ঢাকার উত্তরে মেট্রোরেল সম্প্রসারণে বাধা দুই মেগা প্রকল্প

বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্প এমআরটি লাইন-৬, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে এবং বর্তমানে কমলাপুর পর্যন্ত এ লাইনটির সম্প্রসারণের কাজ চলছে।

এর পাশাপাশি উত্তরা থেকে রাজধানীর উপকণ্ঠ আশুলিয়া পর্যন্তও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা ছিল। তবে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কারণে আশুলিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। তাই বিকল্প হিসেবে টঙ্গী পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

এমআরটি লাইন-৬ ছাড়াও আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মেট্রোরেল প্রকল্প হচ্ছে এমআরটি লাইন-১, যা বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত প্রথম পাতাল মেট্রোরেল হিসেবে নির্মিত হচ্ছে। এটি ২০২৬ সালে চালু হওয়ার কথা রয়েছে এবং পরবর্তীতে গাজীপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কারণে এ পরিকল্পনাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

ঢাকায় মেট্রোরেল প্রকল্পের আওতায় ডিএমটিসিএল আরও চারটি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ করবে। এর মধ্যে হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত এমআরটি লাইন-৫ (নর্দান রুট) এর কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এই লাইনটি ঢাকার পূর্ব-পশ্চিম অংশকে সংযুক্ত করবে। বাকি তিনটি লাইন এমআরটি লাইন-২, এমআরটি লাইন-৪ এবং এমআরটি লাইন-৫ (সাউদার্ন রুট) ঢাকার পূর্ব, পশ্চিম এবং দক্ষিণ প্রান্তকেন্দ্রিক হবে।

এই মেট্রোরেল প্রকল্পগুলো ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নগরবাসীর যাতায়াত সহজতর করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। তবে, বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পের সমন্বয় ও সংঘর্ষ এ পরিকল্পনাগুলোর সফল বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।

আরও পড়ুন:  ম্যাচের সেরা মুশফিক, পুরস্কারের টাকা দেবেন বন্যার্তদের

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক জানিয়েছেন যে, এমআরটি লাইন-৬ এর আশুলিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারণ পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু সেখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কারণে এটি সম্ভব হচ্ছে না। ফলে, উত্তরা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত মেট্রোরেল সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। টঙ্গী রুটে প্রায় পাঁচ লাখ যাত্রী রয়েছে, তাই তাদের সুবিধার জন্য এ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

এই পরিকল্পনার জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চলছে, যেখানে পাঁচটি বিকল্প নিয়ে কাজ করা হচ্ছে এবং বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। অধিকাংশ মানুষ প্রস্তাবিত রুটের পক্ষে মত দিয়েছেন। প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শুরু হয়েছে প্রায় এক-দেড় মাস আগে এবং এটি শেষ হতে পাঁচ মাস লাগবে বলে আশা করা হচ্ছে। এরপর সমীক্ষা ও নকশার কাজ পুরোদমে শুরু হবে।

এছাড়া, এমআরটি লাইন-১ এর গাজীপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা থাকলেও, বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের মধ্যে বিআরটি প্রকল্পের কারণে এটি নিয়েও অসুবিধা সৃষ্টি হচ্ছে।

সারসংক্ষেপে, ডিএমটিসিএল কর্মকর্তারা মনে করছেন যে ঢাকার পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশে মেট্রোরেল সম্প্রসারণের সুযোগ থাকলেও, উত্তর অংশে আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্পের কারণে সম্প্রসারণের তেমন সুযোগ নেই।

যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক ঢাকার উত্তরে মেট্রোরেল সম্প্রসারণের ঝুঁকিতে পড়ার পেছনে বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষগুলোর সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেছেন। তিনি বণিক বার্তাকে জানান যে, সঠিক পরিকল্পনা এবং সমন্বিত উন্নয়ন না থাকার কারণে এই সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়েছে।

আরও পড়ুন:  কারাগারের ছাদ ফুটো করে পালালেন ফাঁসির চার আসামি

ড. সামছুল হক বলেন, “যেকোনো অবকাঠামো গড়ে তোলার আগে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। বর্তমান যুগটা হলো সমন্বিত উন্নয়নের মাধ্যমে টেকসই অবকাঠামো নির্মাণের। কিন্তু এ সংস্কৃতিটা বাংলাদেশে তৈরিই হয়নি।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, “একটাই সরকার, একটাই মন্ত্রণালয়। একজনই মন্ত্রী। পরিকল্পনা কমিশনও একটাই। এখানে সব কাজ সমন্বিতভাবে করার দারুণ সুযোগ ছিল।”

ড. সামছুল হক বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, ২০১৬ সালে এডিবি প্রস্তাব দিয়েছিল যে, বিআরটি প্রকল্পকে মেট্রোয় রূপান্তরিত করতে হবে, কিন্তু এ প্রস্তাব আমলে নেওয়া হয়নি। যদি পরিকল্পিত উন্নয়ন করা হতো, তাহলে ঢাকার উত্তরের মেট্রোরেল সম্প্রসারণ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে বা বিআরটি প্রকল্পের কারণে ব্যাহত হতো না।

এভাবে সমন্বয়হীনতার কারণে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মধ্যে বড় ধরনের ফাঁক থেকে যাচ্ছে, যা ঢাকার অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থার কারণে ডিএমটিসিএল এখন এমআরটি লাইন-৬ এর সম্প্রসারণ পরিকল্পনা আশুলিয়ার পরিবর্তে টঙ্গী পর্যন্ত করছে। বিশেষজ্ঞরা ডিএমটিসিএলকে এই সম্প্রসারণের আগে যথাযথভাবে সমীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন এবং মেট্রোরেল রাজধানীর বাইরে সম্প্রসারণ না করে তা ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ রাখার ওপর জোর দিচ্ছেন।

আরও পড়ুন:  বিশ্বে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ১২ কোটি মানুষ: জাতিসংঘ

বুয়েটের অধ্যাপক ও অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান বলেন, “মেট্রোরেল লাইন সম্প্রসারণের আগে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে চাহিদার ওপর। সম্প্রসারণ যেকোনো দিকেই হোক, তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু চাহিদা নেই এমন জায়গায় মেট্রোরেল সম্প্রসারণ করা হলে তা রাষ্ট্রের সম্পদের অপচয় ছাড়া আর কিছু হবে না।”

তিনি আরও উল্লেখ করেন, “মেট্রো হলো শহরভিত্তিক একটি গণপরিবহন ব্যবস্থা। একে শহরের মধ্যেই রাখা উচিত। উপকণ্ঠ বা আশপাশের জেলার জন্য রেলওয়ের মতো বিকল্প রয়েছে। মেট্রো সম্প্রসারণ না করে রেল নেটওয়ার্ককে উন্নত করেও প্রত্যাশিত যাত্রী সেবা দেয়া সম্ভব। এতে মেট্রোরেল নির্মাণের ব্যয় যেমন বেঁচে যাবে, তেমনি ব্যয়বহুল মেট্রো ট্রেন পরিচালনার দিকেও যেতে হবে না।”

এই মতামত অনুযায়ী, মেট্রোরেল সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মূল্যায়ন এবং সমন্বিত পরিকল্পনার গুরুত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকার মেট্রো নেটওয়ার্ক শহরের ভেতরেই সীমাবদ্ধ রাখা এবং শহরের উপকণ্ঠ বা আশপাশের জেলার জন্য রেল নেটওয়ার্ক উন্নত করাই সমন্বিত ও টেকসই গণপরিবহন ব্যবস্থার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *