কাজী ইফতেখারুল আলম তারেক :
স্বপ্নের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির কথা মনে হলে যে ছবি মনের কোনে উঁকি দেয়, ভাবুন তো কিসের কথা বলছি। জানি হয়তো এতক্ষণে আপনারও মনের কোনে ভেসে আসছে সেই নান্দনিক ছবি। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টির; কথা বলছি। নিউ ইয়র্ক হারবারের একটি দৃশ্য সকলেরই অতি পরিচিত।
বিশাল এক মশাল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রোমান দেবী, নাম লিবার্তাস। যে ভাস্কর্যটি স্ট্যাচু অব লিবার্টি নামেই সকলের কাছে পরিচিত। কয়েক দশক আগ পর্যন্তও এটি এলিস আইল্যান্ড হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকারী অভিবাসীদের জন্য আশার একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও এখন তা মার্কিন মুলুকের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই দৈত্যাকার ভাস্কর্যটি ঘিরে রয়েছে দারুণ এক ইতিহাস, সঙ্গে রয়েছে অজানা অনেক তথ্য যা হয়তো অনেকেরই অজানা।
গত বছরে সেপ্তেম্বরে আমি জাতিসংঘের ৭৮ তম অধিবেশনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ কাভার করতে অফিসিয়াল এসাইনমেন্টে আমেরিকায় গিয়েছিলাম। আমেরিকায় গেছি অথচ স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখতে যাব না তা কি হয়। সব কাজ সেরে আমি বেরিয়ে পড়ি আমেরিকার কাঙ্ক্ষিত সব স্থানে যেতে। ৫ অক্টোবর সকালে আমি ব্রুকলিন থেকে সোজা মেট্রো ধরে ম্যানহাটনে হাজির। সেখানে কিছুক্ষন নিজে নিজে ঘুরলাম। এরপর যোগ হল আমাদের আউয়াল ভাই, বেলাল ভাই এবং শ্যামলী। এরপর সবাই এক হয়ে আমরা এলিস আইল্যান্ডে যাওয়ার জন্য টিকেট সংগ্রহ করি। প্রতিটি টিকেটের দাম ৩৪ ডলার। আমরা ৪ জন ছিলাম সেই যাত্রায়। ওরাও আমার মতো নতুন।এখানে আর আসেনি। আমি ওদেরকে উৎসাহিত করেছিলাম। আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয় আরও অনেকেই। চেক পোস্ট অতিক্রম করে শিপে উঠতে হয়। এরপর মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম এলিস আইল্যান্ডে। শিপে উঠার পর সৌন্দর্য যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকলো। প্রচণ্ড উচ্ছাসে চিৎকার করি আমরা। প্রচণ্ড রোদের বিকেল ছিল। শিপ থেকে ম্যানহাটনের মোহনীয় সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে দু’চোখে অনুভব করলাম।
স্ট্যাচু অব লিবার্টির দিকে আমাদের শিপ এগিয়ে গেল, তখনই মনে হলও কবি গুরুর সেই বিখ্যাত গানটি।
”আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী/ গ্রহ তারা রবি/ তুমি কি তাদের মতো সত্য নও/ হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি”
তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা/ ওই যে সুদূর নীহারিকা/ যারা করে আছে ভিড় আকাশের নীড়/ ওই যারা দিনরাত্রি”
আসলেই যেন আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী- এটি দেখে আমি খুবই মুগ্ধ হয়েছিলাম।বিশ্বজুড়ে এতটাই আবেদন তৈরি করেছে যে, তা অনেক দেশের পাঠ্যপুস্তকে ঠাঁই করে নিয়েছে এই স্ট্যাচু অব লিবার্টি। স্কুল জীবনে আমাদের পাঠ্য বইতে এটি ছিল। তখন এই অনুচ্ছেদটি মুখস্ত ছিল আমাদের। সেখানে গিয়ে ক্লাসের সেই দিন গুলোর কথা মনে হল।
স্ট্যাচু অব লিবার্টি যেন স্বাধীনতার গল্প, শক্তি ও সাহসের গল্প, বিপুল প্রাণ ঐশ্বর্যের গল্প, বন্ধুত্ব ও ঐক্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেওয়া গল্প। মমতা আর বিশালতার গল্প। তখন কোন হৃদয়হীন এড়িয়ে যেতে পারে ওই ডাকে সাড়া না দিয়ে! অন্তত যারা যুক্তরাষ্ট্রে আছেন, গেছেন বা যাবেন, তাদের আলো হাতে অভ্যর্থনা জানাতে দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যাচু অব লিবার্টি (স্বাধীনতা ভাস্কর্য)।
বিশ্বের যত নন্দিত, জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী ভাস্কর্য আছে, তার মধ্যে শীর্ষ স্থানীয় স্ট্যাচু অব লির্বাটি। এর নির্মাণ, মূল ভাব এবং অবস্থান সব মিলিয়ে এক অসাধারণ আকর্ষণ ও আবেদন তৈরি করে এই ভাস্কর্য। এটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রতীক। সংগ্রাম, সাহস ও এগিয়ে যাওয়ার গল্প শোনায়।
