খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরার ৮ উপজেলায় ১৫ লাখ মানুষ পানিবন্দী

খুলনা, যশোর, ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের জলাবদ্ধতার সমস্যা এক দীর্ঘমেয়াদি সংকট। একসময় কৃষকরা উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করে সাফল্যের সাথে ফসল উৎপাদন করতেন। কিন্তু ১৯৬০-এর দশকে নেদারল্যান্ড সরকারের সহায়তায় নির্মিত ওয়াপদার ভেড়িবাঁধের ফলে নদীর পলি জমিতে পড়ার সুযোগ কমে যায়, যা কৃষি জমির উর্বরতা হ্রাসে ভূমিকা রাখে।

ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে উজানের পানির প্রবাহ কমে গিয়ে নদীগুলোর জীবনীশক্তি ক্ষীণ হয়েছে। লবণ পানি ও পলি মাটির অনুপ্রবেশ নদীগুলোর মৃত্যু ঘটাচ্ছে, এবং এর ফলশ্রুতিতে ৮০-এর দশকে বিল ডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতা শুরু হয়, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।

সমস্যার সমাধানের জন্য কার্যকরী ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন, যাতে স্থানীয় কৃষকদের জীবিকা রক্ষিত হয় এবং পরিবেশের ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করা যায়।

 

বিল ডাকাতিয়া ও ভবদহ কেন্দ্রিক জলাবদ্ধতা সমস্যা খুলনা ও যশোরের বিভিন্ন এলাকায় গভীরভাবে প্রভাব ফেলছে। প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে জোয়ার-আঁধার (টিআরআম) ব্যবহার করে পলি অপসারণের দাবি উঠলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকৃতির সাথে বিরোধী প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।

১৯৯০-এর দশকে কেজিডিআরপি প্রকল্পের মাধ্যমে ২২২ কোটি টাকার উদ্যোগ নেওয়া হলেও এটি স্থায়ী সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রকল্পের কার্যক্রমের জন্য স্থানীয় পানি ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হলেও তাদের কার্যক্রম এখন কার্যত নেই। এই অভাব এবং রক্ষণাবেক্ষণের অবহেলার ফলে বিল ডাকাতিয়া আবারও আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে, যার ফলে নতুন করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে খুলনা, যশোর, ও সাতক্ষীরা জেলায়।

আরও পড়ুন:  অ্যালোভেরা হার্টের কর্মক্ষমতা বাড়ায়

এই পরিস্থিতির উত্তরণে কার্যকরী পদক্ষেপ ও স্থানীয় জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সঠিক দিকনির্দেশনা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যায়।

অভিযোগ রয়েছে, বিগত ১৫ বছরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেওয়া নদী খনন আর ভেড়িবাঁধ নির্মাণে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। সঠিক ভাবে কাজ হলে এ দুর্দশা হতো না।

ডুমুরিয়ার একটি নদী খননের কাজ করেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি শাহিন চাকলাদার। নামে মাত্র খনন করে সমুদয় বিল উঠিয়ে নেন। ওই সময় কোনো গণমাধ্যম কর্মী খনন কাজ এলাকায় যেতে পারেননি। এমনকি নদী খননের মাটি লুট করে নিয়ে যান, যশোর-৫ আসনের সাবেক এমপি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের কথিত এক ভাগ্নে। এভাবে অধিকাংশ প্রকল্পের আড়ালে হয়েছে সীমাহীন লুটপাট।

ডুমুরিয়া এলাকার পানি কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ এ বি এম শফিকুল ইসলাম বলেন, নদীতে পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে।

প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খায়িয়ে প্রকল্প গ্রহণ না করলে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে না। উদাহারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিল ডাকাতিয়ার প্রকল্প আজ ভেস্তে গেছে।

আরও পড়ুন:  দেশের ৫ বিভাগে বজ্রসহ বৃষ্টির আভাস

তিনি বলেন, উজান থেকে পানি আসছে না। আর নদীগুলো ভরাট হয়ে গেছে। পানির উচ্চতা বাড়ছে। তাই এখন প্রয়োজন টিআরএম’র (জোয়ার-আঁধার) পদ্ধতির মাধ্যমে প্রকল্প গ্রহণ করা। এতে নদীর নাব্যতা বাড়বে এবং পানি নিষ্কাশন সহজ হবে। খনন কাজ করে শুধু অর্থ নষ্ট হবে। কেন না, খননের পর আবার জোয়ারে আসা পলি মাটি ভরে যাবে। এভাবে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়া করা সম্ভব নয়। আবার প্রকল্প ব্যয়বহুল হবে, স্থায়ী হবে না। তিনি মনে করে, বর্তমান পরিবেশ বান্ধব সরকার স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প গ্রহণ করে দক্ষিণের এই তিন জেলার মানুষকে স্থায়ী জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে পারে।

ডুমুরিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আল আমিন বলেন, আসলে ডুমুরিয়াসহ এ অঞ্চলে কেন এই জলাবদ্ধতা হচ্ছে, তার একটি বিস্তারিত গবেষণার দরকার। আগে পিছে কি হয়েছে, তার আলোকে আগামীতে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প গ্রহণ করা হলে এ সমস্যা দূর করা সম্ভব।

খুলনা অঞ্চলের পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা অতীতের প্রকল্পগুলো প্রকৃতি বিরুদ্ধে ছিল এটি মানতে নারাজ। তিনি বলেন, তখনকার সময়ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। সেটি তখনকার বিবেচনায় ঠিক ছিল। বিল ডাকাতিয়ার কেজিডিআরপি প্রকল্প প্রসঙ্গে তিনি জানান, ওই প্রকল্পের কিছু রিকমেন্ডশন ছিল। সেটি যথা সময় বাস্তবায়ন হয়নি। গঠিত পানি কমিটি কার্যত নিষ্ক্রীয়। তিনিও স্বীকার করেন, টিআরএম পদ্ধতি ভালো, তবে এ ক্ষেত্রে স্থানীয় জনসাধারণ ও জমির মালিকদের সহযোগিতা প্রয়োজন। বর্তমান জলাবদ্ধতা নিরসন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে গত সপ্তাহে একটি বৈঠক হয়েছে। বর্তমান পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান চলতি অক্টোবর মাসে খুলনায় আসতে পারেন। তিনি বিষয়টি অবগত আছেন এবং গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। বিদ্যুৎ কুমার সাহা আরও বলেন, আমরা চেষ্টা করছি জাতীয় ও স্থানীয় স্টেক হোল্ডারদের মতামতের ভিত্তিতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণের। তিনি আরও বলেন, নদীতে পলি জমে ভরাট হওয়ার অন্যতম কারণ ফারাক্কার বাঁধের কারণে উজানের পানির চাপ কমে যাওয়া। তাই প্রাকৃতিক পদ্ধতি, লোকায়ত জ্ঞান আর আধুনিক টেকনোলজির সমন্বয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সেটি টেকসই হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *