ড. সালেহা কাদের – আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩তম জন্মবার্ষিকী। বাংলা ও বাঙালির অহংকার, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের একদিকে অনন্ত প্রেম, অন্যদিকে বিদ্রোহ। কী কবিতায়, কী গানে, উপন্যাসে, গল্পে সর্বত্রই মানবমুক্তি, প্রেমময় ও দ্রোহের বাণী। দুই-ই ঝঙ্কৃত হয়েছে জাতীয় কবি নজরুলের সৃষ্টিতে।পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা, কুসংস্কার, হীনম্মন্যতার বিরুদ্ধেও শিখিয়েছেন রুখে দাঁড়াতে।
অবিভক্ত বাংলার বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ সালের ২৫ মে) জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
তার ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। তিনি ছিলেন বাংলা কবিতার একমাত্র বিদ্রোহী ও গানের বুলবুল। তার বাবার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মায়ের নাম জাহেদা খাতুন।
তিনি ছিলেন প্রেম, বিরহ-বেদনা ও সাম্যের মানুষ। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্য-সংগীত তথ্য সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান পুরুষ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় কাজী নজরুল ইসলামের লেখনী ধূমকেতুর মতো আঘাত করে জাগিয়ে তুলেছিল ভারতবাসীকে। যার ফলে বিদ্রোহী কবিতে পরিণত হন তিনি।
‘দুখু মিয়া’ হিসেবেও পরিচিত এ কবি সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, নিপীড়ন, অনাচার, বৈষম্য, শোষণ ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে অগ্নিকণ্ঠে সোচ্চার হয়ে লিখে গেছেন।অসংখ্য গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও গান রচনার পাশাপাশি তিনি ছিলেন চির প্রেমের কবি। প্রেম নিয়েছিলেন এবং দিয়েছিলেন। তিনি বিদ্রোহী কবি হলেও প্রেমিক রূপ ছিল প্রবাদপ্রতিম।
এছাড়াও একাধারে তিনি কবি,গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, শিশু সাহিত্যিক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, সাংবাদিক, গীতিকার, সুরকার, স্বরলিপিকার, গীতিনাট্যকার, গীতালেখ্য রচয়িতা,চলচ্চিত্র কাহিনীকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক, গায়ক, বাদক, সঙ্গীতজ্ঞ ও অভিনেতা।
“মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর এক হাতে রণতূর্য” হাতে নিয়ে নজরুল লিখেছেন ২২টি কাব্যগ্রন্থ, সাড়ে ৩ হাজার, মতান্তরে ৭ হাজার গানসহ ১৪টি সংগীত গ্রন্থ, ৩টি কাব্যানুবাদ ও ৩টি উপন্যাস গ্রন্থ, ৩টি নাটক, ৩টি গল্পগ্রন্থ, ৫টি প্রবন্ধ, ২টি কিশোর নাটিকা, ২টি কিশোর কাব্য, ৭টি চলচ্চিত্র কাহিনীসহ অসংখ্য কালজয়ী রচনা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।কবির ‘চল্ চল্ চল্- ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’কে রণ সংগীত হিসেবে নির্বাচিত করে সম্মানিত করেন। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্রোহী কবি নজরুলকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কবিকে প্রদান করে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে কবিকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাঙালির চেতনার কবি নজরুল। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাধিস্থ করা হয়।
সব মিলিয়ে নজরুল এক বহুমুখী অনন্য প্রতিভা। একদিকে ছিলেন বিদ্রোহী, অন্যদিকে প্রেমিক ও মানবতাবাদী। তার গান জাতিকে জাগরণের পথে
অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। ইসলামী গানের পাশাপাশি তিনি শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। কোথাও উদার মানবতাবাদকে বিসর্জন দেননি। নজরুল সারা জীবনই মানবতার সাধনা করেছেন। তার কবিতা, গান ও গদ্য উপমহাদেশের মানুষকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছে। একজন সাংবাদিক হিসেবেও নজরুল অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন।
তিনি ১৯২৯ সালে আমাদের সন্দ্বীপে গিয়েছিলেন তাঁর জীবনের শ্রেয়তম বন্ধু কমরেড মুজফফর আহমেদ এর আমন্ত্রণে। লিখেছেন মধুমালা নাট্য, সন্দ্বীপে রুপে মুগ্ধ কবি লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। নজরুলের স্মৃতি ধন্য বিভিন্ন জায়গায় নজরুলের উপর মেলা কিংবা আলোচনা হয়। কিন্তু সন্দ্বীপে তেমন আয়োজন চোখে পড়েনি।
অদূর ভবিষ্যতে সন্দ্বীপে নজরুল কে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করা যেতে পারে, কেননা তিনি সন্দ্বীপেও এসেছিলেন এবং সন্দ্বীপের উপরে তাঁর লেখা রয়েছে।
সন্দ্বীপে এসেও তিনি লিখেছেন বিখ্যাত সব কবিতা।
গুবাক তরুর সারি –
বিদায়, হে মোর বাতায়ন-পাশে নিশীথ জাগার সাথী!
ওগো বন্ধুরা, পান্ডুর হ’য়ে এল বিদায়ের রাতি!
আজ হ’তে হ’ল বন্ধ আমার জানালার ঝিলিমিলি,
আজ হ’তে হ’ল বন্ধ মোদের আলাপন নিরিবিলি ——
………………………………………….
তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না,
কোলাহল করি’ সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না |
— নিশ্চল নিশ্চুপ/ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধূর ধূপ !——
এমন হৃদয় নিংড়ানো কবিতা কেবল তাঁর পক্ষেই লেখা সম্ভব। গভীর প্রেম আর অনুরাগের যে বাণী তিনি লেখায় ছড়িয়েছেন সেটা অপূর্ব। সন্দ্বীপে এসে তিনি
মধুমালা গীতিনাট্য রচনার নায়িকা এখানেই পেয়েছিলেন। তাই এই ভূমি তাঁর স্মৃতি ধন্য। এখানেও জাতীয় কবির নামে আয়োজন কিংবা মেলা করার দাবি জানাই- সন্দ্বীপ উপজেলা পরিষদের কাছে। তারা আয়োজনের উদ্যোগ নিলে আমরা এগিয়ে আসবো।
আমার কৈশোরে কবিকে দেখার সুযোগ হয়েছিল একবার। তখন কবি প্রায় জীবন সায়াহ্নে উপস্থিত। ধানমণ্ডি কবি ভবনে একবার আমার আব্বা ১৯৭৬ সালে আমার আম্মা, ভাই-বোন সহ আমাদের কবি ভবনে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়েছিলেন। কবির সেই ডাগর চোখের চাহনি, বাবরি চুল, সেই স্মৃতি আজও অমলিন। এই মহান মানুষের সান্নিধ্য পাওয়াকে এক জীবনের জন্য বিশেষ সৌভাগ্য বলে মনে করি। জীবনের কিছু সুন্দর মুহূর্তের মধ্যে এই স্মৃতি আমাকে এখনও আবেগ তাড়িত করে।
আজ কবির জন্মদিনে মনে পড়ে গেল পুরনো স্মৃতিময় দিন।
লেখক- শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক। 

@dakdiyejai.news  @ডাকদিয়েযাই

আরও পড়ুন:  গণহত্যার অপর পিঠে লেখা ছিল স্বাধীনতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *