টুঙ্গীপাড়ায় জন্ম নেওয়া শিশু খোকাই বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা

শেখ ফজলে শামস পরশ

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বলতে গেলে প্রথমে বলতে হয়- বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নচারী এবং সম্মোহনী নেতৃত্ব সম্বন্ধে। একজন স্বপ্নচারী নেতা তিনিই যার সামনে সুনির্দিষ্ট একটি পরিকল্পনার ছক থাকে। তিনি তার লক্ষ্যের কথা বলেন, তার স্বপ্নের কথা বলেন। সেদিকে আমরা সাধারণ মানুষ সবাই কীভাবে যাব, তা তিনি নিজে করে দেখান।

সম্মোহনী নেতা তাকেই বলা যিনি তার চারপাশের জনগণকে উৎসাহিত করতে পারেন, প্রণোদিত করতে পারেন, যাকে দেখলে, যার কথা শুনলে জনগণ উৎসাহিত হয়ে ওঠে, ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হতে পারে এমন মানুষকেই আমরা সম্মোহনী নেতা বলি। তার উপস্থিতি, তার কথা, তার অস্তিত্ব সবকিছুই মানুষের বিস্তর সাহস, উদ্দীপনা আর ভবিষ্যৎ ভাবনার প্রণোদনা যোগায়। সম্মোহনী নেতার সবচেয়ে বড় গুণটি হচ্ছে, তিনি যা বলেন তা জনগণের মনে গেঁথে যায়। তারা উৎসাহিত হয়, প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে।

একটি মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার বঙ্গবন্ধুর যে স্বপ্ন, যা তিনি ১৯৪৭ সাল থেকে দেখে আসছিলেন, তা সমন্বিত আকারে তিনি বলেছেন ১৯৭১ এর ৭ মার্চের ভাষণে। বিভ্রান্ত বাঙালি জাতি সেদিন পেয়েছিল পথের দিশা। তার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল: ‘এবারে সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এ ভাষণে বাঙালির ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়েছে। জনগণের গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তি এবং স্বাধীনতার স্বপ্নের প্রকাশ এ ভাষণ।

তাই আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের অস্তিত্ব আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবন এক সূত্রে গাঁথা। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গীপাড়ায় জন্ম নেওয়া শিশু খোকাই বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের নির্মাতা; বাংলাদেশের স্বপ্ন দ্রষ্টা। তিনি এ জাতিকে দিয়েছেন আত্মমর্যাদা রাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম তার নেতৃত্বেই সঙ্ঘটিত। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন আর জাতির পিতার বিকাশ, যেন সমান্তরাল ধারায় বহমান।

আসলে বাংলাদেশকে ঘিরে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দুটি ধাপ ছিল। প্রথম ধাপে ছিল- এই অঞ্চলের (পূর্ব বাংলা) জনগোষ্ঠীর জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা। নিজস্ব ভুখন্ড আর পতাকা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দ্বিতীয় ধাপ ছিল, বাংলাদেশের রূপকল্প। তিনি কেবল একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেননি, স্বাধীন রাষ্ট্রের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেননি, স্বাধীন রাষ্ট্রটি কেমন হবে তার একটি রূপকল্প তৈরি করেছিলেন। কেমন বাংলাদেশ তিনি চান, তার একটি স্বপ্নও বঙ্গবন্ধু এঁকেছিলেন। সেই স্বপ্নের চূড়ান্ত পরিণতি হলো আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, স্বনির্ভর আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন:  সিলেটে বন্যায় ভোগান্তিতে সোয়া ৮ লাখ মানুষ

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেন ২৩ বছর। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার জন্য সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। বঙ্গবন্ধুর অনেক স্বপ্নই অধরা থেকে যায়। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট কেবল জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছে বাঙালির স্বপ্নকে। বাংলাদেশের রূপকল্পকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন সোনার বাংলা, ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ। কিন্তু পঁচাত্তরের কালো আগষ্ট সেই সোনার বাংলার স্বপ্নকে ধূসর করে দেয়। শুরু হয় বাংলাদেশের উল্টো পথ চলা। ’৭৫ এর পর বাংলাদেশ যে ধারায় চলতে শুরু করেছিল, তাতে এই রাষ্ট্রটি এতোদিন থাকতো না। থাকলেও ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানের মতো পরিস্থিতি হতো বাংলাদেশে। কিন্তু সেটা হয়নি। বরং বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আর বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়ানোর কান্ডারি হলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনার উন্নয়ন কৌশল হলো- বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন। বঙ্গবন্ধু যেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, বাংলাদেশকে সে রকম আধুনিক উন্নত এবং স্বনির্ভর করাই শেখ হাসিনার প্রধান লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যই তিনি নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আর শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির নেতা। তার হাত ধরেই বাংলাদেশ বদলে গেছে। তার নেতৃত্বেই বিশ্বে আজ বাংলাদেশ মর্যাদার আসনে। একথা বললে ভুল হবে না যে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা আর শেখ হাসিনা আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি।

বঙ্গবন্ধুর বাঙালিপনা নিয়ে এখানে দুই একটি কথা বলা প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাংলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিংশ শতাব্দীতে গড়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন, কারাবরণ ও ছাত্রলীগ গঠনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় তার নতুন রাজনীতি শুরু করেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িকরণে তার অগ্রণী ভূমিকা অনস্বীকার্য।

আরও পড়ুন:  মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে কাজ করবে 'আমরা মুজিব'

বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা মামলার এক নম্বর আসামি করার প্রতিক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এক উত্তাল গণআন্দোলনের সৃষ্টি হয়, যেই গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে গ্রেফতার হয় আপনাদের (যুবলীগের) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি। ৬- দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে সেই আন্দোলন থেকেই ধ্বনিত হয়, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা – মেঘনা – যমুনা’, ‘জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, এবং ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ।’

বঙ্গবন্ধু যখন কলকাতার ইসলামি কলেজে পড়ছিলেন তখন থেকেই গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে তার রাজনৈতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয়। সোহরাওয়ার্দীর জীবনের শেষ পর্যন্ত যা অক্ষুণ্ণ ছিল। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকেই বলা হয়।

এর অনেক আগে শিশুকালে বঙ্গবন্ধুর এক গৃহশিক্ষক হামিদ মাস্টার বঙ্গবন্ধুদের বাসায় লজিং থাকতেন। তিনি শিশু মুজিবকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে গল্প বলতেন। সেই হামিদ মাস্টারের সান্নিধ্যেই সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ধীরে ধীরে বাঙালির বঞ্চনা এবং এর প্রতিবাদ ও বাঙালির অধিকার আদায়ের দীর্ঘ সংগ্রাম সম্পর্কে চেতনার জাগরণ ঘটে।

বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধু বানানোর ব্যাপারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বঙ্গবন্ধুর আব্বা, অর্থ্যাৎ আমার বড় আব্বা, গোপালগঞ্জের কৃতি সন্তান শেখ লুতফর রহমান। পারিবারিকভাবে শেখ মুজিব উৎসাহ পেতেন তার পিতা, শেখ লুতফর রহমানের কাছ থেকে। শেখ মুজিবের পিতা রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলেন এবং রাজনৈতিক জ্ঞান রাখতেন এবং ছেলেকে রাজনৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ করতেন। বঙ্গবন্ধুর নিজের যেমন প্রবল আগ্রহ ছিল, মানব দরদি একটা মনন ছিল, তেমনি প্রেরণা দেওয়ার মতো একজন পিতাও তার ছিল।

একই সাথে শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর সহজাত ও মজ্জাগত প্রতিবাদী স্বভাব একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির অর্থ ছিল মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করা। লক্ষ্য অর্জনে শেখ মুজিব ছিলেন অবিচল। এবং সেই লক্ষ্য যদি দুঃখী মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য হয় সেক্ষেত্রে তিনি জীবন দিতে পারতেন।

পরিশেষে আমরা দেখতে পাই মূলত তিনটি বিষয় বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ রাজনৈতিক প্রেরণার পেছনে ভূমিকা রেখেছে। ১) বঙ্গবন্ধুর বাঙালিত্ব,
২) শোষিত-বঞ্চিত মানুষের প্রতি তার নৈতিক, যৌক্তিক এবং নিরপেক্ষ দায়বদ্ধতা। এবং ৩) তার পারিবারিক শিক্ষা ও বেড়ে উঠা। এই তিনটি চালিকা শক্তির কাঁধে ভর করে তরুণ মুজিব ধাবিত হয়েছিল মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। যেই লক্ষ্য থেকে তাকে কোন শক্তি বা শাসকগোষ্ঠী কোনদিন বিচ্যুত করতে পারেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাঙালির অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেন। বাঙালিকে ভালোবেসেছেন এবং বাঙালির উন্নতির কথা ভেবেছেন।

আরও পড়ুন:  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪তম জন্মবার্ষিকী আজ

আমাদের নূতন প্রজন্মের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে হবে এবং একই সাথে শুধু দেশপ্রেমী নয়, বাঙালি সংস্কৃতির ও ইতিহাসের অনুরাগী হতে হবে। শুধু আবেগ নির্ভর রাজনীতি নয়, নৈতিক এবং যুক্তিশীল রাজনীতি করতে হবে। একই সাথে বাঙালি মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে হবে। নিজেকে জানতে হবে এবং আত্ম সমালোচনাও করতে হবে। কেবল তাহলেই মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের সম্মান আমরা দিতে পারব। ভুলে গেলে চলবে না- এদেশ সহজে স্বাধীন হয় নাই, বহু বাঙালির মা-বাবা, ভাই বোনদের রক্তের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল। এই বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের সচেতন থাকতে হবে এবং একই সাথে দায়িত্বশীল হতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মৌলবাদী ধর্মান্ধতা এবং অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে প্রতিহত করে একটি প্রগতিশীল বিজ্ঞানভিত্তিক, গঠনমূলক রাজনৈতিক পথ তরুণ প্রজন্মকে বেছে নিতে হবে।

[১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) রাজধানীর মহাখালীর সাউথ পয়েন্ট স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে দেশব্যাপী দরিদ্র-অসহায় মানুষের মাঝে ইফতার সামগ্রি বিতরণ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে দেওয়া প্রদত্ত ভাষণ।

লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *