ড.সালেহা কাদের

আজ ২৫শে মার্চ। ১৯৭১ সালের এই তারিখে বাঙালি জাতির জীবনে এক বিভীষিকাময় রাত নেমে আসে।

মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কাপুরুষের মত তাদের পূর্ব পরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা অনুযায়ী আন্দোলনরত বাঙালিদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।মানবেতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যায় সেই কালো রাতে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী মেতেছিল জান্তব উল্লাসে।

সেই বর্বরোচিত গণহত্যা থেকে কেউ রেহাই পায়নি। ঢাকা শহর সহ পাশ্ববর্তী শহর গুলো দেখে মনে হয়ে ছিল মহাশশ্বান। সেই রাতে অত্যন্ত সুকৌশলে গ্রেফতার করা হয় বাংলার রাখাল রাজা, স্বাধীনতার যিশু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে। তাঁর নেতৃত্বে ২৬ মার্চ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এ দেশের মুক্তিকামী জনতা। বহু রক্ত ঝরেছে এ বাঙ্গালির বক্ষ থেকে। যুদ্ধে জীবন দিয়েছিল শিশু-কিশোর-কৃষক-যুবার, জননী-ভগিনী সহ ৩০ লক্ষ মহতী প্রাণ। ২০১৭ সাল থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫শে মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

ভয়াল ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ যেভাবে এলো-

এই অপারেশন নির্দেশনামা তৈরি করেন পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি রাখা হয়নি। গণহত্যার সেই পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়। দীর্ঘ সময় পরে ২০১২ সালে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ‘অ্যা স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ নামে তার আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত সে আত্মজীবনীতে প্রথমবারের মতো অপারেশন সার্চ লাইট সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।

অপারেশন সার্চলাইট কীভাবে পরিকল্পিত হয়, ১৯৭১ সালের সেই স্মৃতিচারণ করে খাদিম হোসেন রাজা লিখেছেন, ‘১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউসে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেন সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং সে অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। এছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকেলে আমরা দুজন যেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি।’ পরদিন সকালেই খাদিম হোসেন রাজা তার কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তারাই গণহত্যার এ অভিযানের নাম দেন ‘অপারেশন সার্চ লাইট’।

আরও পড়ুন:  বাংলাদেশে বিনিয়োগে বাধা ঘুষ, দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা: যুক্তরাষ্ট্র

দেশ স্বাধীনের পর থেকে গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ব্যাপারে দেশের বাইরে কোনো প্রকার কার্যক্রম বা জনমত গড়ে তোলা হয়নি। তাছাড়া দেশের ভেতরে গণহত্যা নিয়ে ওভাবে কোনও কাজও হয়নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের উদাসীনতাও এর অন্যতম কারণ।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আর্মেনিয়ার গণহত্যাকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ানোর জন্য আর্মেনিয়ানরা ১০০ বছর ধরে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আর্মেনিয়ানরা এটি নিয়ে রীতিমতো আলাপ-আলোচনা ও জনমত গড়ে তুলেছে। আমরা তা করতে পারিনি বলে ২৫শে মার্চের গণহত্যার এখনও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। অথচ বাংলাদেশের ২৫শে মার্চের গণহত্যা বিশ্বের উল্লেখযোগ্য গণহত্যাগুলোর একটি।

১৯৭১ এর স্বাধীনতার ঊষা লগ্নে, ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন কালে রনাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতার তথ্যাদি পৌঁছে দিতে জীবন বাজি রেখে বেলাল মোহাম্মদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন “বিল্পবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র”। যেখান থেকে গোপনে দীর্ঘ ৯ মাস প্রচার করা হয়েছিল মুক্তির গান, স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ও মুজিব নগর সরকারের বার্তা।
সন্দ্বীপের সূর্য সন্তান এদেশের বিশিষ্ট বাঙ্গালি কবি বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, আবদুল্ল্যা -আল ফারুক, মুশতারী শফি সহ অসংখ্য কলাকৌশলী সে দিন এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস পাহারা দিয়েছিল। বলা হয়ে থাকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রয়াস। শব্দ যে অস্ত্রের চেয়ে শক্তিশালী তা কেবল ইতিহাস থেকে বুঝা যায়।
এ জাতি রক্ত দিয়েছে কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি। বার বার পাকিস্থানীরা এই বাঙ্গালিদের উপর চালিয়েছে গণহত্যা, নিপীড়ন-নির্যাতন। ২ লক্ষ নারী হারিয়েছে তাঁর সম্রম।
ভুলে গেলে চলবে না পাকিস্থানি প্রেতাত্মাদের দোসরেরা এখনো দেশে সক্রিয়। একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে যে কোন সময় তারা অপেক্ষায় থাকে।গোলাম আজম, কাদের মোল্লাদের নারকীয় ভূমিকার কথা বাঙ্গালি ভোলেনি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইতিহাসের কালো পাতায় চিহ্নিত হয়ে থাকবে ইতিহাসের বেইমানরা।

২৫ মার্চের ভয়াল সেই রাতে কত বাঙালিকে প্রাণ দিতে হয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে— এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকার ভাষ্য, কেবল ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় একলাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও কিছু তথ্য পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তারা যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়— ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।

আরও পড়ুন:  এবছর সর্বনিম্ন ফিতরা ১১৫ টাকা, সর্বোচ্চ ২৯৭০

গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যে কোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানান।

বঙ্গবন্ধুর এই আহবানে সাড়া দিয়ে বাঙালি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।

গ্রীক গণহত্যা, আর্মেনীয় গণহত্যা, এশিরিয়ান গণহত্যা, ইউক্রেনীয় গণহত্যা, কম্বোডীয় গণহত্যা, গুয়াতেমালান গণহত্যা, কুর্দীয় গণহত্যা, বসনীয় গণহত্যা, রোবণ্ডন গণহত্যার পাশাপাশি ২৫ শে মার্চে বাংলাদেশের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের আক্রমণ ভয়াবহ গণহত্যা। স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ বিভিন্ন সময় চেষ্টা করলেও তাতে সফল হয়নি।এবছরও ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এদিকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চসহ ৯ মাস জুড়ে চলা জাতিগত নিধন ও গণহত্যার প্রায় ৫০ বছরের বেশি সময় পরও আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এটিকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বলা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসি বাহিনী যে নির্যাতন চালিয়েছিলো সংখ্যায় না হলেও নির্মমতায় তাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলো পাকিস্তান।

আরও পড়ুন:  তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেশি দূরে ছিল না: ট্রাম্প

অপরদিকে, জাতিসংঘ কর্তৃক দিবসটি এখনও গণহত্যার স্বীকৃতি না পাওয়ায় সংস্থাটির কার্যকরীতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছে।

জাতীয় গণহত্যা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহবান জানিয়েছেন।

তবুও প্রকৃতপক্ষে আজ শোকে আপ্লুত হওয়ার দিন নয়। শোক হোক শক্তি। শহীদের রক্ত থেকে বার বার জেগে উঠবে আগামী প্রজন্ম। “মা-মাটি, মাতৃভাষা যদি স্বর্গ থেকে প্রিয় হয়ে থাকে, তবে ৫২ ও ৭১ এর বীর শহীদের আত্ম ত্যাগের চেয়ে সুমহান কোন মৃত্যু আছে বলে আমার জানা নেই”। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও মহানায়ক দের বীরত্বব্যঞ্জক ভূমিকার কথা যুগ যুগ ধরে স্বরণ করবে এদেশের মানুষ।একদিন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এ দিনটির ভয়াবহতা পূর্ণ মর্যাদা পাবে বলে আশা রাখি।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *