মাথা ন্যাড়া করে দেশ ছেড়েছেন ‘ছাগলকাণ্ডে’র মতিউর

মতিউর রহমানের ‘ছাগলকাণ্ড‘ নিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো অত্যন্ত আলোচিত এবং উল্লেখযোগ্য। তাঁর ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাতের ১৫ লাখ টাকায় ছাগল কেনার ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করে। এই ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর মতিউরের এবং তাঁর পরিবারের বিপুল সম্পদের বিষয়টি উন্মোচিত হয়।এ ঘটনার পর থেকে মতিউর রহমানের খোঁজ মিলছিল না এবং বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নেওয়া হলেও তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। কোরবানির ঈদের ছুটির পরও তিনি অফিসে আসেননি। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে। পাশাপাশি, কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে ওএসডি করা হয়েছে এবং সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদও হারিয়েছেন।

গতকাল আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে মতিউর রহমান ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি ভারত থেকে সরাসরি দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা দিতে পারেন। একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট তাঁকে দেশত্যাগে সহযোগিতা করেছে। এই সব ঘটনা এবং তাঁর ভীতিপূর্ণ অবস্থার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ঘটনাই মূলত দায়ী।

মতিউর রহমানের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি অত্যন্ত চমকপ্রদ এবং রহস্যময়। ছাগলকাণ্ডের পর নিজের পরিচিতি আড়াল করতে তিনি মাথার চুল ফেলে টাক হয়ে দেশ ত্যাগের কৌশল নেন। এই ঘটনায় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের পরামর্শ তাঁর জন্য সহায়ক ছিল।ধানমণ্ডি, কাকরাইল, গুলশানসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁর খোঁজ নিয়ে তাঁকে কোথাও পাওয়া যায়নি। অফিসেও তিনি আর আসেননি, যা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনার সৃষ্টি হয়—মতিউর এখন কোথায়?

ছাগলকাণ্ডের পর, মতিউর রহমান ছেলেকে অস্বীকার করেন এবং সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়ে আত্মগোপনে চলে যান। মুঠোফোনে যোগাযোগও সীমিত ছিল। তাঁর ছেলে ইফাতকে নিরাপদে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে।

মতিউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের ছাত্র ছিলেন এবং তিনি অনেক কোম্পানির ছায়া পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। একাধিক ছোট কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে এনে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে পরিচিত হন। শেয়ারবাজার কারসাজিতে জড়িতদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয়টিও অনুসন্ধানে জানা গেছে।

মতিউর রহমানের এই অবস্থা তাঁর কর্মজীবনের গোপন এবং অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের ফল হিসেবে দেখা যাচ্ছে। দেশজুড়ে আলোচিত এই ঘটনা তাঁর পরিবারের বিপুল সম্পদের উৎস ও তাঁর কর্মকাণ্ডের প্রশ্নে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

আরও পড়ুন:  ইন্টারনেটে ধীরগতি, ঠিক হতে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে
দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদকের টিম গঠনমতিউর রহমানের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি তিন সদস্যের টিম গঠন করেছে। এই টিমের নেতৃত্বে রয়েছেন উপপরিচালক আনোয়ার হোসেন। গতকাল দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন এবং জানান যে, গত ৪ জুন কমিশন মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে গত দুই যুগে চারবার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রতিবারই পৃথকভাবে অনুসন্ধান করেও দুদক কোনো তথ্য-প্রমাণ পায়নি, ফলে তিনি অব্যাহতি পেয়েছিলেন। তবে এবার নতুন করে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে এবং অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা পুরনো অভিযোগগুলিও খতিয়ে দেখবেন।

মতিউর রহমানের সাম্প্রতিক ছাগলকাণ্ডের পর থেকে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের বিপুল সম্পদ এবং অর্থপাচারের অভিযোগ উঠেছে, যা তাঁকে নতুন করে দুদকের নজরে এনেছে। এর পাশাপাশি, সামাজিকভাবে বিতর্কিত হয়ে তিনি নিজেকে আড়াল করেছেন এবং দেশত্যাগের পরিকল্পনা করেছেন। এই পরিস্থিতি তাঁকে আরও বেশী আলোচনায় এনেছে এবং দুর্নীতির অভিযোগগুলো পুনরায় খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করেছে।

এনবিআরের পদ হারালেন

মতিউর রহমানের সাম্প্রতিক সময়ে ছাগলকাণ্ডের কারণে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন এবং এর ফলে তাঁকে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত (ওএসডি) করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের উপসচিব মকিমা বেগমের স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে এই তথ্য জানানো হয় এবং প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয় যে, এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।

মতিউর রহমানের উত্থান মূলত ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার থাকাকালীন সময় থেকে। এরপর তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেয়েছেন এবং বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ভ্যাটের কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন কোম্পানির ওপর ভ্যাট ডিমান্ড করে হয়রানির অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এমন একটি অভিযোগের ভিত্তিতে হাইকোর্ট এনবিআর ও দুদককে তাঁর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু অজানা কারণে এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সংস্থা দুটি।

আরও পড়ুন:  মেসির একাধিক গোল মিস, তবু্ও জয় দিয়ে শুরু আর্জেন্টিনার

এই সব অভিযোগ এবং সাম্প্রতিক বিতর্ক তাঁর কাজকর্মের প্রতি নতুন করে আলো ফেলেছে। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের ভিত্তিতে এখন নতুন করে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে, যা তাঁকে আরও বেশী চাপের মুখে ফেলেছে।

সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে অপসারণ

এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, সোনালী ব্যাংকের পরিচালক মতিউর রহমান সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ছাগলকাণ্ডের পরে। এই সংক্রান্তে বোর্ডের সদস্যরা তাকে বাতিল করেছেন। চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী জানিয়েছেন যে, পরিচালকের অপসারণের জন্য মন্ত্রণালয়ের চিঠির প্রয়োজন। এই চিঠি ইস্যু হওয়ার পর তাকে চূড়ান্তভাবে অপসারিত করা হবে। এছাড়াও, মতিউর রহমানকে বর্তমানে কোনো সভায় অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়নি।

নামে-বেনামে যত সম্পদ

মতিউর রহমান একজন সরকারি চাকরি করে একজন প্রাক্তন ব্যাংক পরিচালক ছিলেন, যার সম্পদের পরিমাণ অত্যন্ত বৃহত্তর। তাঁর সম্পদের অংশে ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, বরিশাল সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট-প্লট, রিসোর্ট রয়েছে। এর পাশাপাশি তাঁর এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে এফডিআর এবং শেয়ারবাজারে বড় পরিমাণের বিনিয়োগ রয়েছে।

সাধারণভাবে জানা যায় যে, তাঁর পুত্রকে অনেক বিলাসবহুল গাড়ি কিনে দিয়েছেন, যেমন প্রাডো, প্রিমিও, ক্রাউন ইত্যাদি। এসব গাড়িগুলোর রেজিস্ট্রেশন তাঁর বিভিন্ন কম্পানির নামে করা হয়েছে। তাঁর সম্পর্কিত কর্মকর্তারা অনুসারে, তাঁর বেনামে এনবিআর সদস্য হিসেবে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।

মতিউর রহমানের পরিবারের অবস্থানের বিস্তারিত তথ্য প্রদান করলেন আপনি। তাঁর ঢাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে মোটামুটি দুই ডজনের পরিমাণে, যা তাঁর প্রথম স্ত্রী ও তাঁর সন্তানদের নামে রেজিস্টার করা হয়েছে। তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ ঢাকার সাহাবুদ্দিন পার্ক এলাকায় বাস করেন, সেখানে চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে। দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার লালমাটিয়ার ইম্পেরিয়াল ভবনে থাকেন এবং কাকরাইলে তাঁর ছোট স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়াও, ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর এলাকায় তাঁর একাধিক ফ্ল্যাট আছে যা বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ডেভেলপার কম্পানির দ্বারা তৈরি করা।

এসব বিশেষত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের সম্পর্কে জানা গেলেও, মতিউর রহমানের পরিবার ব্যাপক ধরনের সম্পদ এবং বিনিয়োগ ধারণ করছেন এবং এটি একটি সম্প্রতি আলোচিত বিষয় হতে পারে।

আরও পড়ুন:  সকালের নাস্তায় থাকবে যেসব স্বাস্থ্যকর খাবার

মতিউর রহমানের পরিবারের অবস্থানের বিস্তারিত তথ্য প্রদান করা হয়েছে। তাঁর বিভিন্ন অংশগুলির মধ্যে টঙ্গীতে ৪০ হাজার বর্গফুট এসকে ট্রিমস নামের ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং ও অ্যাকসেসরিজ কারখানা রয়েছে। এই কারখানার মালিক হলেন তাঁর ভাই এম এ কাইয়ুম হাওলাদার। ময়মনসিংহের ভালুকায় ৩০০ বিঘা জমিতে গ্লোবাল শুজ নামের দুটি জুতা তৈরির কারখানা রয়েছে। তাঁর পুর্বাচলে আপন ভুবন পিকনিক অ্যান্ড শুটিং স্পটের মালিকানায় তাঁর নিজের। তাঁর প্রাইভেট আন্তর্জাতিক রিসোর্ট ওয়ান্ডার পার্ক অ্যান্ড ইকো রিসোর্ট নরসিংদীর রায়পুরার একটি অংশ যা তাঁর ছেলে ও মেয়ের মালিকানায় রয়েছে।

এই প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে মতিউর রহমান একটি বিস্তৃত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন যা তাঁর পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।

মতিউর রহমানের জমির বিস্তারিত তথ্য এবং তা পুনরায় বিশ্লেষণের জন্য নির্দিষ্ট খতিয়ান সংখ্যা এবং শতাংশ দেওয়া হয়েছে:

গাজীপুর সদর এলাকা:

    • ডাগ ১৭১ (10.50 শতাংশ)
    • ডাগ ১৭২ (3.90 শতাংশ)
    • ডাগ ১৬৩ (7.50 শতাংশ)
    • ডাগ ১৬৩ (6.00 শতাংশ)
    • ডাগ ১৭০ (6.00 শতাংশ)
    • ডাগ ১৬৩ (7.00 শতাংশ)
    • ডাগ ১৭০ (6.00 শতাংশ)

সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজা:

    • ডাগ ১৩০৩৫ (12.58 শতাংশ)
    • ডাগ ১৭৬৩ (12.58 শতাংশ)
    • ডাগ ১৭৬২ (12.58 শতাংশ)

এই আটটি খতিয়ানে মোট ৬০ শতাংশ জমি রয়েছে।

 স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে:

    • সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজা, ডাগ ১৩৬৯৬ (14.03 শতাংশ)
    • গাজীপুর সদর, ডাগ ৪৮.১৬ (অনুমোদিত)
    • গাজীপুর সদর, ডাগ ১৪.৫০ (অনুমোদিত)
    • সাভার থানা, ০.৪৫১৬২৫ একর (অনুমোদিত)

এই খতিয়ানগুলির তথ্য অনুযায়ী, মতিউর রহমানের স্ত্রী লায়লা কানিজ ও ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব এবং এই খতিয়ানে প্রকাশিত জমির অধিকারী রয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *