের আরো একটি প্রতিষ্ঠান হলো শাহনেওয়াজ হোসেন লাবলু এবং শওকত হোসেন সেবকের লিবাইস গার্মেন্টস। এছাড়া সন্দ্বীপের হরিশপুরের সালাউদ্দিন এবং সাতঘরিয়ার শামসুল মিলে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন ইন্টারকেয়ার গার্মেন্টস। তাদের মৃত্যুর পর গিয়াস উদ্দিন এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত সন্দ্বীপের আরো দুটি প্রতিষ্ঠান হলো Neox Garments Ltd. এবং Rainbow Attire Ltd। মাইট ভাঙ্গার আনোয়ার হোসেনের প্রতিষ্ঠিত এসব প্রতিষ্ঠানে অনেক লোকের কর্মসংস্থান ঘটেছে।
* ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ তথা এক্সেসরিজ শিল্প:
ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ তথা এক্সেসরিজ কারখানার মধ্যে নাসির উদ্দিন, হাসানুজ্জামান সোহাগ এবং মামুন সাহেবের ফেয়ার পলি এবং ফেয়ারটেক্স।এছাড়া কার্টুন ফ্যাক্টরির মধ্যে ইম্পেরিয়াল পলি এন্ড কার্টুন উল্লেখযোগ্য। হেলাল উদ্দিন এবং ফোরকান উদ্দিনের অ্যাপারেল এইড এবং কাজী মোশারফ হোসেনের টঙ্গীতে ওয়াশিং প্লান্ট রয়েছে।
এমব্রয়ডারি শিল্প:
সন্দ্বীপের মানুষের প্রথম প্রতিষ্ঠিত এমব্রয়ডারি কারখানার নাম এ্যাপারেল প্লাস লিমিটেড। এটি ইয়ুথ গ্রুপের ব্যবস্থাপনার পরিচালক ফিরোজ আলম এবং রেজ্জাকুল হায়দার মঞ্জুর সৎ পরিকল্পনায় প্রতিষ্ঠিত হয়। বৃটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানীর সাবেক পার্সোনাল ম্যানেজার মরহুম এবিএম জয়নুল আবেদীন এ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। বর্তমানে আমি এসএম যাহিদুল আলম সুমনের এ্যাপারেল প্লাস লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছি।
বর্তমানে এ্যাপারেল প্লাস এমব্রয়ডারী অত্যন্ত সুনামের সাথে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিকরে চলেছে।
এভিন্ন শাহনেওয়াজ হোসেন লাবলুর ট্যানসী, বেসিক এমব্রয়ডারি এবং ইম্পেরিয়াল এমব্রয়ডারি নামে সন্দ্বীপের আরো তিনটি প্রতিষ্ঠান সুনামের সহিত ব্যবসা পরিচালনা করছে।
ডায়িং শিল্প:
টেক্সটাইল জীবনের ডায়িং কারখানা একটি অপরিহার্য শিল্প।এই সত্যকে উপলব্ধি করে প্রকৌশলী আব্দুল মতিন প্রতিষ্ঠা করেন তেজগাঁতে অবস্থিত মডার্ন ডাইং এন্ড প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ। বর্তমানে তাঁর ছেলে ইমতিয়াজউদ্দিন জনি প্রতিষ্ঠানটিকে সফলভাবে পরিচালনা করে আসছেন। এটি কাপড়ের জগতে খুবই প্রসিদ্ধ নাম।তপনের কুংকিং ডায়িংও সন্দ্বীপের মানুষের আরেকটি অনন্য প্রচেষ্টা।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রপ্তানি মুখী পোশাক শিল্প, চামড়া শিল্প, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিজ তথা এক্সেসরিজ কারখানা পাওয়ার সেক্টর সমূহ মোটাদাগে আলোচনার বিষয়। এছাড়াও জ্বালানি খাত, কৃষি কাপ বা এগ্রো খাত, সেবা খাত,হোটেল আইটি খাত, আবাসন খাত, ফার্নিচার শিল্প এবং ক্ষুদ্র কুটির শিল্প এগুলোও আলোচনার দাবি রাখে।
জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ খাত:
