বিজয় উল্লাস প্রকাশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

ভারতের সাধারণ নির্বাচনে আবারও জয় পেল নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। তবে গতকাল মঙ্গলবার ঘোষিত ফলে দেখা যায়, বিজেপি গত ১০ বছরের মধ্যে প্রথমবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে, যা তাদের জন্য বড় ধাক্কা। বিরোধী দল দাবি করছে, এর মাধ্যমে দেশবাসী দীর্ঘদিন ক্ষমতাসীন বিজেপিকে একটা স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। অনেক পর্যবেক্ষক ও বুথফেরত জরিপের আভাস ছিল নরেন্দ্র মোদির বিজেপি বড় ধরনের জয় পাবে, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।

এনডিএ জোট সার্বিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও বিজেপি একা মাত্র ২৪০ আসন পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল, যা সরকার গঠনে যথেষ্ট নয়। অন্যদিকে চমক সৃষ্টি করে বিরোধী দল কংগ্রেস তার গতবারের মাত্র ৫২ আসন প্রায় দ্বিগুণ করে ৯৯-তে উন্নীত করেছে। এর মধ্যে রাতে ভোট গণনার মধ্যে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে, সরকার গঠনের প্রত্যাশায় এনডিএ জোটের দুই দল টিডিপি ও জনতা দলকে পক্ষে টানার চেষ্টা করছে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট। তারা এনডিএ ছাড়লে দুই জোটের আসনসংখ্যা হয়ে যাবে ২৬০, যা সরকার গঠনে প্রয়োজনের চেয়ে মাত্র ১২টি আসন কম।

dakdiyajaiy. ভারতের লোকসভা নির্বাচনএবার জোটই ভরসা মোদির
ভারতের লোকসভা নির্বাচন
এবার জোটই ভরসা মোদির – ছবি: এএফপি
তখন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ভোট গণনা মধ্যরাতের দিকে গড়াতে থাকলে এই নাটকীয় সমীকরণের সম্ভাবনা জেগে ওঠে।জোটের জয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর রাজধানী নয়াদিল্লিতে উল্লসিত সমর্থকদের সামনে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘দেশের জনগণ আমাদের দল ও জোটকে তৃতীয়বারের মতো ম্যান্ডেট দিয়েছে।’এনডিএ জোট শেষ পর্যন্ত সরকার গড়লে স্বাধীন ভারতের প্রথম নেতা জওয়াহেরলাল নেহরুর পর মোদিই টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন।

উৎফুল্ল রাহুল গান্ধী গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, “দেশের মানুষ নরেন্দ্র মোদিকে বলেছে, ‘আমরা আপনাকে চাই না।’ আমার আস্থা ছিল এ দেশের লোক তাদের উপযুক্ত জবাব দেবে।”নির্বাচনে জয়ের আভাস পেয়ে চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার অনেক আগেই বিজেপির সদর দপ্তরে উদযাপন শুরু হয়ে যায়। অন্যদিকে টানা দুইবারের ব্যর্থতার পর এই নির্বাচনে ঘুরে দাঁড়ানোয় নয়াদিল্লিতে কংগ্রেসের সদর দপ্তরের পরিবেশও ছিল আনন্দমুখর।

কয়েক বছর ধরে রাজত্ব করা মোদি-ম্যাজিকের ঘোর এরই মধ্যে ফিকে হতে শুরু করেছিল। তার পরও এবারের ভোটের ফলাফল অনেকের জন্যই ব্যাপকভাবে অপ্রত্যাশিত।

সাত দফায় দীর্ঘ ৪৭ দিনের নির্বাচনী কর্মকাণ্ড শেষে গতকাল সকাল ৮টা থেকে ভোট গণনা শুরু হয়। স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের তিন শর কাছাকাছি আসনে এগিয়ে থাকার আভাস মিলেছে। লোকসভার মোট আসন ৫৪৩।ইন্ডিয়া জোটের সরকার গঠনের চেষ্টা?

কংগ্রেস সরকার গঠনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ও তেলুগু দেশম পার্টির প্রধান চন্দ্রবাবু নাইডুর সঙ্গে কথা বলবে বলে জানিয়েছেন দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা। নীতীশ ও নাইডু উভয়েই অতীতে কংগ্রেসের মিত্র ছিলেন। ইন্ডিয়া জোটের মিত্র উদ্ধব ঠাকরে প্রথম জনসমক্ষে এ নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেছেন, কংগ্রেস নীতীশ ও নাইডু উভয়ের সঙ্গে কথা বলতে চায়।

সম্ভাব্য চূড়ান্ত ফলে দুই প্রধান জোটের মধ্যে খুব কম ব্যবধানের কারণেই রাতে বিকল্প সম্ভাবনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়। নীতীশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেড এবং চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলুগু দেশম পার্টি মিলিয়ে ২৮টি আসন পেতে পারে। কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে এ রকম সংখ্যা বড় ব্যবধান গড়ে দিতে পারে। দল দুটি পক্ষ পরিবর্তন করলে ইন্ডিয়া জোটের আসন যেমন বাড়বে অন্যদিকে কমে যাবে এনডিএ জোটের।

দিল্লিতে ইন্ডিয়া জোটের আজকের সভায় এটিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে রাষ্ট্রপতি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া দল বা জোটকে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানাবেন।

রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে নীতীশ কুমার এবং চন্দ্রবাবু নাইডু উভয়েরই রেকর্ড বিতর্কিত। নীতীশের ঘন ঘন জোট পরিবর্তনের জন্য কুখ্যাতি আছে। গত এক দশকে তিনি পাঁচবার পক্ষ বদলেছেন। সর্বশেষ ডিগবাজি দিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে ইন্ডিয়া জোট ছেড়ে বিজেপিতে যান তিনি। আর চন্দ্রবাবু নাইডু ২০১৯ সালের ভোটের আগে এনডিএ ছেড়ে গেলেও আবার এবারের নির্বাচনের আগে জোটে ফিরে আসেন।

২০১৪ সালে মোদি যখন প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন, তখন বিজেপি একাই পেয়েছিল ৩৩৬টি আসন। ২০১৯ সালেও বিজেপি এককভাবে ৩০৩টি আসনে জয় পেয়েছিল। অন্যদিকে ২০১৪ সালে ভরাডুবি হয়েছিল ভারতের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেসের। সেবার মাত্র ৫৯টি আসন পেয়েছিল দলটি। ২০১৯ সালের নির্বাচনেও কংগ্রেসের অবস্থার তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন চোখে পড়েনি। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট পেয়েছিল ৯৪টি আসন।

শেয়ারবাজারে ধস

এদিকে আসনসংখ্যা কমার বিষয়টি সংসদে বিজেপির আইন পাস বা সংশোধনী আনার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করবে—এ শঙ্কায় গতকাল ভারতের শেয়ারবাজারের সূচকে ধস নামে। সূচক চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে যায়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মোদির ঘনিষ্ঠ মিত্র গৌতম আদানির মালিকানাধীন আদানি এন্টারপ্রাইজের প্রধান তালিকাভুক্ত ইউনিটের শেয়ারের দাম ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। পরে আবার তা কিছুটা ওঠে।

মোদির কৌশলী প্রচারাভিযান

বিজেপির কৌশলী ও মোটা অঙ্কের অর্থায়নে চালানো প্রচারাভিযানের সঙ্গে টক্কর দিতে হয়েছে বিরোধী দলগুলোকে। এ ছাড়া মোদিবিরোধীদের দাবি, রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দিয়ে তাঁদের ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

মার্কিন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউস কিছুদিন আগে এক পর্যবেক্ষণে বলেছিল, ‘বিজেপি রাজনৈতিক বিরোধীদের লক্ষ্যবস্তু করার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাগাতারভাবে হাতিয়ার করছে।’

দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম সদস্য আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে নির্বাচনের আগে আগে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়। নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তী জামিন পেলেও গত রবিবার ফের কারাগারে প্রবেশ করতে হয়েছে তাঁকে। ওই মামলা রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই দাবি বিরোধীদের।

মোদি-ম্যাজিকের ঘোর কমেছে

গুজরাটের একসময়ের সফল মুখ্যমন্ত্রী দিল্লির মসনদে প্রথম বসেন ২০১৪ সালে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মুসলিম নিধনের কালো ছায়া মাথার ওপর থেকে গেলেও রাজ্যের অর্থনীতিতে চমকপ্রদ সাফল্যের জন্য দেশব্যাপী প্রশংসিত হয়েছিল মোদির ব্যবস্থাপনা। এবার তৃতীয় মেয়াদে জয়ও নিশ্চিত বলে ধরে নিয়েছিলেন সব পর্যবেক্ষকই। তবে বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন কারণে বিজেপির প্রতি জোয়ার দৃশ্যমানভাবেই কম ছিল এবার। সমালোচকদের অনেকের মত, শেষদিকে এসে আত্মবিশ্বাসে ঘাটতির কারণেই মরিয়া হয়ে ধর্মীয় কার্ড খেলেছেন নরেন্দ্র মোদি। তাতে বিজেপি সমর্থক সীমিত সংখ্যালঘু ভোটও দৃশ্যত অনেকটা ছুটে গেছে। অন্যদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোটের মরণপণ লড়াই ভোটের ছবিটা শেষ পর্যন্ত পাল্টে দিয়েছে।

গতবারের তুলনায় ভোটারসংখ্যাও কম

নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ২০১৯ সালের নির্বাচনের তুলনায় কম ছিল। এবার ৬৬.৩ শতাংশ ভোটার তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। গতবার ৬৭.৪ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। এবার ভোটারসংখ্যা কমার জন্য আংশিকভাবে তীব্র দাবদাহকেও দায়ী করেছেন বিশ্লেষকরা। বিজেপি নিশ্চিতভাবেই জিতবে—এ আস্থা থেকেও অনেক সমর্থক কেন্দ্রে যাননি বলে পর্যবেক্ষকদের কারো কারো ধারণা। সার্বিকভাবে কম ভোট পড়া বিজেপির আসন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

ভারতের ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে ৯৬ কোটি ৯০ লাখ ভোটার। ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে ১ জুন পর্যন্ত মোট সাত ধাপে লোকসভার ৫৪৩টি আসনে ভোট হয়। দেশজুড়ে প্রায় ১৫ লাখ ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল। বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয় স্কুল, কলেজ ও কমিউনিটি সেন্টারে।

সূত্র : এএফপি, এনডিটিভি

@dakdiyejai.news  @ডাকদিয়েযাই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *