দুদকের নজরে শেখ হাসিনা সরকারের অনৈতিক সুবিধাভোগী

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযোগে তিন শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। বিশেষ করে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের প্রেক্ষাপটে, দুদক মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ী, সচিব, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে।

দুদক ইতোমধ্যে এক ডজন শক্তিশালী অনুসন্ধান টিম গঠন করেছে এবং গোয়েন্দা ইউনিটের কার্যক্রম বাড়িয়েছে। অভিযোগ গ্রহণের পাশাপাশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্নীতি-সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলোও যাচাই-বাছাই করে কমিশন অনুসন্ধানের অনুমোদন দিচ্ছে। এই ধারাবাহিকতায়, গত দুই সপ্তাহে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্ধশত সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে এবং প্রায় দেড় ডজন ব্যক্তির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, যাদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা এবং পুলিশ কর্মকর্তারা রয়েছেন।

দুদকের এই পদক্ষেপগুলি সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য এবং দেশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে হচ্ছে। দুদক সূত্রে জানা যায়, টানা তিন মেয়াদে বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ব্যাংক, বীমা, শেয়ারবাজার, অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, তৎকালীন সরকারের মেগা প্রকল্পসহ অন্যান্য প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট, দুর্নীতি ও পাচারের ঘটনা ঘটেছে। এতদিন সরকারের প্রভাবশালীদের কারণে কমিশন থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর দুদকও এখন নড়েচড়ে বসেছে।

হাসিনা সরকারের সব অনৈতিক সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিশন থেকে বেশকিছু পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, আর কোনো দুর্নীতিবাজকে ছাড় দেওয়া হবে না, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও জনগণের সাপোর্ট থাকায় দুদক থেকেও জোরালো প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সরকারের অন্য যেসব দপ্তরে অনুসন্ধান-তদন্তের কাজ করা হয়ে থাকে, সেসব দপ্তরের কর্মকর্তাদের দুদকে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া যায় কিনা, এ বিষয়েও চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন:  জলদস্যুদের কাছে জিম্মি ২৩ বাংলাদেশির পরিচয় মিলেছে

এদিকে দুদক কেবল জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অনুসন্ধানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না বলে জানা গেছে। দেশের যেসব ব্যাংক থেকে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা প্রভাব খাটিয়ে নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঋণ নিয়েছে, পরবর্তীতে ওইসব ঋণ পরিশোধ করা হয়নি বলে অভিযোগ ওঠেছে; এসব কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুদকের অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়ে পৃথক টিম করে অনুসন্ধান করা হবে।

৪৭ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু : গত ১৫ বছরের বিভিন্ন ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ গ্রহণ, নিয়োগ ও বদলি-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, কমিশন-বাণিজ্য, দখল, অর্থপাচার, সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন, এমন ৪৭ জন সাবেক মন্ত্রী-এমপি, সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত ১৫ আগস্ট সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়। তার ও কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ঘুষ-দুর্নীতির বস্তা বস্তা টাকা নেওয়ার অভিযোগ ওঠেছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে এক একটি বদলিতে ২ থেকে ৫ কোটি টাকা নেওয়া হতো বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগও পেয়েছে দুদক।

আরও পড়ুন:  গুগল পে বাংলাদেশে আসছে, এটির কাজ কী?

এদিকে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধানের আওতায় আসা অন্যদের মধ্যে রয়েছেন- আওয়ামী লীগ সরকার আমলের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী (জাভেদ), নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রহমান, রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম ও শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।

এ তালিকায় আরও রয়েছেন সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ।

আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন-

নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভু, নিজাম উদ্দিন হাজারী, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, বেনজীর আহমেদ, ড. জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী, অসীম কুমার উকিল, অপু উকিল, শাহে আলম তালুকদার, ডা. মনসুর আহমেদ, আবুল কালাম আজাদ, সোলায়মান হক জোয়াদ্দার (ছেলুন), ইকবালুর রহিম, মো. সাইফুজ্জামান শেখর ও তানভীর ইমাম। তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামাল, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবিপ্রধান) হারুন অর রশীদ, বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দ্বিতীয় সচিব আরজিনা খাতুনের বিরুদ্ধেও চলছে অনুসন্ধান।

আরও পড়ুন:  বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে টাস্কফোর্স গঠন

বিগত সরকারের মন্ত্রী-এমপি-কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অনুসন্ধানে কমিশনের তৎপরতার বিষয়ে জানতে চাইলে সম্প্রতি দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, দুদকের পদ্ধতিগত একটা প্রক্রিয়া রয়েছে। সেভাবেই কার্যক্রম চলছে। আমাদের একটা গোয়েন্দা উইং রয়েছে, সেখানে এগুলোর কার্যক্রম চলছিল। এটা চলমান ছিল, তাদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

১৬ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা : অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন, এমন প্রভাবশালী ১৬ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তারা হলেন- আওয়ামী লীগ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ও আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। এ ছাড়া সাবেক এমপিদের মধ্যে রয়েছেন ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিম, মামুনুর রশিদ কিরণ, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, কাজিম উদ্দিন, নুর-ই-আলম চৌধুরী ও জিয়াউর রহমান। এ ছাড়া ঢাকা ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান ও পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদের বিদেশযাত্রাতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

 

…….ডিডিজে নিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *