অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, দেশে চলমান সহিংসতা ও কারফিউর কারণে গত এক সপ্তাহের বেশি কিছু সময়ে সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। তারা মনে করেন, অর্থনীতির ক্ষতির পাশাপাশি সরকারের রাজনৈতিক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, বায়ার ও বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এজন্য সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে রাজনৈতিকদল ও ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনায় বসে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
প্রসঙ্গত, গত ১৪ জুলাই থেকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সারা দেশে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় বহু হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি বিজিবি নামানো হয়।
একপর্যায়ে সরকার গত শুক্রবার রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে। একই দিনে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়। এখনো বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। প্রথম দিন দুই ঘণ্টা বিরতি দিয়ে কারফিউ চলে।
পরদিন তিন ঘণ্টা বিরতি দেওয়া হয়। গতকাল ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জে চার ঘণ্টা বিরতি দেওয়া হয়। যদিও সারা দেশে জেলাভেদে এই বিরতি কম-বেশি আছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে ঘটে যাওয়া সহিংসতা ও চলমান কারফিউতে আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়েছে আস্থাহীনতার সংকট। এখনও সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
যতদিন পর্যন্ত দেশ স্বাভাবিক জায়গায় যেতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত এই অর্থনীতির ক্ষতিটা চলতেই থাকবে। এজন্য রাজনৈতিক যে বিষয়গুলো সাংঘর্ষিক সেগুলো যতটা দ্রুত সম্ভব কমাতে হবে। তবে সরকার যে নীতিতে চলছে সেটা বর্তমান পরিস্থিতিকে সাময়িক নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে।
দীর্ঘমেয়াদি কিছু করতে হলে বিভিন্ন ছাত্রসহ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। সরকারকে শিখতে হবে, শুনতে হবে ও বুঝতে হবে। তারপর কাজ করতে হবে জনগণ কি চায় সেটাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তাহলে আস্থার পরিবেশ ফিরে আসবে, যারা ব্যবসা করেন তারা স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফিরে আসতে পারলে সংকটের জায়গা কমবে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এই নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর একটি অনলাইন মাধ্যমকে বলেন, গত এক সপ্তাহের বেশি কিছু সময়ে আমাদের হিসাবে সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। এখনো কারফিউ চলমান আছে কতদিন চলবে জানি না, মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যাও কাটেনি ফলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। আমাদের বিনিয়োগ কমে গেছে, বিদেশি বিনিয়োগও আগামীতে বাড়বে কিনা সেটা বলা যাচ্ছে না। আর অর্থনৈতিক সূচকগুলো কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে সেটা নির্ভর করছে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর।
এ বিষয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান ওই গণমাধ্যমকে বলেন, বিগত কয়েকদিন দেশের যে অবস্থা ছিল এতে মোটামুটি দেশের সব কিছু বন্ধ ছিল। সেটার একটা প্রভাব তো দেশের অর্থনীতিতে পড়বে। তাছাড়া এখনও সব কিছু স্বাভাবিক হয়নি, ইন্টারনেট পাওয়া যাচ্ছে না ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত রয়েছে। বিশেষ করে ইন্টারনেট ও ডিজিটাল টেকনোলজি সংশ্লিষ্ট যেসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড রয়েছে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সহিংসতা ও কারফিউর কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল। এখন সেগুলো পূর্ণ দমে কতটুকু আসতে পেরেছে সেটা দেখার বিষয়।
তিনি বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক এ অস্থিতিশীলতা যদি দীর্ঘদিন থাকে তাহলে দেশি বিনিয়োগকারীর পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও চলে যাবে। কারণ তারাও আস্থার সংকটে ভুগবে যেটা আমাদের অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। রপ্তানিকারকদের অনেক অর্ডার বাতিল হয়েছে, নতুন কোনো অর্ডার পাচ্ছে না। বায়াররাও বাংলাদেশকে নিয়ে পুনঃবিবেচনা করবে। এসব বিষয় নিয়ে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির একটা বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেছে। সংখ্যার হিসেবে আমরা এটা দেখতে পারবো। কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়েছে আস্থাহীনতার। এখনও সাধারণ মানুষ থেকে ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। যতদিন পর্যন্ত দেশ স্বাভাবিক জায়গায় যেতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত এই অর্থনীতির ক্ষতিটা চলতেই থাকবে।
এই গবেষক বলেন, সরকার বা রাজনীতিবিদরা কেন আগে থেকে এ সমস্যাটা অনুধাবন করতে পারলেন না। তাহলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো এর দায় কার ওপর বর্তায়। সরকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ওপরই দায়টা যাবে। বিশেষ করে সরকারের ওপর বেশি যাবে। কারণ দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে সরকার। আমি আশা করবো এই রাজনৈতিক সহিংসতা কমে আসবে।
এদিকে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি অফিস গত বুধবার থেকে চার ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলোও খুলে দেওয়া হয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে সীমিত পরিসরে ইন্টারনেট চালু করা হয়েছে। সড়ক, মহাসড়কগুলোয় যান চলাচল ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।