২০২১ থেকে এ পর্যন্ত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর ক্রমেই চাপ বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সময়ে ঢাকাকেন্দ্রিক কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়েছে বেইজিংও। একই সঙ্গে বাংলাদেশের পক্ষে জোর বক্তব্যও রেখেছে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল কাজ করেনি বলে মনে করছে ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান স্টিমসন সেন্টার। বরং ঢাকা-ওয়াশিংটনের সম্পর্কের অস্বস্তির সুযোগে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছে বলে সংস্থাটির এক পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। স্টিমসন সেন্টারের এপ্রিলে প্রকাশিত এক পলিসি পেপারে এমন পর্যবেক্ষণ দেন ইউনাইটেড স্টেটস এয়ার ওয়ার কলেজের ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ক্রিস্টোফার কে কলি।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চ পর্যায়ের এক প্রতিনিধি দল ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা সফরে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সিনিয়র ডিরেক্টর ফর সাউথ এশিয়া এলিন লাউবাকেরের নেতৃত্বে ওই প্রতিনিধি দলের চারদিনের সফর শুরু হয় ৭ জানুয়ারি। সফর চলাকালে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সপ্তাহ পেরোনোর আগেই আরেক সফরে ঢাকা আসেন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট ফর সাউথ অ্যান্ড সেন্ট্রাল এশিয়ান অ্যাফেয়ার্স ডোনাল্ড লু।
এ দুই সফরের মাঝামাঝি সময়ে ১০ জানুয়ারি আকস্মিকভাবেই অল্প কিছু সময়ের জন্য ঢাকায় অবতরণ করেন চীনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গাং। আফ্রিকা যাওয়ার পথে ২ ঘণ্টার ওই ‘যাত্রাবিরতির’ মধ্যে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে তার একটি বৈঠকও হয়। খুবই সংক্ষিপ্ত ওই সফর সে সময় আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি বিশেষজ্ঞদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। বিশেষ করে চিন গাংয়ের সফর নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ দিতে থাকেন পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরা।
ওই সময়ে বাংলাদেশ আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক অস্বস্তি চরমে। ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত ডেমোক্রেসি সামিটে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি বাইডেন প্রশাসন। ওই বছরেই বাংলাদেশের একটি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ। এর ধারাবাহিকতায় যে অস্বস্তির সূত্রপাত তা ২০২২ ও ২০২৩ সালের পুরো সময়জুড়ে দিনে দিনে আরো গুমোট আকার ধারণ করেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বেশকিছু ব্যক্তি পর্যায়ের বিধিনিষেধ আরোপের ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
এরপর নির্বাচনে ভোট গ্রহণের সময় যত ঘনিয়ে এসেছে দুই দেশের মধ্যে তিক্ততার মাত্রাও তত বেড়েছে। একই সময়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি জোর সমর্থন দিয়ে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচন কেমন হবে তা একান্তই বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়।
স্টিমসন সেন্টারের পলিসি পেপারে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ হলো চীন। গণতন্ত্র ইস্যুতে বাংলাদেশকে প্রকাশ্যে তিরস্কার করতে গিয়েই বেইজিংয়ের সুবিধা করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে দিয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, এমনকি নয়াদিল্লিও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে অপরিহার্য বলে মনে করে। এ বিষয়ে ভারতের মধ্যেও উদ্বেগ রয়েছে যে ওয়াশিংটন বাংলাদেশকে নিয়ে অনমনীয় হলে তা নয়াদিল্লির কাঙ্ক্ষিত পন্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। ভারতের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময়ে সতর্কবার্তা দিয়ে বলা হয়েছে, এ তিক্ততার ফলাফল হিসেবে বাংলাদেশ আরো চীনমুখী হয়ে উঠতে পারে।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বিধিনিষেধ আরোপ শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোর প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময় বলেছিলেন, ‘আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ২০ ঘণ্টার উড়োজাহাজ ভ্রমণ করে কেউ যুক্তরাষ্ট্রে না গেলে তাতে কিছু যায় আসে না। পৃথিবীতে অন্যান্য মহাসাগর ও অন্যান্য মহাদেশ রয়েছে, আমরা সেই মহাদেশগুলোর সঙ্গে অন্য মহাসাগর অতিক্রম করে বন্ধুত্ব করব।’
এছাড়া এখন পর্যন্ত চীনই একমাত্র দেশ যার সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক সহযোগিতার চুক্তি রয়েছে। বাংলাদেশে অস্ত্র আমদানির বৃহত্তম উৎস চীন। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট অস্ত্র আমদানির ৭৩ শতাংশই এসেছে চীন থেকে।
স্টিমসন সেন্টারের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব চীনা বিশ্লেষকরা এখন বেশ ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছেন। সাংহাইভিত্তিক ফুদান ইউনিভার্সিটির লিন মিনওয়াং মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ‘কৌশলগতভাবে আটকে ফেলার’ নীতি মোকাবেলার জন্য চীনের বাংলাদেশকে প্রয়োজন।
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় চীন ও ভারত উভয় দেশই বাংলাদেশকে কাছে পেতে চায়। আবার যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতেও বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে দক্ষিণ এশিয়া তথা বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী অঞ্চল। গত এক দশকে বেইজিং ও নয়াদিল্লি উভয়েই ঢাকার সামনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ঋণ ও সহায়তার প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাজির হয়েছে। এসব সহায়তার বড় অংশজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সফরে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২৭টি চুক্তিতে সই করেন শি জিনপিং। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে চীনের মোট বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে, যা বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১০ শতাংশের কাছাকাছি। শি জিনপিংয়ের প্রতিশ্রুত অনেক প্রকল্পই এখনো বাস্তবায়ন না হলেও চীন-বাংলাদেশ ঘনিষ্ঠতা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
@dakdiyejai.news @ডাকদিয়েযাই
#dakdiyejai.news #ডাকদিয়েযাই