আমি সেখানে নেমে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিলাম উপ দ্বীপে এমন নান্দনিক দৃশ্য দেখে। চোখ ভিজেছিল। এতদিন যেটা স্বপ্নে ছিল আজ যেন বাস্তবে ধরা দিল। সত্যি বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম। এরপর সেখান থেকে দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে লাইভ করেছিলাম। কি যে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। কারণ লিবার্টি আইল্যান্ডে গিয়ে আমি আবেগে আফ্লুত হয়েছিলাম। স্ট্যাচু অব লিবার্টির সম্পর্কে আগেই আদ্যোপান্ত আমার জানা ছিল । তাই বলতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি। স্কুলে যখন এটি পড়তাম আর ভাবতাম কখন যাব সেদেশে সেই স্থানে। স্বপ্ন যে বাস্তবে ধরা দেয় সেটিও উপভোগ করলাম নিরবে। এই নীরবতায় ব্যাপক আনন্দ আর উত্তেজনা। কেবল মন ভিজে যায় পরম সুখে। স্বপ্নকে ছুঁতে পারার তীব্র আনন্দ আমাকে সুখ দিয়েছিল। প্রায় দুই ঘণ্টা সেখানে কাটিয়ে সন্ধ্যার আগে শেষ শিপে ফিরেছি। এরপর ম্যানহাটনের অলি গলিতে নিয়মিত হাঁটাহাঁটি। কখনও ফ্রিডম টাওয়ার আশে পাশে আবার কখনও আম্পেয়ার স্টেট বিল্ডিং এর আশ-পাশ। গগন চুম্বি সব অট্টালিকা দেখে মনে হয়েছে ম্যানহাটনে দানব সব ভবন এখানে।
কীভাবে এলো স্ট্যাচু অব লিবার্টি :
১৮৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে এ ভাস্কর্য উপহার দেয় তাবৎ বিশ্বে শিল্প ও সাহিত্যের জন্য বিখ্যাত ফ্রান্স। ফাঁকে বলে রাখা ভালো, ভাস্কর্যটি যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় ১৮৮৬ সালে। এতো মূল্যবান ভাস্কর্য উপহার ফ্রান্স এমনিতেই দেয়নি। এর পেছনে ওদের অবশ্যই কিছুটা স্বার্থ কাজ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ। ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের শাসন থেকে মুক্ত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এগিয়ে যাওয়া বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে। এই সুযোগে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যকে পাশ কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির উদ্যোগ আসে ফরাসিদের কাছ থেকে। কেননা, ব্রিটেন, চিরকালের শত্রু ছিল ফ্রান্সের। বছরের পর বছর যুদ্ধে জড়িয়ে থাকতে হতো ওদের ব্রিটিশদের সঙ্গে। ইতিহাসের জোয়ান অব আর্কের কথা ওরা কি কোনোদিন ভুলতে পারবে! জোয়ান অব আর্ক ছিলেন একজন স্বাধীনতা যোদ্ধা বীরঙ্গনা নারী। এই স্ট্যাচু অব লিবার্টি কি ওই জোয়ান অব আর্কেরই স্মারক নয় তো!
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ প্রথম আসে এডওয়ার্ড রিনি লাবুলার কাছ থেকে। লাবুলা সে সময়ে ফ্রান্সের অন্যতম প্রভাবশালী চিন্তাবিদ ছিলেন। লাবুলা তার ভাবনা সম্পর্কে জানান, সেই সময়ের জগদ্বিখ্যাত স্থপতি ও ভাস্কর ফ্রেডারিক অগাস্তে বারথোলডিকে। শেষ পর্যন্ত লাবুলার উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখা শুরু করে।
লাবুলা ফরাসি সরকারের নির্দেশনা মতো যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আলোচনা করেন। ১৮৭১ সালের দিকে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে চুক্তি হয়, মূল ভাস্কর্যের ব্যয় বহন করবে ফ্রান্স। আর বেদী ও স্থাপনের খরচ দেবে যুক্তরাষ্ট্র।
ডিজাইন ও নির্মাণ :
স্ট্যাচু অব লিবার্টির ডিজাইন করেন অগাস্তে বারথোলডি। এটি নির্মাণে নেতৃত্ব দেন আলেকজান্ডার গুস্তাভ আইফেল। এই সেই আইফেল যিনি ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারের স্থপতি। ১৮৭৫ সালে ফ্রেন্স-আমেরিকান ইউনিয়ন গঠন করা হয়, যাদের হাতে স্ট্যাচু অব লিবার্টি নির্মাণের বিষয়গুলো ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর করা হয় নকশা।
আইফেলের নেতৃত্বে দুবছর ধরে ফরাসি ও মার্কিন ভাস্কররা স্ট্যাচু অব লিবার্টি তৈরি করেন, যা আড়াই ইঞ্চি পুরো তামার প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। ১৮৮৪ সালে নির্মাণকাজ শেষ হলে বেশকিছু দিন ফ্রান্সের একটি জাদুঘরে এটি সংরক্ষণ করে রাখা হয়। ১৮৮৫ সালে মূর্তিটি ৩০০ খ-ে খুলে ফেলা হয় এবং ২১৪টি বাক্সে ভরে জাহাজে করে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়।
উদ্বোধন :
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভিল্যান্ড ১৮৮৬ সালের ২৮ অক্টোবর স্ট্যাচু অব লিবার্টি উদ্বোধন করেন। ২২ তলা ভবনের সমান উঁচু মূর্তিটি উপকূলের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দেখা যায়, বিশেষ করে রাতে।
অবস্থান :
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের কোলে নিউ ইয়র্ক পোতাশ্রয়ের মুখে বেডলো দ্বীপে স্থাপন করা হয় স্ট্যাচু অব লিবার্টি। মূর্তির নামানুসারে বেডলো দ্বীপের নাম হয় লিবার্টি দ্বীপ। এখানে শত শত জাহাজ নোঙর করে। ব্যস্ততম এই দ্বীপে স্বাধীনতা, সাম্য ও মুক্তির প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যাচু অব লিবার্টি।
মূর্তির বিভিন্ন অংশ যেসব অর্থ বহন করছে :
স্ট্যাচু অব লিবার্টি একটি নারী মূর্তি, যার পরনে ঢিলা পোশাক এবং মাথায় আলোকশিখা বিচ্ছুরিত মুকুট। এর বাঁ হাতে আছে একটি বই, যাতে খোদাই করে লেখা যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার তারিখ ‘৪ জুলাই ১৭৭৬’। ডান হাতে আছে উঁচু করে ধরা মশাল, যা মুক্তির প্রতীক। পায়ের সঙ্গে থাকা ছেঁড়া শিকল বলে দিচ্ছে, পরাধীনতার খাঁচ থেকে বেরিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র।
মূর্তির বিভিন্ন অংশের পরিমাপ :
বেদী থেকে মশাল পর্যন্ত স্ট্যাচু অব লিবার্টির উচ্চতা ১৫১ ফুট ১ ইঞ্চি (৪৬ মিটার)। আর ভূমি থেকে মশাল পর্যন্ত উচ্চতা ৩০৫ ফুট ১ ইঞ্চি (৯৩ মিটার)। মূর্তি পায়ের গোড়ালি থেকে মাথা পর্যন্ত ১১১ ফুট উঁচু।
এবার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরিমাপ দেখে নেওয়া যাক। নাক ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি, হাতের দৈর্ঘ্য ১৬ ফুট ৫ ইঞ্চি, তর্জনি ৮ ফুট, নখ ১৩ ইঞ্চি, এক কান থেকে অন্য কান পর্যন্ত দূরত্ব ১০ ফুট, দুই চোখের ব্যবধান ২ ফুট ৬ ইঞ্চি, কোমর ৩৫ ফুট, মুখের প্রস্থ ৩ ফুট।
ওজন : মূর্তিটির মোট ওজন ২ লাখ ৫৪ হাজার কিলোগ্রাম।
আরো যা আছে :
২২ তলা সমান উঁচু মূর্তিটির বেদীর সঙ্গে কয়েকটি বড় কক্ষ আছে। এই বেদীর সঙ্গে আছে জাদুঘর, নতুন অভিবাসীদের ছবি ও তাদের পরিচয়, স্ট্যাচু অব লিবার্টির নির্মাণের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস।
বিলুপ্তির আশঙ্কা :
ঝড়ঝঞ্ঝা আর বৃষ্টিতে তামার তৈরি স্ট্যাচু অব লিবার্টির উপরিভাগের ব্রোঞ্জের প্রলেপ শতবর্ষেই সবুজাভ হয়ে গেছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে তামায় কার্বন জমা হয়। স্বাভাবিক বৃষ্টির পানিও তামার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে। এভাবে জল এবং ধাতুর রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এই সবুজাভ রঙের সৃষ্টি হয়েছে। আর বাতাস এই ক্ষয়ের গতিকে ত্বরান্বিত করে।
১৯৩৭ সালে প্রথমবারের মতো স্ট্যাচু অব লিবার্টির বড় ধরনের সংস্কারকাজ করা হয় আবহাওয়াজনিত ক্ষয় থেকে একে রক্ষা করার জন্য। এর ভেতরে পানি চুঁইয়ে পড়া এবং অন্যান্য ক্ষতি ঠেকানো হয়েছিল তখন। তবে কালের পরিক্রমায় এই ধাতব স্থাপত্যটি একদিন নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। যাতে এটি রক্ষার কোনো চেষ্টাই কাজে আসবে না। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল তিন বছর এবং ২০১১ থেকে ২০১২ সাল দুই বছর ধরে স্ট্যাচু অব লিবার্টির সংস্কার করা হয়। আর এই সংস্কার আরো কতোবার করা যাবে সেটাই ভাবনার বিষয়।
TAG – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র – নিউ ইয়র্ক – স্ট্যাচু অব লিবার্টি – স্বাধীনতা ভাস্কর্য