দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার কেনাবেচায় নজিরবিহীন অনিয়ম হয়েছে। চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশকে বিশেষ সুবিধা দিতে তাদের কাছে কম দামে ডলার বিক্রি করে সেই ডলারই অনেক বেশি দামে কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দুটি ক্রয় ও দুটি বিক্রয় ডিলের মাধ্যমে এই লেনদেন করা হয়। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো- লেনদেনগুলো একই দিনে ভিন্ন ভিন্ন বিনিময় হারে সম্পাদন করা হয়েছে। ব্যাংকটির কাছে ১১০ টাকা দরে ৮২ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করে ওইদিনই ১১৬ টাকা ৪৬ পয়সা দরে ৮৫ মিলিয়ন ডলার ক্রয় করা হয়। বৈদেশিক বিনিময় হার নির্ধারণের নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালুর পরদিন এ ঘটনা ঘটে। এতে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অভিভাবক বাংলাদেশ ব্যাংকের লোকসান হয়েছে প্রায় ৫৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্ববেক্ষণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রিজার্ভ থেকে কোনো ব্যাংকের কাছে ডলার কেনাবেচা করে এত বেশি লোকসান দেওয়ার ঘটনা আগে কখনো হয়নি। এখন ঘটনাটিকে স্বাভাবিক লেনদেন বলে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ৯ মে ১১৬ টাকা ৪৬ পয়সা দরে পৃথক দুটি লেনদেনের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক থেকে ৮৫ মিলিয়ন ডলার কেনা হয়। এর মধ্যে একটি লেনদেন ৪৫ মিলিয়ন ডলার এবং অপরটি ৪০ মিলিয়ন ডলার। এসব ডলার ক্রয়ের আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৯৯০ কোটি টাকা। অন্যদিকে একই দিনে ১১০ টাকা দরে ইসলামী ব্যাংকের কাছে দুটি লেনদেনে ৮২ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে একটি ৫০ মিলিয়ন ডলার ও অপরটি ৩২ মিলিয়ন ডলার। এসব ডলার বিক্রির আর্থিক মূল্য ছিল ৯০২ কোটি টাকা।
বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে আইএমএফের পরামর্শে গত ৮ মে ডলারের বিনিময়হার নির্ধারণে নতুন পদ্ধতি ক্রলিং পেগ চালু করা হয়। এ পদ্ধতির আওতায় ডলারের দাম একলাফে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করা হয়, যা ৯ মে থেকে কার্যকর করা হয়। এই দর থেকে ১ টাকা বেশিতে ডলার বিক্রি ও ১ টাকা কমে ডলার কেনাবেচার সুযোগ দেওয়া হয়। ওই পদ্ধতি কার্যকরের দিন ডলারের দাম একলাফে ৭ টাকা বাড়বে জেনে নিজেদের মধ্যে আঁতাত করে ইসলামী ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ থেকে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি কার্যকরের আগের দিনের রেটে
ডলার বিক্রি এবং ক্রলিং পেগ কার্যকরের দিনের রেটে সেই ডলার ক্রয় করার সমঝোতায় পৌঁছানো হয়। সে অনুযায়ী ব্যাংকটির কাছে ৮২ মিলিয়ন ডলার বিক্রির ডিলটি আগের দিনের ডেটে দেখানো হয়। কারণ ওইদিন ডলারের বিনিময় হার ছিল ১১০ টাকা। শুধু তা-ই নয়, ব্যাংকটি থেকে এই ডিলটির কনফার্মেশন পরের দিন সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে বাংলাদেশ ব্যাংকে মেইলে পাঠানো হয়। আর ইসলামী ব্যাংক থেকে ৮৫ মিলিয়ন ডলার ক্রয়ের ডিলটি লেনদেন সম্পাদনের দিনই হয়েছে। ওইদিন ডলারের মধ্যবর্তী বিনিময় হার ছিল ১১৭ টাকা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আশা করি না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে প্রায় ৫৪ কোটি টাকা লোকসান দিল, এটা কার স্বার্থে দিয়েছে? বাংলাদেশ ব্যাংক কেন লোকসান দিয়ে ডলার বিক্রি করবে? তাদের সুবিধা দেওয়ার জন্য কেন বাড়তি দরে কিনে কম দরে বিক্রি করবে? কোন পরিস্থিতিতে কিনছে, তা আরও তদন্ত করে বের করা উচিত। এসবের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি গভর্নর নূরন নাহারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এমন কিছু ঘটেছে কিনা তা আমার মনে নেই। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হককে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমাকে জানতে হবে। আপনি লিখিত প্রশ্ন পাঠান। লিখিত প্রশ্ন পাঠানোর পর তিনি আর রেসপন্স করেননি।
প্রচলিত নিয়মানুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ ও ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধীনে পরিচালিত ডিলিং রুম থেকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করা হয়। এ ধরনের লেনদেনের ক্ষেত্রে ওই বিভাগের দুটি শাখা কাজ করে। এর মধ্যে ফ্রন্ট অফিস ডলার কেনাবেচার ডিল সম্পাদন করে লেনদেনের বার্তা তৈরি করে। আর মিডল অফিস সেই বার্তাটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের অধীনে পরিচালিত ব্যাক অফিসে পাঠায়। ওই বার্তার আলোকে লেনদেন ঠিকমতো হয়েছে কিনা এবং লেনদেনের পর অ্যাকাউন্টে কী পরিমাণ অর্থ থাকল তা তদারকি করে ব্যাক অফিস। আলোচ্য লেনদেন দুটি সম্পাদনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের ব্যাক অফিসে পাঠালে তাদের নজরে এই অসঙ্গতি ধরা পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কোনো ডিল সম্পাদনের পর তা ভ্যালুডেটের মধ্যে ব্যাক অফিসে পাঠানো আন্তর্জাতিক রীতি। আর ডিল যেদিন করা হয় সেদিনই ব্যাক অফিসে পাঠাতে পারলে উত্তম; কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে আলোচ্য চারটি লেনদেনের মধ্যে দুটি লেনদেনের ডিল ভ্যালু ডেটের মধ্যে ব্যাক অফিসে পাঠানো হয়নি।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে পাওয়া ডিলের কনফার্মেশন গত ৯ মে ফ্রন্ট অফিস কর্তৃক ইনওয়ার্ড রেজিস্টারে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচার এই ডিলটি সংঘটিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাক অফিস যে ডিল কনফার্মেশন পায় তা-ও ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে ই-মেইলের মাধ্যমে ওইদিন বিকাল ৬টা ১৩ মিনিটে পাওয়া গেছে। এসব তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ডলার বিক্রির ডিল ডেট ৮ মে হলেও মূলত ডিলটি ৯ মে সম্পন্ন করা হয়েছে। অর্থাৎ ডিল ডেট আগের দিন দেখালেও মূলত অধিক মূল্যে ডলার ক্রয় করে তার পর কম মূল্যে বিক্রয় করা হয়েছে। একই ভ্যালু ডেটের ক্রয়-বিক্রয় ডিল ভিন্ন ভিন্ন বিনিময় হার ব্যবহার করার ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষতির পরিমাণ ৫৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এতে আরও বলা হয়, ৮ মে তরিখের ডিল ডেটে সম্পাদনকৃত ২টি বিক্রয় ডিল ৯ তারিখ সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে প্রেরণ করার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে ফ্রন্ট অফিস শাখা থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ডিলের বিপরীতে (ডিলের ফরোয়ার্ডিং) সহকারী পরিচালক এবং চিফ ডিলার ব্যতীত ডিভিশন ১-এর সংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত পরিচালক ও পরিচালকের কোনো স্বাক্ষর ছিল না।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, রিজার্ভ ম্যানেজমেন্ট অপারেশন ম্যানুয়ালের নির্দেশনা মোতাবেক ফ্রন্ট অফিস কর্তৃক ফরম্যাট অনুযায়ী ডিল কনভার্সেশনসহ ডিলস্লিপ প্রস্তুত করে তা চেক করার পর মিড অফিস শাখায় পাঠানোর বিধান রয়েছে। এ ছাড়া প্রদত্ত ফরম্যাট অনুযায়ী হেড অব ট্রেজারি (ডিভিশন ১-এর পরিচালক) বরাবর উপস্থাপিত প্রতিদিন সম্পাদনকৃত ডিলের বিবরণী সংবলিত অনুলিপি মিড অফিস এবং ব্যাক অফিস শাখায় পাঠানোর বিধান রয়েছে; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এই নিয়মে তা পাঠানো হয় না। সর্বশেষ গত ১ এপ্রিল থেকে হেড অব ট্রেজারি বরাবর উপস্থাপিত ডিলের বিবরণী সংবলিত অনুলিপি এ শাখায় পাঠানো হয়নি। ফলে বিবরণী তৈরি করে তা মিড অফিস ও ব্যাক অফিসে পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে এবং একই সঙ্গে ‘রিজার্ভ ম্যানেজমেন্ট অপারেশন ম্যানুয়াল’-এর ব্যত্যয় ঘটছে।