বিগত দশকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত ছিল অত্যন্ত নাজুক। সে নাজুক বিদ্যুৎ খাতকে বর্তমানে স্বাবলম্বী বিদ্যুৎ খাত হিসেবে উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের যে কয়জন অবদান রেখেছেন তার মধ্যে আমাদের অত্যন্ত গর্বের সন্দ্বীপের ইয়াদ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম ফিরোজ আলম অন্যতম। শাহাজী বাজার মিডল্যান্ড পাওয়ার প্লান্ট এলপিজি এবং শাহাজি বাজার পাওয়ার প্লান্ট ফিলিপাইনারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ফিরোজ আলম বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর বড় ছেলে ফরিদুল আলম ইমন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এই সেক্টরের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। পাওয়ার সেক্টরে আরেকটি প্রতিষ্ঠান হল ইঞ্জিনিয়ার মনিরুল আলম এর আর্ক পাওয়ার লিমিটেড।
কনস্ট্রাকশন খাত :
যে কোন দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা। উন্নত যাতায়াতের সুবাদে প্রতিটি দেশ তাদের ভাগ্য বদলাতে পারে। বাংলাদেশের যাতায়াত ব্যবস্থায়ও সন্দ্বীপবাসীদের অবদান অনস্বীকার্য।
সন্দ্বীপের আইকনিক কৃতি সন্তান প্রকৌশলী শফিকুল আলম ভূঁইয়া (ফুলমিয়া) কনট্রাকশন খাতে একটি অনন্য নাম।তাঁর প্রতিষ্ঠিত মনিকো লিমিটেড এর তত্ত্বাবধানে সারা বাংলাদেশের প্রচুর রাস্তাঘাট ব্রিজ নির্মাণ হয়। তাঁর সাথে সন্দ্বীপের আরেক কৃতিসন্তান প্রকৌশলী মাহমুদুল হক জড়িত ছিলেন।
আবাসন খাত :
মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হলো বাসস্থান। পৃথিবীতে ক্রমবর্ধমান মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য উচ্চভবনের সৃষ্টি। আমাদের দেশেও তাই ফ্ল্যাট কনসেপ্টের শুরু হয়।আবাসন খাতের উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান গ্রেস প্রপার্টিজ লিমিটেড। এটির পরিচালনায় আছেন ডাকসুর সাবেক আপ্যায়ন সম্পাদক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আজিজুর রহমান এর ছেলে নুরুল আক্তার। মনিকো লিমিটেডও আবাসন খাতে বিশেষ অবদান রাখছে।
কৃষি খাত এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ :
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সন্দ্বীপের তেমন উল্লেখযোগ্য অবদান নেই।তবে আধুনিক কৃষি খাতে খাতে দুটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান হলো ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় অবস্থিত মনিকো এগ্রো ফার্ম এবং এবং মরহুম ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মতিন এর নরসিংদী হ্যাচারি।
ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প:
ঢাকার ইসলামবাগে হুমায়ূর কবিরের এইচকে ইলেকট্রনিকস নামক একটি কারখানা রয়েছে।
ফার্নিচার শিল্প :
শেওড়াপাড়ায় অবস্থিত মাইনুর রহমান এর এক্স ফার্নিচার শিল্প জগতের গর্ব বলে বিবেচিত।
মুদ্রণশিল্প:
সভ্যতার বিকাশে মুদ্রণ শিল্প এক বিশাল ভূমিকা রেখে চলেছে। মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার এ শিল্পকে ব্যাপকভাবে তরান্বিত করেছে। বর্তমানে আমাদের দেশেও এ শিল্পের বিকাশ লাভ করেছে। এ ক্ষেত্রে সন্দ্বীপের মানুষও পিছিয়ে নেই। মান্জুর মাওলার মাওলা প্রিন্টিং প্রেস সুনামের সাথে ব্যবসা পরিচালনা করছে।
আইটি খাত এবং ই-কমার্স :
আধুনিক বিশ্বের সমস্ত উন্নয়নের মূলে রয়েছে এই খাত।যেই জ্ঞান সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে সে জ্ঞান হচ্ছে কম্পিউটারের ব্যবহার। নতুন নতুন সফটওয়্যার আবিষ্কার একদিকে যেমন মানুষের জীবনকে সহজ করেছে তেমনি খুলে দিচ্ছে নতুন সম্ভবনার দ্বার। বাংলাদেশের আইটি খাত পূর্বে অন্যান্য দেশ থেকে পিছিয়ে থাকলেও বাংলাদেশের তরুণরা আমাদের দেখাচ্ছে আশার আলো।
এসকম মিটারের এমডি আব্দুল শরীফ জলিল এর গার্মেন্টস শিল্পের উপরে একটি সফটওয়্যার এবং কারখানা আছে। এছাড়া আমাদের তরুণ উদ্যোক্তাদের মধ্যে ই-কমার্সে কারিমুল মাওলা শামীমের নামও উল্লেখযোগ্য যিনি নগদ হাটের কমার্স প্রতিষ্ঠানের পরিচালক।
সেবা খাত হাসপাতাল :
মানুষ মানুষের জন্য এ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে যে মানুষের কল্যাণে কাজ করা যায় তার উদাহরণ হলো ঢাকার মহাখালীতে ইঞ্জিনিয়ার মরহুম আব্দুল মাতিন এর মেট্রোপলিটন হাসপাতাল, উত্তরায় ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, শাহিনুর রহমান সাহেবের ডেলটা হাসপাতাল এবং শামসুল কবির খান এর ইম্পিরিয়াল হাসপাতাল,চট্টগ্রামে ডাক্তার জসীম উদ্দীনের চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতাল প্রভৃতি। এছাড়াও ডা. মাহবুবের চকবাজারে একটি হাসপাতাল আছে।
হোটেল/মোটেল শিল্প:
বাংলাদেশের কক্সবাজার পর্যটন শিল্পে বিশ্বজোড়া খ্যাতি বিদ্যমান। এ শিল্পকে কেন্দ্র করে এখানে অনেক হোটেল/মোটেল গড়ে উঠেছে।মুকিমের রেইনভিউ রিসোর্ট,সোহেলের নীলিমা রিসোর্ট আমাদের সন্দ্বীপের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে। ঢাকার গুলশানে জনাব নুরুল মোস্তফা খোকন সাহেবের পাঁচতারা হোটেল দেশি বিদেশীদের পছন্দের একটি হোটেল।
চামড়া শিল্প :
চামডা শিল্প দিয়ে সন্দ্বীপবাসীদের প্রথম কারখানা শুরু হলেও বর্তমানে এই শিল্পে তেমন পদচারণা নেই।যথাযথ তথ্যের অভাবে ঢাকার হাজারীবাগের চামড়া ব্যবসায়ীদের নিয়ে আলোচনা সম্ভব হয়নি।তবে সাভারের হরিণ ধরা ট্যানারী এলাকায় আবুল কাশেম রানার একটি চামড়া প্রক্রিয়াকরণ কারখানা চালু আছে।
বাংলাদেশের জিডিপিতে বড় অবদান রাখছে কৃষিখাত। তা সত্ত্বেও বর্তমান শিল্প খাত দ্রুত এগিয়ে আসছে। সে শিল্প খাতকে বেগবান করতে সন্দ্বীপের মানুষ ধীরে ধীরে বিভিন্ন সেক্টরে এগিয়ে এসেছে।
শিক্ষা দীক্ষার প্রসারের ফলে সন্দ্বীপের মানুষের প্রবাসী হওয়ার প্রবণতা কিছুটা হলেও হ্রাস পাচ্ছে, তারা এখন শিল্পকারখানা স্থাপনে উদ্যোগী হচ্ছে। আধুনিক কর্মমুখী শিক্ষা ও কারিগরী জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে শিল্প কারখানা স্থাপনে মনোনিবেশ করছে। দেশের তরুণদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার মাধ্যমে এ সমৃদ্ধির হাওয়া অচিরেই ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বময়।
লেখক পরিচিতি- ব্যবসায়ী, সংগঠক ও সমাজকর্মী।