বাংলাদেশে ২০১২ সালে চালু হওয়া ‘সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়: জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’ দুর্নীতি দমনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ছিল। এই কৌশলটি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি সুপারিশের ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু গত ১২ বছরে এই সুপারিশগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি, ফলে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছেন।

জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল নিয়ম-নীতি এবং আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়। সামগ্রিক এবং নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রমের প্রয়োজন রয়েছে। রাজনীতিতেও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা জরুরি। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এবং আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে সবাইকে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম এবং আত্মশুদ্ধি করতে হবে।

স্বল্পমেয়াদি সুপারিশগুলো ছিল:

জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা।

বেআইনি কাজ ও অসদাচরণ সম্পর্কে তথ্য প্রদানকারী ব্যক্তিদের সুরক্ষায় ‘জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রদান (সুরক্ষা) আইন’ বাস্তবায়ন।

পাবলিক সার্ভিসে জিআরএসের আওতায় অভিযোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রবর্তন।

আধুনিক বার্ষিক কর্মমূল্যায়ন পদ্ধতি এবং প্রণোদনা ও পারিতোষিক ব্যবস্থার প্রবর্তন।

প্রতিবছর নিয়মিতভাবে শূন্যপদে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ নিশ্চিত করা।

এমন সুপারিশগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।

মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশগুলো ছিল সরকারি সেবা খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়ন: পাবলিক সার্ভিসের দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়নের জন্য সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়ন করা।

কর্মজীবন উন্নয়ন পরিকল্পনা: কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মজীবন উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি দক্ষ, দায়বদ্ধ, যোগ্য ও দ্রুত সাড়াদান-সক্ষম নির্বাহী বিভাগ প্রতিষ্ঠা।

কর্মকালীন প্রশিক্ষণ: কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সক্ষমতা উন্নয়নের জন্য কর্মকালীন প্রশিক্ষণ পরিচালনা এবং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি।

পদোন্নতি পদ্ধতি: জ্যেষ্ঠতা, কৃতি, জ্ঞান ও দক্ষতার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতামূলক পদোন্নতি পদ্ধতি প্রবর্তন।

গভর্ন্যান্স: সরকারি সেবায় কার্যকারিতা আনয়ন ও গণমানুষের কাছে তা দ্রুত ও সহজলভ্য করার লক্ষ্যে ই-গভর্ন্যান্স প্রবর্তন ও তার প্রসার।

বেতন কাঠামো: সরকারি কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য যৌক্তিক বেতন কাঠামো নির্ধারণ ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে এগুলোর সমন্বয় সাধন।

বাস্তবায়িত হয়নি দুর্নীতি দমনের উদ্যোগ

সরকারি চাকরিজীবীদের দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে ২০১২ সালে প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে জনপ্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার নিয়ম চালু করা হয়েছিল। কিন্তু এই নিয়ম যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ নিয়ম বদলে ফেলার প্রস্তাব করে। সমালোচনার মুখে সরকার সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ সংশোধনীর প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রেখেছে।

আরও পড়ুন:  সারা দেশে বজ্রপাতে প্রাণ গেলো ১০ জনের

এছাড়া, বেআইনি কাজ ও অসদাচরণ সম্পর্কে তথ্য প্রদানকারী ব্যক্তিদের সুরক্ষা দেওয়ার বদলে বিতর্কিত আইন প্রণয়ন করে সাংবাদিকদের হয়রানি করা হচ্ছে। দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্যে নেওয়া পদক্ষেপগুলোর কার্যকর বাস্তবায়নের অভাবের কারণে এই ধরনের নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার ফলে সরকারি সেবা খাতে দুর্নীতি দমনের উদ্যোগ সফল হয়নি। এজন্য কার্যকর এবং সুষ্ঠু পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।

জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের বাস্তবায়নে যে কার্যক্রমগুলো নেওয়া হয়েছিল, তা সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হয়নি। জিআরএসের (গণমুখী অভিযোগ ব্যবস্থা) মাধ্যমে অভিযোগ ব্যবস্থাপনাও যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি। বর্তমানে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে চার লাখ ৭৩ হাজার একটি পদ শূন্য রয়েছে, যা দ্রুত পূরণ করার কথা ছিল।

মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশগুলোরও বাস্তবায়ন হয়নি এবং এসব উদ্যোগের কোনো তদারকি নেই। সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা জানান, তিনি তার পদে থাকাকালে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণয়নের কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি আশাবাদী যে, দুর্নীতি বন্ধের সব পরিকল্পনা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হবে। তবে বর্তমানে দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশের পরিমাণ বেড়েছে, যা তিনি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন, কারণ এর ফলে বিচার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে।

সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, সরকারের অনেক ভালো উদ্যোগ কাগজে-কলমে আছে, কিন্তু সেগুলো কার্যকর না হওয়ায় দুর্নীতি বেড়েছে। অভিযোগ উঠলে সেগুলো ধামাচাপা দেওয়া হয়, যা সরকারের উচিত নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে জবাবদিহির আওতায় আনা। তিনি আরও বলেন, আয়কর অফিসে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া এবং সরকারি কর্মচারীর নিজ দপ্তরে সম্পদের হিসাব বিবরণী জমার উদ্দেশ্য এক নয়। আয়কর অফিস সত্য-মিথ্যা যাচাই করে না, কিন্তু নিজ দপ্তর সম্পদের হিসাব যাচাই-বাছাই করতে পারে।

প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলেও, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তি না হওয়ায় দুর্নীতির সমস্যা অব্যাহত রয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো অনেক সময় অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের শুধুমাত্র তিরস্কার বা বেতন হ্রাসের মতো হালকা শাস্তি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করছে।

আরও পড়ুন:  প্রবাসীদের জ্ঞান-অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

বিভিন্ন অভিযোগ এবং শাস্তি প্রদান না করা:

অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও, এক পর্যায়ে সেগুলো ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে শাস্তি বা অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে না।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদ্যো সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে কয়েকবার অভিযোগ উঠলেও কোনো শাস্তি হয়নি।

নবীন কর্মকর্তাদের কম শাস্তির পাশাপাশি বড় দায় থেকে অনেকেই অব্যাহতি পাচ্ছেন।

প্রাপ্ত অভিযোগের সংখ্যা এবং শাস্তির ধরন:

২০২৩ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় এক হাজার কর্মকর্তার নামে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এর মধ্যে ১০ জন সহকারী সচিব, আটজন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব, সাতজন উপসচিব, একজন যুগ্ম সচিব এবং একজন অতিরিক্ত সচিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, তবে প্রজ্ঞাপন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি।

দুদকের তথ্য অনুযায়ী:

২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শতাধিক দুর্নীতির মামলায় প্রায় ৩৭৪ জনকে আসামি করা হয়েছে, যার অর্ধেকই সরকারি চাকরিজীবী।

আসামিদের মধ্যে ৯৬ শতাংশ মধ্যম ও নিম্ন সারির কর্মকর্তা-কর্মচারী। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রয়েছেন মাত্র ৪ শতাংশ।

গত সাত বছরের তথ্য পর্যালোচনায় একই চিত্র পাওয়া গেছে।

উচ্চপদস্থ যে কয়েকজনকে আসামি করা হচ্ছে, তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শেষ পর্যন্ত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় পার পেয়ে যাচ্ছে।

জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে সরকারি সেবা খাতে দুর্নীতি দমনের উদ্যোগ সফল হয়নি। যদিও মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তরগুলো শুদ্ধাচার কৌশল সম্পর্কে জানে, কার্যকর বাস্তবায়নের অভাবে দুর্নীতি দমন সম্ভব হয়নি। এজন্য কার্যকর এবং সুষ্ঠু পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।

সরকারি প্রশাসনের দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলেও শাস্তির অভাবে এই সমস্যা সমাধানে তেমন কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। তিরস্কার ও বেতন হ্রাসের শাস্তি দিয়ে দায় সারার প্রবণতা এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পার পেয়ে যাওয়া দুর্নীতির পরিবেশকে স্থায়ী করছে। এজন্য কার্যকর এবং সুষ্ঠু তদন্ত ও শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে দুর্নীতি দমনের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।

আরও পড়ুন:  ঝড়বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত দিল্লি: বাড়ি ভেঙে ৪ মৃত্যু, দুই শতাধিক ফ্লাইট বিলম্বিত

সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, “সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির শাস্তি শুধুই তিরস্কার—এটা ভাবা যায় না। কোনো দেশে দুর্নীতির মতো অপরাধের জন্য তিরস্কারের মতো লঘুদণ্ডের বিধান আছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীরা দুর্নীতিপরায়ণ হলে তাদের তিরস্কারের মতো লঘুদণ্ড দিয়ে চাকরিতে বহাল রাখার বিধান রেখে ২০১৮ সালে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আচরণ) বিধিমালা তৈরি করা হয়েছে।”

জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের খসড়াটি পর্যালোচনার জন্য তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি কয়েকটি সভায় মিলিত হয়ে দলিলটির কাঠামো ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মতামত ও নির্দেশনার আলোকে সার্বিকভাবে দলিলটি বিন্যস্ত করে। এরপর ২০১২ সালে মন্ত্রিসভার বৈঠকে কৌশলপত্রটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়।

মূল বিষয়বস্তু সমস্যাগুলো:

লঘুদণ্ডের বিধান: ২০১৮ সালে প্রণীত সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আচরণ) বিধিমালা অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির শাস্তি শুধুমাত্র তিরস্কার করা হয়। ফিরোজ মিয়া উল্লেখ করেছেন যে, এমন লঘুদণ্ডের বিধান বিশ্বের অন্য কোনো দেশে নেই।

জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল: ২০১২ সালে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণয়ন করা হয়, যার খসড়া অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের নেতৃত্বে কমিটি পর্যালোচনা করে। মন্ত্রিসভায় চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর শাস্তি প্রদান জরুরি। বর্তমান লঘুদণ্ডের বিধান দুর্নীতি দমনে যথেষ্ট নয়। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণীত হলেও তার বাস্তবায়ন সুষ্ঠুভাবে না হওয়ায় দুর্নীতি দমন কার্যকর হয়নি। এজন্য কঠোর আইন এবং কঠোর শাস্তি ব্যবস্থা প্রণয়ন করে তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *